কোটা সংস্কার ঘিরে সংঘাত। শুধু রাজধানী নয়, দেশজুড়ে সহিংসতা-সংঘর্ষ। পথে পথে গোলাগুলি, বোমাবাজি, সাউন্ড গ্রেনেড, আগুনসন্ত্রাস। আহ! কী নির্মম— চারদিকে যেন ধ্বংসস্তূপ, লাশের মিছিল, আহত অসংখ্য! হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি! দেশজুড়ে কারফিউ, ইন্টারনেট সেবা বন্ধ। ইন্টারনেটের ফলে অফিস-আদালত, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, নিউজ পোর্টাল— সব কিছুরই বিঘ্ন ঘটেছে। বিষয়টি নিয়ে বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এমন সময় যারাই অফিসের বা অন্য কাজে বাসার বাইরে বের হয়েছেন, তারা অনেকেই সংঘর্ষের মধ্যে বা অন্য কোনও ঝামেলায় পড়েছেন। বাসায় থেকেও শান্তি ছিল না। সবাই পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, সহকর্মী, পরিচিতজনদের নিয়ে উদ্বিগ্ন-অস্থিরতায় ছিলেন। ইন্টারনেটের কারণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ থাকায় ও মোবাইল ফোনে যোগাযোগ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় মানুষের অস্থিরতা আরও বেড়ে যায়।
এমন সময়ে একটাই মনে হচ্ছিল, সুদূর অতীতকাল থেকে একটা প্রবাদ বাক্য প্রচলিত আছে ‘বাংলা হল বালঘাকখানা’ অর্থাৎ গোলযোগের আবাসভূমি। বাংলা ও বাঙালির রাজনৈতিক চরিত্র নিয়ে অনেকে অনেক তত্ত্ব, দৃষ্টিভঙ্গি ও ধারণা দিয়েছেন, মন্তব্য করেছেন। তবে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, তত্ত্ব, কাঠামোবদ্ধ বা দার্শনিক ধারণা যা-ই বলুন, সেটা প্রথমে এসেছিল ১৫৭৯ সালে মোঘল সম্রাট আকবরের প্রধান উপদেষ্টা আবুল ফজল আল্লামির নিকট থেকে। প্রায় ৫০০ বছর আগে আবুল ফজলের অবাক করা, বোমা ফাটানো অভিনব তত্ত্ব ও কথাগুলো ঘিরেই যেন আজও বাংলার রাজনীতি পরিচালিত হয়।
বিচক্ষণ আবুল ফজল আগে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করতেন এবং সবকিছুই একজন ভালো পর্যবেক্ষকের মতো যৌক্তিক চোখে দেখতেন। তারপরই সেসব তথ্য তার গ্রন্থে যুক্ত করতেন। জানা যায়, মোঘল সাম্রাজের ১২টি প্রদেশের অন্যতম বাংলায় না এসে বাংলার অনেক তথ্য-প্রমাণ ও ইতিহাস সংগ্রহ করেন এবং তা থেকে এ সিদ্ধান্ত ও ব্যাখ্যায় তিনি উপনীত হন।
আবুল ফজল আল্লামি লিখেছিলেন ‘বাংলা নামের দেশটি এমন একটি অঞ্চল, যেখানে আবহাওয়ার কারণে অসন্তোষের ধুলা সবসময় উড়তেই থাকে। মানুষের শয়তানিতে এখানকার পরিবার ও জনপদগুলো ধ্বংস হয়ে যায়’।
আবুল ফজলের মতে, স্নায়ু বিকলকারী আবহাওয়া মানুষকে কলুষিত করে ও কলুষিত মানুষ সার্বভৌম শাসনকে ধ্বংস করে। যে কারণে বহিরাগতদের ব-দ্বীপকে শক্তিশালী হওয়ার পথ সুগম করে। বাংলায় এমন পরিবেশ বিদ্যমান থাকে যেখানে কেউ গেলে বা যারা বসবাস করে, স্বাভাবিকভাবে সবাই সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ভূমিকা পালনের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। স্থানীয়দের (বাঙালি) মধ্যে সহজে বিভেদ সৃষ্টি হয়। নিজেদের স্বার্থের বিষয়টি সবার কাছে প্রধান থাকে। ব্যক্তিস্বার্থের কারণে সার্বভৌম শাসন ও সবার জন্য মঙ্গলকর (জাতীয় স্বার্থ) বিষয়সমূহ ধ্বংস করা তাদের কাছে কোনও ব্যাপার নয়। এ কারণে তিনি লিখেছিলেন ‘এদের স্বার্থ দেখিয়ে বিভেদ সৃষ্টি কর আর সুবিধা নাও’।
আবুল ফজলের পরে মালদহের কাছাকাছি অবস্থিত মালতীপুরের শেখ শাহ নিয়ামত উল্লাহ ফিরোজপুরি (মৃত-১৬৬৯) বাংলার রাজনীতি সম্পর্কে বিতৃষ্ণ হয়ে ৪ লাইনে লিখেছিলেন ‘বাংলা একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত ও বিরসভূমি; মৃতদের জন্য প্রার্থনা করো, দেরি করো না। সেখানে ভূমি বা পানি কিছুই শান্তিতে থাকে না; হয় বাঘের থাবায়, নয়তো কুমিরের মুখে পড়তে হবে।’
আবুল ফজল সামাজিক ও রাজনৈতিক অভিনব তত্ত্বটি শুধু দিয়েই যাননি, মোঘলরা অক্ষরে অক্ষরে তার বাস্তবায়ন করে এবং সফলতা পায়।
অনেকের জানা, বাংলায় মোঘল শাসন হঠাৎ করে শুরু হয়নি। অনেক ঘাত–প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে তারা বাংলা শাসনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ছিল। ১৫৭৪ সালে মোঘল বাহিনীর বাংলার রাজধানী টাণ্ডায় প্রবেশের ঘটনা ফয়সালা সূচক মনে হলেও, বিষয়টি সম্পন্ন হতে প্রকৃতপক্ষে পৌনে ১০০ বছর লেগে যায়। ১৫৩৭ সালে এটি শুরু হয়ে ১৬১২ সাল পর্যন্ত চলে।
বিষয়টি লক্ষণীয় যে, মোঘলদের বাংলা বিজয় ও নিয়ন্ত্রণের পেছনে শুধু তরবারি, বারুদ, কামান বা সামরিক শক্তিই প্রধান ছিল না। স্থানীয় ও শত্রুদের মধ্যে বিভেদের বীজবপন, ঘুষ ও সুযোগ-সুবিধা প্রদান, কূটনীতি, ভয়ভীতি দেখানো ও মুলা ঝুলানো কৌশলের দিকে বেশি নজর ছিল।
বাংলার মানুষের অধঃপতনের এই অভিনব তত্ত্বটি ব্রিটিশ, ডাচ, পর্তুগিজ, ফরাসি সবাই জানত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ও পরবর্তীতে ব্রিটিশ উপনিবেশিক কর্মকর্তারা এই তত্ত্বটি জোরালোভাবে গ্রহণ করেছিল। রবার্ট ক্লাইভ জেনেশুনে বা তত্ত্বটি ভালোভাবে রপ্ত করে চক্রান্তের জাল বিস্তার করেছিল। পরিবেশ সবই বিদ্যমান ছিল, তিনি শুধু খেলাটা চালিয়ে গিয়েছিলেন। ক্লাইভ এ ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, চক্রান্তের ফল নিশ্চিত। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন, পলাশী যুদ্ধে রবার্ট ক্লাইভের মাত্র ৩২০০ সৈন্যের কাছে বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার ৫০ হাজারের চৌকস বাহিনীর অভাবনীয় পরাজয় ঘটে। বিজয়ের পর রবার্ট ক্লাইভ ও তার বাহিনী যেদিন রাজধানী মুর্শিদাবাদে এসেছিলেন, সেদিন রাজধানীতে যত মানুষ জড়ো হয়েছিল, তারা যদি ঢিলও ছুঁড়ত; এমনকি শোরগোল বা চিল্লাচিল্লি করত, তাহলে ইংরেজরা পরাজিত হয়ে যেত।
দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী নবাব সিরাজউদ্দৌলা দ্রুত রাজধানী মুর্শিদাবাদে ফিরে এসে রাজকোষ উন্মুক্ত করে দেন এবং সবাইকে দেশ রক্ষার আহ্বান করেছিলেন। পলাশী যুদ্ধের আগে ও পরে আরও অনেক সুযোগ এসেছিল। কিন্তু ব্যক্তি স্বার্থ আর একে অপরের প্রতি অবিশ্বাসের ফলে নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। আর ইংরেজরা প্রায় দুইশ বছর এর সফল বাস্তবায়ন করে গেছে।
১৯৪৭ সালে বাংলাকে অখণ্ড রেখেই স্বাধীনতা পাওয়ার সুযোগ এসেছিল। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীও সম্মতি দিয়েছিলেন। কিন্তু ব্যক্তি স্বার্থ, ষড়যন্ত্র আর চক্রান্তের কারণে বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ করা যায়নি।
আমাদের এক জাতীয় নেতা শেরে-বাংলা একে ফজলুল হকের সেই বিখ্যাত উক্তিটি স্মরণ করা যেতে পারে ‘মুসার সময় মুসা আর ঈসার সময় ঈসা’। আসলে আমরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের কথা বলি, ভোল পাল্টাই ও ডিগবাজি দেই, আর স্বার্থটাই থাকে প্রধান। আর যে জন্য পুরো জাতিকে খেসারত দিতে হয়। আশা করা হয়েছিল, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর বাঙালিরা তাদের দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু বাঙালি বিশেষ করে শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী সমাজ এই সুবিধাবাদী চরিত্র বদলানোর পরিবর্তে আরও চরম আকারে চর্চা শুরু করে।
তাই তো গবেষক ও সৃজনশীল লেখক আহমদ ছফাকে ১৯৭৫ সালের পটভূমি পরিবর্তনের কিছু দিন পর লিখতে হয়েছিল ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ নামে এক প্রবন্ধ। মুসলমান শব্দ আছে বলে এটাকে অনেকে সাম্প্রদায়িক ধরনের কিছু মনে করেন। কিন্তু আহমদ ছফা ছিলেন অসাম্প্রদায়িক এবং তার লেখায় সাম্প্রদায়িকতার কিছু পাওয়া যায় না। বাংলার মুসলমানরা যেহেতু বাঙালি সমাজের অংশ, অতএব তাদের চরিত্র দেখালে বাঙালির চরিত্র অনেকটা ফুটে ওঠে, এমনটাই তার প্রবন্ধে পাওয়া যায়।
আহমদ ছফার মতে, বাঙালি শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবি সমাজ চরম স্বার্থপর। এরা স্বার্থের বাইরে কিছু চিন্তা করতে পারে না। এদের কথা শুনলে দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। এদের কথা শুনলে দেশ স্বাধীন হতো না। ’৭১ সালে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন সরকারি অফিসে বাঙালি উপস্থিতির হার ছিল প্রায় শতভাগ, অর্থাৎ তখনও তারা বাংলাদেশকে মেনে নিতে পারেনি। আবার দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সাথে সাথে তারা তাদের চরিত্র পাল্টে ফেলে। ১৯৭৫ সালের পটভূমি পরিবর্তনের পর আবারও তাদের চরিত্র পাল্টে যায়। এভাবেই সুবিধাবাদী নীতিই তাদের কাছে সবসময় প্রধান্য থাকে।
সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে প্রথম থেকেই জেদাজেদি ও পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। যে কারণে অনেক হানাহানি ও অনেক কিছু পণ্ড হওয়ার আশঙ্কা ছিল। বাস্তবে সেটাই ঘটল। শেষ পর্যন্ত কোটা সংস্কার হলো, কিন্তু দেশের মানুষের মধ্যে অবিশ্বাস আর বিভেদের ফাটলটা আরও দীর্ঘ হয়ে গেল। চাকরিপ্রত্যাশী ও শিক্ষার্থীদের দাবি প্রাসঙ্গিক, ন্যায্য এবং যৌক্তিক কিনা, সেটা যৌক্তিকভাবে ভেবে সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সমাধানের পথ বের হতে পারত। কিন্তু হলো না। ফলে রাজনৈতিক ব্যক্তি, প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী— সর্বোপরি শিক্ষিত মানুষের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আসলে তাদের ভূমিকা কী ছিল? বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষিত সমাজ কোনভাবেই তাদের দায় এড়াতে পারেন না।
বাঙালির চরিত্র নিয়ে কিছু তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য ও মন্তব্য রয়েছে, যেগুলো আমাদের জন্য ক্ষতিকর। যেমন, বাঙালি স্বার্থপর, ঈর্ষাপরায়ণ, পরশ্রীকাতর, আত্মকলহপরায়ণ, ঝগড়াটে, কর্মকুণ্ঠ, চক্রান্তপ্রবণ, অদূরদর্শী, অসহিষ্ণু, আবেগপ্রবণ, হুজুগে, আত্মকেন্দ্রিক, নেতিপ্রবণ, আত্মবিস্মৃত, ইতিহাসচেতনাহীন ইত্যাদি।
বাঙালি অন্যের দ্বারা শোষিত হয়েছে বেশি, তাহলে এই নেতিবাচক চরিত্র রাজনীতিতে প্রধান হয়ে উঠল কীভাবে? ইতিহাসবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, জাতির উত্থান-পতন, বিভিন্ন সময়ে রাজা-বাদশাহ, শাসক-নেতা, সমাজপতি ও জনগণের ভূমিকা; তেমনি শিক্ষা-দীক্ষা, ধর্ম, উৎপাদন ও সম্পদের বণ্টন ব্যবস্থা প্রভৃতি এই রাজনৈতিক চরিত্রকে প্রভাবিত করে থাকে। শাসক ও নেতাদের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে জনগণের বৈশিষ্ট্য সংশ্লেষিত হয়। নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যগুলো জাতির জন্য মঙ্গলকর নয়। এই চরিত্র বদলানো বা বিকশিত করার পথ যে একেবারে বন্ধ, এমনটাও নয়। প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছার, অন্যের মতামতকে মূল্যায়ন করা, ব্যক্তি স্বার্থের পরিবর্তে সার্বভৌম শাসন, সবার জন্য মঙ্গলকর ও জাতীয় স্বার্থকে প্রধান্য দেওয়া।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী