বর্তমান বিশ্বে দেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য শক্তিশালী সেনাবাহিনী অপরিহার্য। আমাদের দেশের সেনাসদস্যরা অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত শত্রু থেকে জন্মভূমির সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার পাশাপাশি বর্তমানে আরো অনেক প্রশংসনীয় কাজ করছেন। দেশের বাইরেও তারা প্রশংসিত হচ্ছেন। আন্তর্জাতিক শান্তি মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবস্থান শীর্ষস্থানীয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শান্তির কাজে সর্বোচ্চসংখ্যক সেনা দিয়ে বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়ে আসছে বাংলাদেশ। এর প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও। শান্তিরক্ষা মিশন থেকে অর্জিত আয় বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের তৃতীয় বৃহত্তম খাত। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের এই পথটি যেন বন্ধ হয়ে না যায়, এ বিষয়ে দেশপ্রেমিক জনগণ হিসেবে আমাদের সচেতন হতে হবে।
বাঙালির পরাধীনতা বা অন্যের দ্বারা শোষিত হওয়ার ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। যে কারণে এই ভূমির মানুষের চাকরি ও রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ খুব কমই কপালে জুটেছে। সেই সেন, সুলতানি, মোঘল যে আমল বলি না কেন; বাংলার শাসকরা তেমন কেউ স্থানীয় বাঙালি ছিলেন না। সেই সময়ের শাসক বা রাজাবর্গরা অন্যান্য কর্মচারীদের মত সৈন্যসামন্ত সাথে করে নিয়ে আসত। অর্থাৎ, সেনাবাহিনীতে স্থানীয় বাঙালি যুবকদের সংখ্যা কমই ছিল। পরাধীনতার কারণে এই মাটিতে জন্মগ্রহণ করেও মাতৃভূমির স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং এ দেশের মানুষের সেবার সুযোগ খুব কমই ছিল।
পূর্বপুরুষ অবাঙালি হলেও নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে ‘বাঙালি’ ধরা হয়। জানা যায়, সিরাজউদ্দৌলার বাহিনীতে অনেক বাঙালি সৈন্য ছিল। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন বিশ্বাসঘাতক রাজনৈতিক চক্রান্তকারীদের কারণে পলাশী যুদ্ধে রবার্ট ক্লাইভের মাত্র ৩২০০ সৈন্যের কাছে বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার বাহিনীর পরাজয় ঘটে। সেদিন উচ্চশ্রেণীর লোকেরা, নেতারা— কেউই স্বাধীনতার অর্থ বুঝতে পারেননি। তবে, দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী সাধারণ সেনারা বুঝতে পেরেছিলেন এর মর্ম। তারা বিশ্বাসঘাতকতার ও ষড়যন্ত্রের পরাজয় ও জন্মভূমির এই ক্ষতি মেনে নিতে পারেননি। বিধ্বস্ত সেনারা আবার সংগঠিত হতে থাকে। বক্সারের যুদ্ধসহ অনেক প্রতিরোধ-সংগ্রাম এরপর হয়েছে। কিন্তু তারা সফল হননি। কেননা তাদের রসদ ও সমর্থন দেওয়ার মত কেউ ছিল না। আর গঙ্গার জলও তত দিনে অনেক দূর গড়িয়েছিল। তারপরও বাঙালি সেনাসদস্যরা বিভিন্ন বিপ্লবী সংগ্রাম-আন্দোলন ও বিদ্রোহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
বাঙালি যুবকরা এক সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে কাজ করে তাদের সততা ও যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন। আমাদের জাতীয় কবি, বিদ্রোহী কবি, সাম্যের কবি কাজী নজরুল ইসলামও ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে কাজ করেছেন। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে কাজ করলেও যুবকরা স্বদেশের স্বাধীনতার কথা ভুলে যাননি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ইংরেজরা বলেছিল ‘তোমরা আমাদের জন্য যুদ্ধ কর, আমাদের সহযোগিতা কর, আমরা বিজয়ী হলে তোমাদের স্বাধীনতা দেব’। দেশীয় সেনারা ইংরেজদের পক্ষে প্রাণপণ যুদ্ধ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ৭৪ হাজার ভারতীয় সৈন্য মারা গিয়েছিল, ৬৭ হাজার আহত এবং ১০ হাজার নিখোঁজ হয়েছিল। যাদের মধ্যে অনেক বাঙালি ছিল। কিন্তু ইংরেজরা কথা রাখেনি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইংরেজরা আবার একই কথা বলেছিল। তবে তখন ইংরেজদের পূর্বের ওয়াদা না ভুলে বিষয়টি পাকাপাকি করে নেওয়া হয়েছিল। ইতালি, জার্মানি, মিয়ানমার, সিঙ্গাপুর, হংকংয়ে বীরত্বের স্বাক্ষর রেখেছিলেন ভারতীয় সেনারা। ৮৭ হাজারেরও বেশি ভারতীয় সেনা বিদেশের মাটিতে প্রাণ দিয়েছেন। যাদের মধ্যে অনেক বাঙালি ছিলেন। প্রাক্তন ব্রিটিশ কমান্ডার ও ফিল্ড মার্শাল স্যর ক্লদ অচিনলেক বলেছিলেন, ব্রিটেন দু’দুটো বিশ্বযুদ্ধ সামলাতেই পারত না যদি ভারতীয় সেনা সঙ্গে না থাকত। সেই সেনার স্থান এখন ভারতের ইতিহাসে লেখা রয়েছে। মিশর ও প্যালেস্টাইনেও প্রাণ দিয়েছিলেন বহু ভারতীয় সৈন্য।
সংখ্যায় কম হলেও পাকিস্তান সেনাবাহিনীতেও বাঙালি ছিল। দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্র বাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। ২৫ মার্চের কালরাতে বাঙালি নিধন শুরু হলে, পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান ও প্রথম টার্গেট ছিল তাদেরই বাঙালি সহকর্মীরা সেনারা। যারা পালাতে পারেনি তাদের নির্মম পরিণতির শিকার হতে হয় সেদিন। যেসব বাঙালি সেনা পালিয়ে এসেছিলেন, তারা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। নয় মাসের রক্ত ঝরানো যুদ্ধের পর পৃথিবীর মানচিত্রে বাঙালি পায় নিজের ঠিকানা- একটি স্বাধীন ভূখণ্ড ‘বাংলাদেশ’। মুক্তিবাহিনীর অধিকাংশ সদস্যদের তেমন সামরিক প্রশিক্ষণ ছিল না। মূলত সেনাবাহিনীর এই সদস্যরাই যুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে যায়। তা না হলে পাকিস্তানের মতো চৌকস বাহিনীকে পরাজিত করা সম্ভব হতো না। স্বাধীনতার পর সেনাবাহিনী যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠনেও ভূমিকা পালন করে।
দেশ ও জাতির বিভিন্ন প্রয়োজনে আমাদের সেনাদের বিভিন্ন ধরনের ভূমিকা পালন করতে হয়েছে। দেশের সব প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। সংকট মোকাবিলায় সবসময় ঝাঁপিয়ে পড়েছে। দেশের ও জাতীয় স্বার্থে সুষ্ঠু ভোটার তালিকা প্রণয়ন, জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি-বিতরণ, ভিজিডি কার্ড বিতরণ, টিআরকাবিখার হরিলুট বন্ধে ব্যবস্থা, ওয়াসার পানি বণ্টন, ট্রাফিক যানজট নিরসন, চট্টগ্রামের পাহাড় ধস, জনদুর্ভোগ নিরসনে ত্বরিত কালভার্ট, সেতু, রাস্তা নির্মাণ, রানা প্লাজা ও র্যাংগস ভবনসহ শিল্প কারখানার আগুন নির্বাপণে, ৮৮, ৯১ এর সর্বগ্রাসী সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো, গোর্কির তাণ্ডব, উড়িরচরে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও মহাপ্লাবনে যখন সারা দেশ ক্ষতিগ্রস্ত, লণ্ডভণ্ড ও বিপর্যস্ত হয়, সেই সময় দুর্দশাগ্রস্ত দুর্গতের পাশে দাঁড়িয়েছে আমাদের সেনাবাহিনী। দেশ গঠনমূলক কাজে সেনাবাহিনীর অবদান অপরিসীম। বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প যেমন পদ্মাসেতু রেল সংযোগ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, হাতিরঝিল উন্নয়ন প্রকল্প, মহীপাল ফ্লাইওভার, কক্সবাজার টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ, সীমান্ত সড়ক প্রকল্প, খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে দেশের উন্নয়নেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে সেনাবাহিনী।
এ ছাড়াও, পার্বত্য চট্টগ্রামে যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্প্রসারণে সেনাবাহিনী প্রচুর পরিমাণ রাস্তা এবং কালভার্ট নির্মাণ করেছে, যা এই অঞ্চলে আর্থসামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের পর্যটনশিল্পে ব্যাপক অবদান রেখেছে। মাত্র বছরখানেক আগেও মহামারি করোনা মোকাবিলায় সেনাবাহিনী যেভাবে দেশের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল তা ভুলবার নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্রোহের প্রাদুর্ভাবের সময়, বাংলাদেশ সরকার সিআইও-এর জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন করে। যুদ্ধের প্রক্রিয়ায় অনেক অফিসার এবং সদস্যবৃন্দ তাদের দেশপ্রেমের জন্য মূল্যবান জীবন উৎসর্গ করেছেন, যা দক্ষিণ এশিয়ায় দৃষ্টান্তমূলক কাউন্টার ইনসার্জেন্সি সংঘাতের অবসান ঘটিয়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের পরও তারা ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম অনেক দেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে জাপানের ভয়াবহ সুনামি ও ভূমিকম্পের পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা সে দেশে জরুরি সহায়তা প্রদানসহ শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মায়ানমার, চীন, মিশর, মালদ্বীপ ও হাইতিতে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দক্ষতার সঙ্গে দুর্যোগ মোকাবিলা করে বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে।
একই আকাশ, বাতাস, মাটি, পথঘাট, বাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, বলতে গেলে একই সংসার। ঘুমানোর আগে যেমন আমাদের দেখা হয়, হচ্ছে, আবার রাত পোহালেই আবার সেই একই মুখ। কিন্তু জাতি দ্বিধাবিভক্ত। কেউ কাউকে যেন আর সহ্য করতে পারছে না। কেউ কাউকে বিশ্বাস করেতে পারছে না। একে-অপরকে স্তব্ধ করতে মরিয়া। রাজনৈতিক সমঝোতার কোনও লক্ষণ নেই। আতঙ্কিত সাধারণ মানুষ। ধ্বংসের পথে দেশের অর্থনীতি। কোটা সংস্কার ঘিরে সংঘাত চলছেই। শুধু রাজধানী নয়, দেশজুড়ে সহিংসতায় ঝড়েছে অসংখ্য মূল্যবান প্রাণ। অনেক মায়ের বুক খালি হয়েছে, আহত অসংখ্য! হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি! এমন অবস্থাতেও জনমানুষের ভরসাস্থল হয়ে ওঠে আমাদের সেনারা। এই সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতেও আমরা এ কথার প্রমাণ আবার পেয়েছি। প্রকৃতপক্ষে দেশব্যাপী ক্রম অবনতিশীল নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে জনসাধারণের জানমাল ও সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার সার্বিক নিরাপত্তা প্রদানে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হলে তারা সে দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করছে। সহিংসতা নিরসনে ও জনমনে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করছে দেশপ্রেমিক সেনারা। দেশের সব ধরনের মানুষও তাদের ওপর যথেষ্ট সন্তুষ্ট এবং আস্থাশীল।
বিভিন্ন স্থানে দেখা গেছে সেনাবাহিনী সদস্যদের অবস্থানের কারণে সাধারণ মানুষ ও ছাত্ররা নিজেদের নিরাপদ মনে করছে। এক কথায়, বেসরকারি প্রশাসনকে সহযোগিতার জন্য মাঠে নেমে ধ্বংসলীলা ও মৃত্যুর মিছিল বন্ধ করার সক্ষমতা দেখিয়েছে সেনাবাহিনী। কেবল জনজীবন ও জানমালের নিরাপত্তা বিধানে কাজ করেছে তারা। এমন অবস্থায় একটি অপশক্তি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অবাস্তব, অসত্য, বানোয়াট ও কুরুচিপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত ফেসবুক, এক্স (সাবেক টুইটার) ও ইউটিউবের মাধ্যমে ছড়িয়েছে। বিভিন্ন বিদেশি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এই মিথ্যা ও বিভ্রান্তিমূলক অপপ্রচার চালানো হয়েছে। বিষয়টি সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্র বাহিনীর ইমেজকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপতৎপরতা ছাড়া কিছুই নয়। বিষয়টি নিয়ে আমাদের সবার সজাগ থাকা উচিত। একই সঙ্গে অপপ্রচার মোকাবিলায় মিডিয়ার কার্যকর অবদান রাখাও জরুরি।
বর্তমান বিশ্বে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য শক্তিশালী সেনাবাহিনী অপরিহার্য। বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশের সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্রবাহিনী অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে পেশাদার ও বিশ্বমানের। নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে তারা দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতীক হয়ে আছেন। এ কারণে আমাদের গর্বের সেনাবাহিনীকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সব ষড়যন্ত্র আর অপপ্রচার ছিন্ন করে দেশ, রাষ্ট্র ও জাতির কল্যাণে তারা তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য অতীতের মতো সঠিকভাবে পালন করবে- এ বিশ্বাস আমাদের আছে। ‘সমরে আমরা, শান্তিতে আমরা, সর্বত্র আমরা দেশের তরে’ এই বাক্য অটুট থাকুক- এটাই জাতির প্রত্যাশা।