স্বাধীনতার ৫৩ বছরে অনেক গণআন্দোলন হয়েছে। বন্দুকের নলের সামনে আগে কাউকে কখনও এমন বুক টান করে দাঁড়াতে দেখা যায়নি। শুনেছি, পড়েছি কিন্তু চোখে দেখিনি। এই প্রথম দেখলাম আবু সাঈদের বুক পেতে দেওয়া! হালকা গড়ন, পরনে কালো গোল-গলা টি-শার্ট আর ধূসর ট্রাউজার্স, রাষ্ট্র যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে দুটো হাত আড়াআড়ি করে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সে তো কোন অপরাধ করিনি, কাউকে আক্রমণ করিনি, তবুও নির্মম বুলেট তাকে বিদ্ধ করল ক্রমাগত। মাত্র কয়েক সেকেন্ডে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, জীবন নিঃশেষিত হয়ে গেল, শহিদ হলেন। একজন নিরস্ত্র মানুষের বুক, মাথা, পেট লক্ষ্য করে কেন গুলি করা হবে? একটা পাখিকেও কি এভাবে গুলি করা যায়! শহিদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ। ‘ভাই পানি লাগবে কারও, পানি’ মুগ্ধের এ কথাটি এদেশের মানুষকে সারা জীবন কাঁদাবে। খাবার পানি আর বিস্কুট বিতরণের সময় একটি গুলি তার কপাল ভেদ করে কানের পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়, লুটিয়ে পড়ে রাস্তায়। মুগ্ধ’র রক্তে যখন রাস্তা ভেসে যাচ্ছিল, তখন তার বন্ধুরা বহু সংগ্রাম করেও সাথে সাথে তাকে হাসপাতালে নিতে পারেননি। এক সময় হাসপাতালে নেওয়া হলে ডাক্তাররা বলে তার প্রাণ আগেই বেরিয়ে গিয়েছে। স্বাস্থ্য উপদেষ্টার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কোটা আন্দোলনকে ঘিরে প্রায় এক হাজার লোক নিহত হয়েছে। নিহতদের বেশির ভাগ ছাত্র, চাকরিপ্রত্যাশী, তরুণ ও শিশু-কিশোর। প্রতিটি মৃত্যই যেন এক একটা শোক গাঁথা। শুধু দেশবাসী নয় পুরো বিশ্ববাসীও হতবাক ও বিস্মিত হয়েছে। মনে করিয়ে দিয়েছে, পঁয়ত্রিশ বছর আগের তিয়েনানমেন স্কোয়্যার। কথিত আছে ট্যাঙ্ক দিয়ে পিষে মারা হয়েছিল কয়েক হাজার ছাত্রকে। কীভাবে বাংলাদেশে বুলেট এত সস্তা হয়ে গেল, এটাই সবার প্রশ্ন। সাভারের আশুলিয়াসহ বিভিন্ন জায়গার হত্যাকাণ্ডের ভিডিও প্রকাশ হচ্ছে। যেগুলো দেখে মানুষ বাকরুদ্ধ, অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের সন্তান, এ দেশেরই মানুষ, আজ এই স্বপ্নের পৃথিবীতে নেই! তাও আবার তরুণ-শিশু-কিশোর, তাদের নিয়ে মা-বাবার, এ জাতির কত স্বপ্ন ছিল! তারা একটা দাবি করেছিল। যৌক্তিকতা বিবেচনা করে আগেই সমাধানের পথ ছিল, কেন বুলেট দিয়ে জবাব দিতে হবে?
বাঙালির পরাধীনতা বা অন্যের দ্বারা শোষিত হওয়ার ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। যে কারণে চাকরিসহ ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা খুব কমই কপালে জুটেছে। আশা করা হয়েছিল, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর বাঙালিরা তাদের দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, কোনও বৈষম্য থাকবে না, সবাই সমান সুযোগ-সুবিধা পাবে। কিন্তু কিছু লোক তাদের সুবিধাবাদী চরিত্র বদলানোর পরিবর্তে আরও চরম আকারে চর্চা শুরু করে।
আবু সাঈদ রংপুরের নীলগঞ্জ উপজেলার এক অজপারা গায়ের ছেলে। অর্থাভাবে দিনমজুরের ছেলের লেখাপড়া হওয়া দুঃসাধ্যই ছিল। স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন নিজের প্রিয় বিষয় ইংরেজি নিয়ে। টিউশনি করে নিজের পড়ার খরচ চালাতেন। আবু সাঈদ সারা বাংলাদেশের প্রতীক, গুটি কয়েক পরিবার ছাড়া প্রায় সবার অবস্থা আবু সাঈদের মত। এ দেশের লাখো শিক্ষার্থী কোনও না কোনও কষ্ট স্বীকার করে পড়াশুনা চালিয়ে যায়, একটি চাকরির আশায়, স্বপ্নের বাংলাদেশ গঠনের আশায়। দেশে চাকরির বাজারের শিক্ষিত তরুণদের অবস্থা যে খুব ভালো না সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। হু হু করে বেড়ে চলেছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা। চাকরি নামক সোনার হরিণের পেছনে ছুটতে ছুটতে তারা হতাশায়। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর স্বচ্ছ ও প্রশ্নহীন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে না পারাটাই জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। শিক্ষার্থীদের পড়াশুনা শেষ করে চাকরির জন্য ‘লাইনঘাট, ‘সিস্টেম’ আর ‘মামু খালুর’ সন্ধানে ব্যস্ত থাকতে হয়।
সম্প্রতি পিএসসির সাবেক এক চেয়ারম্যানের বেরসিক গাড়িচালক আবেদ আলীসহ অন্যান্য কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের কর্মকাণ্ড জাতিকে হতাশ করছে। আসলে পিএসসিতে কী হয়, কয়টা পরীক্ষা ফেয়ার হয়েছে তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। শুধু পিএসসি নয়, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ নিয়েও সবার একই প্রশ্ন। দেশব্যাপী সরকারি নিয়োগ নিয়ে গড়ে উঠে ছিল বিভিন্ন ধরনের চক্র বা সিন্ডিকেট। নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া যেন সাধারণ ব্যাপার। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালের নিয়মিত পরীক্ষা ও ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র হয়েছে। বছরের পর বছর ফাঁস হয়েছে ইঞ্জিয়ারিং ও মেডিক্যাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র। সরকারি চাকরি সীমিত, সবাই পাবে এমন হতে পারে না। তবে এমন একটা স্বচ্ছ ও প্রশ্নহীন ব্যবস্থার প্রয়োজন ছিল যার ওপর তরুণরা আস্থা স্থাপন করতে পারে। পড়াশুনা বা যোগ্যতা থাকলে চাকরি হবে, তা না হলে নয়, এমনটাই জাতির জন্য কল্যাণকর।
শুধু নিয়োগ প্রতিষ্ঠান নয়, দেশের সব প্রতিষ্ঠানগুলো যেন ধ্বংস হতে বসে ছিল। কোন প্রতিষ্ঠানের ওপর এদেশের মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস ছিল না। পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, নির্বাচন কমিশন সবখানে একই অবস্থা। একের পর এক প্রসহনের, ভোটারবিহীন, রাতের পাতানো নির্বাচন। স্থানীয় সরকারসহ সব নির্বাচন চলে গিয়ে ছিল পেশি শক্তি আর সিন্ডিকেটের দখলে। বিগত দিনে লক্ষণীয়, কিছু মানুষের মধ্যে এক ধরনের উন্মাদনা কাজ করছে, কীভাবে দ্রুত সময়ে অঢেল ধনসম্পদ ও টাকা-পয়সার মালিক হওয়া যায়। যেন টাকাই সব কিছুর মানদণ্ড। ব্লুমবার্গ, পানামা পেপারস ও প্যান্ডোরা পেপারস, গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই), ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির ন্যায় বিভিন্ন সংস্থা ও দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম যখন কিছুদিন পর পর কিছু মানুষের অবৈধ ধন-সম্পদ ও অর্থপাচারের রিপোর্ট বা খবর প্রকাশ করেছে। কিন্তু আ.লীগের সরকার বিষয়টি থামানোর চেষ্টা না করে বরং পৃষ্টপোষকতা করেছে।
পৃথিবীর অনেক দেশে দুর্নীতি, লুটপাট ও অপকর্ম রয়েছে। কিন্তু, আমাদের দেশ অপকর্ম-দুর্নীতি একটা অস্বাভাবিক পর্যায়ে চলে যায়। বেনজীর, হারুন-অর-রশীদের মত সরকারি কর্মকর্তারা এত সম্পদ বানালো, যার বর্ণনা দিতে একেক জনের জন্য বই ছাপানোর প্রয়োজন পড়ে। হাজার বিঘার ওপরে ভূমি, দেশে-বিদেশে অসংখ্য ফ্ল্যাট, প্লট, অ্যাপার্টমেন্ট, দেশে-বিদেশের ব্যাংক ও কোম্পানিতে হাজার হাজার কোটি টাকা প্রভৃতি। অনেকে টাকা পাচারের জন্য নিজেরাই চালু করে মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান। এস আলম গ্রপ, সালমান এফ রহমান এত কাণ্ড ঘটাল কিন্তু আ.লীগ সরকার আগে কেন টের পেল না? তাকসিম এ খান একাই ১৫ বছরে লুটে নিয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। আজিজ কাণ্ড, পি কে হালদার কাণ্ড, হলমার্ক কেলেঙ্কারি একের পর এক ঘটনা ঘটেছে।
অনেকের মতে, এগুলোর জন্য দায়ী মূলত দেশে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব ও সংসদে সত্যিকার অর্থে কোন বিরোধী দল না থাকা। এক পর্যায়ে আ.লীগ একগুঁয়েমি স্বৈরাচারী দলে পরিণত হয়ে যায় এবং সম্পূর্ণভাবে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। কার্যকর সংসদ ও বিরোধী দল থাকলে এমনটা নাও হতে পারত। এটাই এদেশের বাস্তবতা যে, ক্ষমতাসীন বা দলীয় সরকারের অধীনে কোনও জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয় না এবং কোনদিন হয়ওনি। এক সময় আ.লীগ ও জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য ব্যাপক আন্দোলন সংগ্রাম করেছিল। প্রাণহানি, আহত ও জেল-জুলুমের মত অনেক ঘটনা ঘটার পর বিএনপি ১৯৯৬ সালে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার আইন পাশ করে। তবে বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে তেমন অতীত অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে ২০০১ ও ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন নিয়ে অসন্তোষ দেখা যায়। তবে ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়ে ছিল এবং শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়ে ছিল, এ বিষয়ে কারোর দ্বিমত থাকার কথা নয়। ২০০৮ সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেই শেখ হাসিনা ত্রুটি দেখিয়ে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের উদ্যোগ নেয়। ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ের ওপর ভর করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এটা বাতিল হল। বিরোধী দলগুলো অনেক প্রতিবাদ আন্দোলন সংগ্রাম করে ছিল কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। সুশীল সমাজ ও আ.লীগের অনেক সিনিয়র নেতারাও অসন্তোষ প্রকাশ করে ছিল, সেটাও কাজ হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া পরপর তিনটি নির্বাচন (২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪) নিয়ে অনেক বিতর্ক ও প্রশ্ন ছিল। নির্বাচনগুলো ছিল মূলত রাজনৈতিক কৌশলে ছলে-বলে-কলে-কৌশলে ক্ষমতায় থাকার কৌশল। অনেক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, আ.লীগের উচিত ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার দুর্বলতাগুলো দূর করে এটাকে আরও শক্তিশালী করা। এ ফলে দেশে ৫ বছর পর পর সুষ্ঠু নির্বাচন আর ক্ষমতা হস্তান্তরের একটা ভাল পরিবেশ বজায় থাকত। আর এখন কী হলো, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটা নির্বাচন দিল আর অন্য দলেরা ক্ষমতায় আসল। অন্যদিকে, সংবিধান পরিবর্তন হল না, সেক্ষেত্রে আ.লীগকে তাদের প্রণয়ন করা ব্যবস্থা অর্থাৎ দলীয় সরকাররের অধীনে কি জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে? আ.লীগ তখন কোনও ইস্যু নিয়ে আন্দোলন করে সেটাই দেখার বিষয়? তারা কি বিপ্লব-সহিংসতা-অসন্তোষ-অরাজকতার পথ বেছে নেবে? এমন অবস্থা সবাই করলে বা বার বার ঘটতে থাকলে দেশে সব সময় অরাজকতা ও অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করবে। বাংলাদেশ ধীরে ধীরে একটি সংঘাতময় ও অকার্যকর রাষ্ট্রের দিকে চলে যাবে।
কোটা আন্দোলনের সময় একটা বিষয় লক্ষণীয়, ব্যাপকহারে ছাত্র, তরুণ, চাকরিপ্রত্যাশী, শিশুকিশোর ও সাধারণ মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের পাশাপাশি ব্যাপকহারে মাদ্রাসা ও হাই স্কুলের ছাত্ররা অংশগ্রহণ করে। এমনকি, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা মাঠে না নামলেও তারা সবাই জানত এবং বাসা থেকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।
ছাত্র, চাকরিপ্রত্যাশী, তরুণ ও শিশু-কিশোরা প্রাণ দিয়েছে, আমরা তাদের কাছে আজ চিরঋণী। যারা শহিদ হয়েছে, তাদের আমরা আর ফিরে পাব না। এসব হত্যাকাণ্ডের বিচারের পাশাপাশি তাদের ঋণ আমাদের পরিশোধ করতে হবে তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের মাধ্যমে। ছাত্ররা দীর্ঘকাল রাজপথে থাকবে না এবং এমনটাও আশা করাও ঠিক নয়, তাদের পড়াশুনায় ফিরে যেতে হবে। তবে অতীবও দুঃখের বিষয়, বাতাসে এখনও লাশের গন্ধ আছে, কবরের মাটি এখনও শুকায়নি। সরকার এখনও গুছিয়ে উঠতে পারেনি এমন অবস্থায় বিভিন্ন স্থানে কিছু লোক চাঁদাবাজি, লুটপাট ও মাঠ-ঘাট দখলের চেষ্টা করছে। কেউ কেউ নীরবে, নিভৃতে প্রশাসন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব জায়গায় নিজেদের লোক বসানোর কাজে ব্যস্ত। অনেকে অবৈধ আয়ের খাতগুলো দখলে নিচ্ছে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, বিপ্লবের পর একটা প্রতিবিপ্লবের বিষয় আছে। পরাজিত শক্তি বিপ্লব ব্যর্থ করার জন্য গুজব ছড়িয়ে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করার চেষ্টা করে, মরিয়া হয়ে ওঠে। দেশে দেশে বিপ্লবের পর বারবার এমনটাই ঘটেছে। বিপ্লবের পর রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। তাছাড়া একটা কথা প্রচলিত আছে, আবেগের নৌকা অল্প সময়েই তলিয়ে যায়। মানুষ প্রচণ্ড আশা নিয়ে বিপ্লব করে আর এই আশা যখন পূরণ না হয় তখন আবার প্রতিবিপ্লবের সম্ভাবনা দেখা যায়। এই বিপ্লব আবার যেন অন্যদিকে না যায় বা বেহাত না হয়, সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। পৃথিবীর বহু দেশের বিপ্লব বেহাত হওয়ার নজির আছে।
লক্ষণীয় যে, অবিস্মরণীয় গণঅভ্যুত্থানের পর কতিপয় ব্যক্তি সামাজিক মাধ্যমে দেশের জাতীয় পতাকা ও সঙ্গীতসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখে ও বক্তব্য দিয়ে দেশে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। এসব বিষয় নিয়ে সরকার ও ছাত্রজনতাকে সজাগ থাকতে হবে। ১৯৭১ সালে এই ছাত্রজনতা, এদেশের মানুষ জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। নয় মাসের রক্ত ঝরানো যুদ্ধের পর পৃথিবীর মানচিত্রে আমরা পেয়েছি নিজের ঠিকানা, একটি স্বাধীন ভূখণ্ড ‘বাংলাদেশ’। কোনও কিছু প্রাপ্তির আশায় নয় বরং দেশের জন্য, দেশের মানুষকে ভালোবেসে, বৈষম্যহীন সমাজ উপহার দেওয়ার জন্য সেদিন সবাই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত সেই স্বাধীনতার সুফল পাওয়ার জন্য ২০২৪ সালে আবার রক্ত ঝরাতে হল।
দেশের এমন টালমাটাল অবস্থায় হাল ধরেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। অনেক জায়গায় সংস্কারের প্রয়োজন আছে। পুলিশ প্রশাসনসহ সব প্রশাসনকে জনবান্ধব করা প্রয়োজন। সব ধরনের তদবির, ঘুষ, স্বজনপ্রীতি, তোষামোদ ও সুপারিশকে না করার সংস্কৃতি ও শক্ত মেকানিজম গড়ে তোলা আবশ্যক। তবে, এমনটা নয় ড. মুহাম্মদ ইউনূস আমাদের সব কিছু ঠিক করে দিয়ে যাবেন বা রাতারাতি সব ঠিক হয়ে যাবে। তিনি হয়ত শুরুটা করে যাবেন, বিষয়টি নির্ভর করবে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার ও আমাদের সবার কর্মকাণ্ডের উপর।
স্বচ্ছ প্রতিষ্ঠান না গড়ে, সুস্থ গণতন্ত্র চর্চা না করে, দেশে অসন্তোষ রেখে উন্নয়ন করলে তা কখনও টেকসই হয় না। জনতার বিক্ষোভের প্রবল আঘাতে এক সময় তাসের ঘরের মত ভেস্তে যায়, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
বাংলা ও বাঙালির রাজনৈতিক চরিত্র নিয়ে ১৫৭৯ সালে মোঘল সম্রাট আকবরের প্রধান উপদেষ্টা আবুল ফজল আল্লামি লিখে ছিলেন, ‘স্নায়ু বিকলকারী আবহাওয়া মানুষকে কলুষিত করে ও কলুষিত মানুষ সার্বভৌম শাসনকে ধ্বংস করে। যে কারণে বহিরাগতদের ব-দ্বীপকে শক্তিশালী হওয়ার পথ সুগম করে। বাংলায় এমন পরিবেশ বিদ্যমান থাকে যেখানে কেউ গেলে বা যারা বসবাস করে, স্বাভাবিকভাবে সবাই সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ভূমিকা পালনের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। স্থানীয়দের (বাঙালি) মধ্যে সহজে বিভেদ সৃষ্টি হয়। নিজেদের স্বার্থের বিষয়টি সবার কাছে প্রধান থাকে। ব্যক্তিস্বার্থের কারণে সার্বভৌম শাসন ও সবার জন্য মঙ্গলকর (জাতীয় স্বার্থ) বিষয়সমূহ ধ্বংস করা তাদের কাছে কোনও ব্যাপার নয়। কিছু মানুষের কারণে বাংলার জনপদ বিরান ভূমিতে পরিণত হয়’। আবুল ফজলের অবাক করা কথাগুলো ঘিরেই প্রায় ৫০০ বছর যেন বাংলার রাজনীতি পরিচালিত হয়ে আসছে।
আমাদের চরিত্র পাল্টাতে হবে, সুবিধাবাদী নীতি নয় দেশ ও জাতীয় স্বার্থকে সবার উপরে স্থান দিতে হবে। অনিশ্চয়তার অন্ধকার কাটিয়ে দেশবাসী নতুন ভোরের আলো দেখবে, নতুন ভাবে যাত্রা শুরু হবে সেটাই প্রত্যাশা।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী