ইসলামি শরিয়া অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করাই ইসলামী দলগুলোর উদ্দেশ্য। এই পদ্ধতির রাষ্ট্রব্যবস্থাকে তারা ‘খেলাফত’ বলেন। ধর্মভিত্তিক দলগুলো খেলাফত ও মুসলিম রাজতন্ত্রকে বৈধ রাজনৈতিক ব্যবস্থা বলে মনে করেন। বাকি রাজনৈতিক ব্যবস্থা যেমন গণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্র তাদের নিকট হারাম। তবে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলিমদের ক্ষমতায় যাবার পথ হিসেবে সেগুলো ব্যবহার করাকে বৈধ বলে তারা রায় দেন। ফলে তারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোটে অংশগ্রহণও করেন।
বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং কাশ্মিরে ‘জামায়াতে ইসলামী’, আরব বিশ্বে ‘ইখওয়ানুল মুসলিমিন’ বা ‘ব্রাদারহুড’, ইন্দোনেশিয়ায় ‘মারেকাত ইসলাম’ এবং ইরানে ‘ইসলামী সরকার’ নামে তারা খেলাফত প্রতিষ্ঠায় রাজনীতি করছে। বাংলাদেশে আরও যে দলগুলো খেলাফত প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘হিযবুত তাহরির’, ‘খেলাফতে মজলিশ’, ‘খেলাফত আন্দোলন’, ‘ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন’, ‘তরিক্বত ফেডারেশন’ প্রভৃতি। আরও কিছু সংগঠন আছে যারা নিজেদের অরাজনৈতিক দাবি করলেও তাদের সংগঠনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও কর্মকাণ্ড খেলাফত প্রতিষ্ঠার কথা বলে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘হোফাজতে ইসলাম’, ‘হিযবুত তৌহিদ’, ‘জমিয়তে হিযবুল্লাহ’ প্রভৃতি।
জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৪১ সালে পাকিস্তানের লাহোরে। এর প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মওদুদী। ১৯৪৭ সালে মুসলমানরা যখন একটি আলাদা রাষ্ট্র চাচ্ছিল তখন মাওলানা মওদুদীর প্রতিষ্ঠিত জামায়াতে ইসলাম পাকিস্তান গঠনের ঘোর বিরোধী ছিল। কারণ, মওদুদী অখণ্ড ভারত চেয়েছিলেন। খুরশিদ আহমাদ ও জাফর ইসহাক আনসারীর লেখা ‘মাওলানা মওদুদীর জীবন কর্ম, চিন্তা ইসলামি বুনিয়াদ’ বইয়ের সাত নাম্বার পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, ১৯২০ সালে ১৭ বছর বয়সে মওদুদী ‘তাজ’ পত্রিকায় সাংবাদিকতার কাজ শুরু করেন। পত্রিকাটিতে ব্রিটিশবিরোধী সম্পাদকীয় লেখার কারণে পত্রিকাটির সম্পাদক ও প্রকাশককে গ্রেফতার করা হয়। এ রকম বিভিন্ন স্থানে তার ব্রিটিশবিরোধীতা ও দেশভাগের বিরোধীতার প্রমাণ আছে। মূলত এর মাধ্যমেই জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক চিন্তাগুলো প্রাকাশ পাচ্ছিল তখন।
এই দলের প্রধান নেতাকে ‘আমীর’ বলা হয়। এর প্রতিষ্ঠাতা আমীর মাওলানা মওদুদী মুঘল সম্রাট আলমগীরের শরিয়াভিত্তিক শাসন দ্বারা ব্যাপক প্রভাবিত ছিলেন। ফতওয়ায়ে আলমগীরির আরেক নাম ‘আল-ফাতাওয়া আল-হিন্দীয়া’। যা রচিত হয়েছিল ৫৪ বছর ধরে। ভারতীয় উপমহাদেশের রাষ্ট্রকাঠামো, সাধারণ নৈতিকতা, সামরিক কৌশল, অর্থনৈতিক নীতি, ন্যায় বিচার এবং শাস্তির উপর আইন সংকলন ছিল। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের নির্দেশে এই সংকলন প্রণীত হয়।
ফতোয়ায়ে হিন্দীয়া প্রণয়নের উদ্দেশ্যে আওরঙ্গজেব ফিকহের ৫০০ আলেমকে নিয়োগ দেন। তাদের মধ্যে ৩০০ জন দক্ষিণ এশিয়া, ১০০ জন ইরাক এবং ১০০ জন হেজাজ থেকে আগত। দিল্লি ও লাহোরে সংকলন কর্মে শেখ নিজাম বুরহানপুরি দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাদের কয়েক বছরব্যাপী পরিশ্রমের মাধ্যমে ফতোয়ায়ে হিন্দীয়া প্রণীত হয়। এই গ্রন্থে বিভিন্ন সম্ভাব্য পরিস্থিতির সাপেক্ষে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, দাস, যুদ্ধ, সম্পদ, আন্তঃধর্মীয় সম্পর্ক, বিনিময়, কর, অর্থনীতি ও অন্যান্য আইন এবং আইনি নির্দেশনা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। শুধু ফতোয়ায়ে আলমগীরির প্রভাবই নয়, মাওলানা মওদুদী ও তার সংগঠন জামায়াতে ইসলামের সঙ্গে আদর্শিক মিল পাওয়া যায় মিশনের ব্রাদারহুডের সঙ্গে।
জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৪১ সালে, মুসলিম ব্রাদারহুড প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২৮ সালে। ব্রাদারহুডের প্রতিষ্ঠাতা হাসান আল বান্না। জামায়াতে ইসলামী এবং তার ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা ‘শহীদ হাসানুল বান্নার ডায়েরি’ বইটা পাঠ্য হিসেবে পড়ে থাকেন। বইটা তাদের ওয়েবসাইটেও আপলোড করা আছে। তাদের আদর্শিক চেতনা যে ব্রাদারহুডেরও এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। ব্রাদারহুড প্রতিষ্ঠার বছরেই মিশরে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব হয়। অপরদিকে জামায়াতে ইসলাম প্রতিষ্ঠার কিছুদিন পরই অখণ্ড ভারতে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা শুরু হয়। পাকিস্তানে এটা চূড়ান্ত রূপ পায় ১৯৬২ সালে। সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ধর্ম নিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী দলের প্রধান গামেল আবদেল নাসের ১৯৫২ সালে মুসলিম ব্রাদারহুড নিষিদ্ধ করে। জামায়াতে ইসলামসহ অন্য ধর্মভিত্তিক দলগুলো বাংলাদেশে ১৯৭২ সালেই নিষিদ্ধ হয়।
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর দলটি দুটি সংগঠনে ভাগ হয়। জামায়াত-ই-ইসলামী পাকিস্তান ও জামায়াত-ই-ইসলামী হিন্দ। ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জামায়াতে ইসলামী কাশ্মীর। যা ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত জামায়াত-ই-ইসলামী আজাদ কাশ্মীর নাম গ্রহণ করে। জামায়াতে ইসলাম বাংলাদেশে রাজনৈতিকভাবে পুনর্যাত্রা শুরু করে মেজর জিয়ার শাসনামল থেকে। ১৯৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবির। ১৯৮০ এর দশকে পাকিস্তানি জামায়াত কাশ্মীরের জামায়াত-ই-ইসলামীর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং কাশ্মীরের সশস্ত্র বিদ্রোহে সমর্থন জোগায়।
১৯৪৭ এর পাকিস্তানবিরোধীতার মতো তারা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশেরও বিরোধিতা করেছিল। এর অন্যতম কারণ হিসেবে তারা মনে করত, পাকিস্তান ভাগ হলে বাংলাদেশ হবে ভারতের কলোনি। তাদের আরেকটি বড় অসুবিধা ছিল আদর্শিক জায়গায়। আদর্শগত কারণেই জামায়াতের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও সমাজতন্ত্রকে গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। তারা ইসলামকে শুধু ধর্ম হিসেবেই মানে না, একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হিসেবে রাষ্ট্রপরিচালনার তন্ত্র হিসেবেও বিশ্বাস করে। কারণ, তাদের দলের লক্ষ্য উদ্দেশ্য হলো ‘ইক্বামতে দ্বীন’ বা শরিয়ত মোতাবেক রাষ্ট্র পরিচালনা করা। পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দলগুলো মনে করত ধর্ম ব্যক্তিগতভাবে পালনীয় বিষয়। রাষ্ট্র পরিচালনায় একে গুলিয়ে ফেলা সঠিক কাজ নয়।
১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলাম অবিভক্ত পাকিস্তানের ঘোষণা দিয়েই থেমে থাকেনি। নিজ ভাই বাঙালিদের বিরুদ্ধেই অস্ত্র ধরেছে পাকিস্তানিদের স্বীকৃত ভাতাপ্রাপ্ত সৈন্যদল হিসেবে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও তারা সেই তাণ্ডবের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেনি।
বাংলাদেশ হওয়ার পর বেশ কয়েকবার তাদের নিষিদ্ধের প্রসঙ্গ আসে। বাহাত্তরের সংবিধানে জামায়াত, নেজামে ইসলাম, মুসলিম লীগসহ ধর্মের নামে যারা রাজনীতি করে এদের প্রত্যেককে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে দেন। গোলাম আযমের নাগরিকত্ব তখন বাতিল করা হয়েছিল, তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার অনুমতি দেয়া হয় এবং ৯১ সাল পর্যন্ত তিনি জামায়াতের আমীর হিসেবে বলবৎ থেকে আন্ডারগ্রাউন্ডে কাজ করেছেন। এরপর বিভিন্ন সময় আ. লীগ এবং বিএনপি জামায়াতের সাথে একসঙ্গে পা ফেলেছে। কেউ এক জোট হয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলন করেছে, আবার কেউ আরেকটু বাড়িয়ে তাদের সঙ্গে সরকার গঠন পর্যন্ত করেছে। মন্ত্রী বানিয়েছে। এ ঘটনা সে সময় ব্যাপক সমালোচিত হয়।
৯২ সাল থেকে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি জামায়াতে ইসলামকে নিষিদ্ধের জন্য আন্দোলন করে আসছে। আমাদের মহান সংসদের কার্যবিবরণীতেও দেখা যায় স্পিকারসহ বিএনপির অনেক সংসদ সদস্য জামায়াত নিষিদ্ধের পক্ষে ছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন বিএনপির বদরুদ্দুজা চৌধুরী। ২০১৩ সালে শাহবাগ থেকে জামায়াত নিষিদ্ধের দাবি তোলা হয় সরকারের কাছে। তখন তারা আইন দেখেছিয়েছে যে, তারা শুধু যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি দিতে পারবে, সংশ্লিষ্ট সংগঠনকে নিষিদ্ধের এখতিয়ার রাখে না। সেই আইন সংশোধন করে সরকারকে আবার নিষিদ্ধের আহ্বান জানিয়েছিল গণজাগরণ মঞ্চ, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। কিন্তু এরপর দীর্ঘ ১০ বছরেও আওয়ামী লীগ তা করেনি। তবে আদালতের রায়ে নির্বাচন কমিশন ২০১৩ সালে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে। জামায়াতের পক্ষ থেকে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর জামায়াতের পক্ষের আপিল খারিজ করে দেয়। ফলে দলটির নিবন্ধন বাতিলের সিদ্ধান্ত বহাল রয়েছে।
সম্প্রতি ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে কোটা আন্দোলনের সহিংসতার জন্য সরকার জামায়াতে ইসলামীকে দুষছে এবং ১৪ দলের বৈঠকে জামায়াত নিষিদ্ধের প্রস্তাবনা উঠে আসে। গত ৩১ জুলাই সরকারের নির্বাহী আদেশে জামাত-শিবির নিষিদ্ধ হবে বলে ঘোষণা করেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। এই নিষিদ্ধের মাধ্যমে সহিংসতা কমবে কিনা এ বিষয়ে সন্দিহান ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা বিভাগের সভাপতি শাহরিয়ার কবির। একটি বেসরকারি চ্যানেলকে তিনি বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামীর অর্থনৈতিক সংগঠনগুলোও নিষিদ্ধ করতে হবে। অন্যথায় তারা ভিন্ন নামে তার কার্যক্রম শুরু করবেই। ইতোমধ্যে তারা বাংলাদেশ ডেভলপমেন্ট পার্টিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক সংগঠন দাঁড় করিয়েয়েছে।’
অপর দিকে বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম মনে করেন, এই মুহূর্তে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। অপরদিকে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও বাসদ মনে করছে, শুধু জামায়াতে ইসলামী নয়, সব ধরনের ধর্মভিত্তিক রাজনীতি আইন করে নিষিদ্ধ করা হোক। একই দাবি তুলেছে উদীচীসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো।
অবশেষে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও দলটির ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ তাদের অঙ্গসংগঠনগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। বৃহস্পতিবার (১ আগস্ট) বিকেলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে দুবার নিষিদ্ধ হলো যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত ধর্মভিত্তিক এই রাজিনৈতিক দল।