মতামত

প্রয়োজন শিক্ষাঙ্গনের সংস্কার 

সবসময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকেই দেশের মানুষের নজর থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরেই আলোচনা-সমালোচনা জাতির দৈনন্দিন আলাপচারিতার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। আলোচনার বাইরে থেকে যায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর কথা। অথচ সুশিক্ষিত, সুনাগরিক গড়ে তোলার জন্য এসব জায়গাতেই নজর থাকা প্রয়োজন ছিল। আমরা ভুলে গিয়েছি- শিক্ষার মূল ভিত্তি তৈরি হয় এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। শিশুদের মানসিক ও চিন্তার বিকাশ  ঘটে এখান  থেকেই। মানুষের জ্ঞান ও নৈতিকতার প্রথম পাঠ পরিবারের পর বিদ্যালয়েই সূচিত হয়। যে কারণে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর প্রতি আমাদের দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংস্কার কাজও দ্রুত শুরু হওয়া উচিত। 

ঔপনিবেশিক কাঠামোয় আবদ্ধ এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটি দ্বারা দীর্ঘদিন ধরে পরিচালিত হয়ে আসছে। ম্যানেজিং কমিটি গঠিত হয় স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা কিংবা পেশি শক্তির অধিকারী লোকজনদের মাধ্যমে। এদের অধিকাংশের শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং শিক্ষাঙ্গন সম্পৃক্ত জ্ঞান প্রশ্নবিদ্ধ। ফলে বিদ্যালয় ঘিরে তাদের কর্মকাণ্ড অনেক সময়ই সমালোচিত হয়। 

নিয়োগ দুর্নীতি, ভর্তি বাণিজ্য ও বিদ্যালয় তহবিল থেকে শুরু করে নানা ধরনের প্রকল্পের অর্থ লুটপাটে এদের জড়াতে দেখা যায়। বলাবাহুল্য, শহর থেকে গ্রামে, সবখানেই এ চিত্র কম-বেশি দেখা যায়। শিক্ষার উন্নয়নে ম্যানেজিং কমিটির ভূমিকা শূন্য বললে ভুল হবে না। শুধু যে ম্যানেজিং কমিটি বা শিক্ষকগণ এসবের জন্য দায়ি, বিষয়টি এমনও নয়। এ জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও কর্মকর্তারাও সমভাবে দায়ি। বিদ্যালয়গুলো নিয়ে তাদের উদাসি মনোভাব, নিয়মিত মনিটরিং না করা এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনিয়ন্ত্রিত দুর্নীতি এমন পরিস্থিতি সৃষ্টির দায় এড়াতে পারে না। মোটাদাগে কোথাও কোনো জবাবদিহিতা না থাকায় শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ আজ নাজুক।  

সাম্প্রতিক সময়ে সরকার দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি বাতিল করেছে। শুধু বাতিল করলেই হবে না, বিদ্যালয়গুলোয় শৃঙ্খলা আনয়ন ও গুণগত মান রক্ষায় নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সেই সঙ্গে সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠীর অপতৎপরতায় শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য করার চেষ্টা রুখে দেওয়া প্রয়োজন। ইতোমধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পদত্যাগের জন্য বল প্রয়োগ না করার আহ্বান জানিয়েছেন শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা। তিনি বলেছেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পদে যারা দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের কারও বিরুদ্ধে ন্যায়সংগত অভিযোগ থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নতুন করে পদায়ন ও নিয়োগের কার্যক্রম চলছে। জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করে অস্থিরতা সৃষ্টি করলে প্রশাসন ভেঙে পড়তে পারে। 

বর্তমানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নানা কারণে প্রশ্নবিদ্ধ। রাজধানীর অনেক নামকরা স্কুলও এ তালিকায় রয়েছে। এ অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার যে, এসব নিয়ে ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক— কারও মাথাব্যথা আছে কিনা সন্দেহ। শিক্ষাঙ্গনে আনন্দ নেই। নিরানন্দ শিক্ষাব্যবস্থায় সদ্যবিদায়ী শেখ হাসিনা সরকার যে কারিকুলাম প্রণয়ন করেছিলেন, তার বাস্তবায়ন নিয়েও সমালোচনা কম নয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা আওয়ামী সরকারের নতুন শিক্ষানীতি থেকে পূর্বের শিক্ষা ব্যবস্থায় ফেরার ইঙ্গিত দিয়েছেন। 

আমরা জানি, পূর্বের শিক্ষাপদ্ধতি অনেক পুরোনো। আশির দশক থেকেই এই শিক্ষা ব্যবস্থায় কোচিং সেন্টার, প্রাইভেট, গাইড-বই ইত্যাদির ব্যাপক প্রসার ঘটে। শিক্ষকরা মুনাফালোভী হয়ে শ্রেণিকক্ষের পাঠদান বাদ দিয়ে ঝুঁকে পড়েছিলেন শিক্ষা ব্যবসায়। পরীক্ষার ফল ভালো করানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত সবাই। সুকুমারবৃত্তির চর্চা, বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা, কারিগরি ও উদ্ভাবনী জ্ঞান ও সৃজনশীলতা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই সময়।  এর ফলে আমরা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে খ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে আশানুরূপ ফল পাইনি।  গবেষণা ও নতুন জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ ও উদ্ভাবন হয়নি বললেই চলে। তাই রাষ্ট্রচিন্তক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের মতে ‘শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে পুনর্গঠিত করতে হবে যেন— (ক)সারা দেশে বিভিন্ন ধারার পেশামূলক শিক্ষার মাধ্যমে বৃহত্তমসংখ্যক যোগ্য, দক্ষ, উৎপাদনক্ষম, উন্নত-চরিত্রবলসম্পন্ন কর্মী সৃষ্টি হয়; (খ) শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে শক্তিমান রাষ্ট্ররূপে বাংলাদেশকে গড়ে তোলার ও ভালোভাবে পরিচালনা করার উপযোগী শিক্ষিত লোক তৈরি হয়; অধিকন্তু (গ) দর্শন,  বিজ্ঞান,  ইতিহাস,  শিল্প-সাহিত্য, প্রযুক্তি ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রকৃত জ্ঞানী ও সৃষ্টিশীল ব্যক্তিদের আত্মপ্রকাশের সুযোগ সৃষ্টি হয়’। একই সঙ্গে জরুরিভাবে প্রয়োজন শিশু-কিশোরদের মনস্তত্ত্ব বোধগম্য শিক্ষক সমাজ। যারা হবেন উচ্চ শিক্ষিত ও ডিগ্রিধারী। তাদের বেতন কাঠামোও হবে যোগ্যতা ও  মূল্যায়নের ভিত্তিতে। 

এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কারের দাবি দীর্ঘদিনের। শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা এ জন্য প্রথমে ‘সর্বজনীন কল্যাণে বিবেকবান চিন্তাশীল ব্যক্তিদের দূরদর্শী চিন্তাভাবনা, আলোচনা-সমালোচনা ও বিচার-বিবেচনা’কে আমলে নেওয়ার কথা বলছেন। তাদের মতে, ‘শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিত, সে সম্পর্কে ধারণা যদি সঠিক হয়, তাহলে সেই লক্ষ্যে পর্যায়ক্রমে সমাধানযোগ্য উদ্যোগ গ্রহণ করা যাবে‌’। 

তথ্যপ্রযুক্তির দুনিয়ায় নৈতিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক লক্ষ্য ও যাত্রাপথ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা তৈরি করে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে সামনে অগ্রসর হওয়া সময়ের দাবি। শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের সঙ্গে বিদ্যালয়গুলো সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাঠামো ঢেলে সাজানো থেকে শুরু করে মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ এবং তার শতভাগ বাস্তবায়নে জোর তৎপরতা চালিয়ে যেতে হবে। শ্রেণিকক্ষে পাঠদান সমুন্নত রাখতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষার্থী ভর্তি সুষম করা প্রয়োজন। আমাদের দেশে এমন কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেসব প্রতিষ্ঠানে একেবারেই শিক্ষার্থী সংখ্যা কম। আবার কোনো কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধারণ ক্ষমতার অধিক শিক্ষার্থী রয়েছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করে এলাকাভিত্তিক ভর্তি ব্যবস্থায় সুনির্দিষ্টসখ্যক আসন রাখা আবশ্যক। 

শহর থেকে গ্রাম, সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সমান সুযোগ-সুবিধা ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতে ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক, প্রশাসন ও সচেতন সমাজের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার পরিবেশ উন্নয়নে দরকার— (১) শিক্ষকদের কোচিং ও প্রাইভেট বন্ধ করে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান নিশ্চিত করা এবং শিক্ষকদের শিক্ষাদানে উদ্যোমী করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।  (২) বিদ্যালয়গুলোয় কম্পিউটার ও সায়েন্স ল্যাব নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রয়োজন ল্যাব ব্যবহার অব্যাহত রাখা‌ । (৩) বিদ্যালয়ে ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক চর্চার জন্য নিয়মিতভাবে ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা উচিত। দরকার ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক দল গঠন এবং নিয়মিত এসবের চর্চা অব্যাহত রাখা। (৪) শিক্ষার্থীদের শৃঙ্খলাবোধ তৈরিতে বিদ্যালয়গুলোয় বিএনসিসি/স্কাউটের কার্যক্রম প্রসারিত করা প্রয়োজন। (৫) ছাত্র ও শিক্ষকদের পাঠ অভ্যাস তৈরিতে বিদ্যালয়ে পাঠাগার চালু করা ও বই পাঠে আগ্রহী করতে উদ্দীপনামূলক উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। (৬) বিদ্যালয়গুলোর নেতৃত্ব ও শৃঙ্খলার জন্য ক্লাস ক্যাপ্টেন নির্বাচন এবং ক্লাস ক্যাপ্টেনদের সমন্বয়ে স্টুডেন্ট কাউন্সিল গঠন করা দরকার। (৭) শিক্ষার্থীদের মাদকসেবন ও বিভিন্ন কিশোর অপরাধ থেকে মুক্ত রাখতে ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক ও প্রশাসনের সমন্বয়ে ‘কিশোর উন্নয়ন’ সেল গঠন করা প্রয়োজন। যা শিক্ষার্থীদের নৈতিক ও অপরাধমুক্ত রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। 

বিদ্যালয়গুলো সংস্কারে এভাবে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। যার ফলে শিক্ষার উন্নয়নের পাশাপাশি আমাদের সামাজিক উন্নয়নের পথটাও প্রশস্ত হবে। সর্বোপরী আমাদের শিক্ষাঙ্গনের সংস্কার শুরুর এখনই সময়।   

লেখক : কবি