এক সময়ের অবহেলিত ও বিরাণ জনপদে এখন নির্মাণ হয়েছে শেখ হাসিনা স্বরণী। পূর্বাচলের এই সড়কটি ৩০০ ফিট নামে পরিচিত। ১৪ লেনের বিশ্বমানের এক্সপ্রেসওয়েটি দেশের অন্যতম আধুনিক পথের একটি। এই সড়ক নির্মাণের মধ্য দিয়ে অনেক দুঃখ, কষ্টের অবসান হয়েছে। অথচ পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় এলাকাটিতে সবার অগোচরে থাকা একটি কষ্ট কিন্তু রয়েই গেছে। দৃষ্টিনন্দন বালু সেতুর নিচ দিয়ে প্রবাহিত ‘বালু’ নদীটি যেন বারবার ডাক দিয়ে বলছে- আমিও দুঃখ ঘোচাতে চাই। বিবর্ণ রং বদলে চাই স্বাভাবিক প্রবাহ।
নদীটির দিকে তাকালে যে কেউ দ্বিধান্বিত হতে পারেন। নদীতে এখনও নৌকা ভাসতে দেখা যায়। দূর থেকে দেখলে মনে হবে, সবাই মাছ ধরায় ব্যস্ত। আসলে তা নয়। কাছে এলেই ধারণা বদলে যাবে। মোটা রশিতে বাঁধা বড় আকারের ম্যাগনেট বারবার ফেলা হচ্ছে নদীতে। কিছু সময় পর আবারো জালের মতো করে তা নৌকায় টেনে তোলা হয়। নদীর পাড়ে থাকা বিভিন্ন কল কারখানা থেকে আসা বর্জের সঙ্গে লোহা জাতীয় ধাতব এই ম্যাগনেট দিয়ে টেনে তোলা হয়। দিনশেষে তা বিক্রি করে কিছু মানুষ জীবিকা নির্বাহ করেন।
স্থানীয় লোকদের মধ্যে যারা বালু, শীতলক্ষ্যাসহ আশপাশের বিলগুলোতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন, তাদের কেউই এখন পুরনো পেশায় নেই। সবার চোখের সামনে বালু পরিণত হয়েছে খালে। আলকাতরা রঙে মৃত্যুর প্রহর গুনছে নদীটি।
এতো গেলো একটি নদীর কথা। রাজধানীর চারপাশজুড়ে থাকা সবকটি নদীর চিত্র একই। বিশ্বব্যাংক ইতোমধ্যে বুড়িগঙ্গাকে ‘মড়া’ নদীর খ্যাতি দিয়ে বিশ্বের পঞ্চম দূষিত নদী হিসেবে ঘোষণা করেছে। অথচ এই নদী ঘিরে ৪০০ বছরের পুরনো রাজধানী শহরের যাত্রা শুরু। এই নদীকে লন্ডনের টেমস নদীর সঙ্গে তুলনা করা হতো। বলা হতো এটি রাজধানীবাসীর ফুসফুস। অথচ চোখের সামনে নদীর অস্তিত্ব আজ বিপন্ন। পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা কমতে কমতে জীববৈচিত্র প্রায় বিপন্ন। এখন এই নদীতে বিষাক্ত সাকার মাছ ছাড়া কিছু নেই। ঐতিহ্যের নদীটিকে গিলে খাচ্ছে বিষাক্ত পলিথিন আর কলকারখানার বর্জ্য। ভালো নেই পদ্মা, যমুনার মতো বড় নদীও।
এবারের নৌ নিরাপত্তা সপ্তাহের অনুষ্ঠানে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোস্তফা কামাল বলেছেন, ‘এখন তো বুড়িগঙ্গার পানি অজুর উপযোগী নয়। কারণ অজু করতে বিশুদ্ধ পানির প্রয়োজন হয়।’
একজন সরকারি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার মুখ থেকে একথা বলার পর বুড়িগঙ্গার পানি নিয়ে নতুন করে বিবরণ দেয়ার দরকার হয় না। এককালে বাংলাদেশের বড় পরিচয় ছিল ‘নদীমাতৃক দেশ’। সে পরিচয় ছাপিয়ে এখন বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে ‘দূষিত নদীর দেশ’। বাংলাদেশের নদ-নদীগুলোর প্রায় সবগুলোই শিল্পবর্জ্য ও মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। ৫৬টি প্রধান নদ-নদীর ওপর সম্প্রতি করা এক গবেষণার তথ্য বলছে, এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দূষিত নদী গাজীপুরের লবণদহ, নরসিংদীর হাঁড়িধোয়া ও হবিগঞ্জের সুতাং। এ গবেষণায় ৫৬টি নদ-নদীতেই সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি দূষণের অস্তিত্ব মিলেছে। অথচ তা ঠেকানো গেলো না। এত বড় সর্বনাশ তো আর একদিনে হয়নি!
তেমনি গেল ৫২ বছরে নদীপথ কমে চারভাগে একভাগে নেমেছে। নদীমাতৃক দেশে অপমৃত্যু হয়েছে অনেক নদীর। দিন দিন কমছে নৌযান ও নৌ পথের যাত্রী ও পণ্য পরিবহন। এই সুযোগে চাঙ্গা হয়েছে সড়কপথ। অর্থাৎ কোনোভাবেই নদীকে সুরক্ষা দেয়া যায়নি। অনেক দেশ আছে যারা কৃত্রিম নদী, হ্রদ, চ্যানেল বানিয়ে নানাভাবে কাজে লাগাচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতির দানকে রক্ষা করা যায়নি অবহেলা আর লালসার কোপে।
প্রশ্ন হলো বিশ্বের ভয়াবহ দূষিত অনেক নদীর নাম তো পরিত্যক্তর তালিকা থেকে বেরিয়ে ব্যবহারের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। এই ইতিহাস নতুন কিছু নয়। গেল প্রায় ৩০ বছর এমন উদাহরণ অনেক। তাহলে এই দীর্ঘ সময়ে দূষিত নদীগুলোর মধ্যে একটিরও কেন প্রাণ ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব হলো না? কেন বন্ধ করা যায়নি দূষণের উৎস। নদী ধ্বংসের সূচকে দেশের অবস্থান আরো খারাপ পর্যায়ে কেন গেল? কেন মৃত্যু হলো অনেক নদীর? এসব প্রশ্নের জবাব সবার জানা থাকলেও রোগের দাওয়াই খুব দুর্বল। এমন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে তবুও বলা হচ্ছে নদীর প্রাণ আছে? নদী জীবন্ত স্বত্তা। নদী না থাকলে বাংলাদেশ থাকবে না। নদী রক্ষায় গেল ১৫ বছরে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে। লাভের হিসাবে কি পাওয়া গেল? এ প্রশ্নও এখন অবান্তর হবে না। যখন সাবই মিলে নদী ধ্বংসের আয়োজনকে লালন করা হচ্ছে তখন কাজগপত্র আর বিশ্বব্যাংকের তালিকার কারণে মিছেমিছি বলে আর লাভ কি- আমরা নদী রক্ষা করতে চাই।
সরকারি হিসাবে বুড়িগঙ্গায় দিনে ৯০ টন বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। তুলনামূলক বিবেচনায় বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত নদী ইন্দোনেশিয়ার চিতারুমের চেয়ে বেশি দূষিত হচ্ছে এই নদী। কিন্তু বুড়িগঙ্গা রক্ষায় সরকারের পক্ষ থেকে যতোদিন ধরে চেষ্টা হচ্ছে এই সময়ে কি কোন উন্নতি হয়েছে নদীটির? বাস্তবতা এর সাক্ষ্য দেয় না। তাহলে চেষ্টায় খামতি ছিল- এতে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়।
নদী জীবন্ত সত্তা, তারও প্রাণ আছে, আছে অনুভূতি এবং সেই অনুভূতির সঙ্গে মানুষেরও একাত্মতা রয়েছে, তা বহু আগেই উপলদ্ধি করেছিলেন রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ। তার লেখায় নদীর প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছিল। সেই লেখার অনেক বছর পরে, ২০১৯ সালে বাংলাদেশের উচ্চ আদালত তুরাগসহ দেশের সকল নদীকে ‘লিভিং এনটিটি’ বা ‘জীবন্ত সত্তা’ হিসেবে ঘোষণা করেন। অথার্ৎ দেশের নদীগুলো এখন থেকে মানুষ বা অন্যান্য প্রাণির মতোই আইনি অধিকার পাবে। কিন্তু নদী গবেষকদের কেউই তো বলছেন না, সরকারীভাবে নদীর যে সীমানা ঠিক করা হয়েছে তাতে দখলদারদের স্বার্থ রক্ষা হয়নি। নদীর প্রকৃত সীমানার সঙ্গে নানা কারণে আপোস করা হয়েছে।
আদালতের রায় অনুযায়ী নদীগুলো এখন ‘জুরিসটিক পারসন’ বা ‘লিগ্যাল পারসন’। সুতরাং নদীকে হত্যা করার অর্থ হলো বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে হত্যা করা। আদালত স্পষ্ট করে বলেছেন, তুরাগ নদীসহ বাংলাদেশের সব নদীই মূল্যবান এবং সংবিধান, বিধিবদ্ধ আইন ও পাবলিক ট্রাস্ট মতবাদ দ্বারা সংরক্ষিত। নদী মা হিসেবে স্বীকৃত। নদী দূষণও মাকে হত্যা করার সামিল।
নদীর পানি প্রবাহ ঠিক রাখা, দূষণ মুক্ত রাখা এবং দখল রোধে জড়িত আছে ২৭টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। এরপরেও নদী রক্ষা পাচ্ছে না। এর কারণ হলো, দেশে নদীরক্ষার জন্য বা নদীকে দখল ও দূষণের হাত থেকে বাঁচানো এবং নদী হন্তারকদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে আলাদা কোনো আইন নেই। পরিবেশ সুরক্ষা আইন এবং জলাধার সুরক্ষা আইনে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু নির্দেশনা ও শাস্তির কথা উল্লেখ রয়েছে। নদী রক্ষা করবোই- রাষ্ট্র এরকম কঠোর সিদ্ধান্ত এখন পর্যন্ত নিয়েছে বলে মনে হয় না।
বিবিসির সমীক্ষায় বাংলাদেশের ৪৩৫টি নদী হুমকির মুখে; ৫০ থেকে ৮০টি নদী বিপন্নতার শেষ প্রান্তে। গবেষকদের মতে, এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ২০৫০ সাল নাগাদ নদীমাতৃক বাংলাদেশের নাম শুধু ইতিহাসের পাতায় থাকবে।
নদী না থাকলে কী হবে? তা নতুন করে বলার কিছু নেই। নদীর মৃত্যু মানেই নানাদিক থেকে অপূরণীয় ক্ষতি। তাই বলা হয়, নদী বাঁচলে দেশ বাঁচবে। মূল কথা হলো নদীমাতৃক দেশ। নদী ফেরত চাই। দিতে হবে। নদীকে গ্রাস করার অধিকার কারো নেই। সব নদীকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হলে, এর সুফল সবাই পাবে। যদি সত্যিকার অর্থেই নদীকে বাঁচানোর সিদ্ধান্ত হয়, তাহলে নজির স্থাপনের ব্যবস্থা করতে হবে। নদী রক্ষা করব- এ ধরনের কথার কথা আর কেউ শুনতে চায় না। সব রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নদী রক্ষায় সরকারকে আরো কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। রাষ্ট্রের চেয়ে তো কেউ শক্তিমান হতে পারে না। রাষ্ট্র যদি নদী রক্ষায় একমত হয়, তবে আর ভয় থাকার কথা নয়।
বিচ্ছিন্ন প্রকল্পের মধ্য দিয়ে দেশের নদ-নদীগুলোকে সুরক্ষা দেয়া সম্ভব নয়, ইতোমধ্যে তা প্রমাণিত। তাই বিপন্ন নদীগুলোকে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে খনন করে পানি প্রবাহ সৃষ্টি করতে হবে। ছাড়তে হবে আপোসকামিতা। দখল আর দূষণে জর্জরীতি নদীগুলোতে তিন বছরের মধ্যে বদলে দেয়া অসম্ভব কিছু নয়। অর্থাৎ পাঁচ বছরের মধ্যে দেশের নদ-নদীর চেহারা পরিবর্তন করা যেতে পারে। কথা বা প্রতিশ্রুতি নয়। নদী রক্ষার উদাহরণ চাই। নদীর প্রাণ দেখতে চাই। দৃশ্যমান কর্মের মধ্য দিয়ে বোঝা যাবে সত্যিকার অর্থেই নদী বাঁচাতে চাই। চাই নদী ঘিরে সবকিছু রক্ষা করতে। ২০৫০ সালের মধ্যে দেশের নদ-নদী নিয়ে যে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে তা মিথ্যা প্রমাণ করতে পারে সরকারের নদী রক্ষার স্বদিচ্ছা।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট