মতামত

আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি যেন না ভাঙে

বাংলাদেশ একটি বহুজাতিক ও বহুধর্মীয় দেশ, যেখানে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ দীর্ঘকাল ধরে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহিষ্ণুতার সঙ্গে বসবাস করে আসছে। এই আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশের ইতিহাসে বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির সমন্বয় একটি সাধারণ দিক। বৌদ্ধ, হিন্দু, মুসলিম এবং খ্রিস্টানসহ নানা ধর্মের সম্প্রদায় এখানে যুগ যুগ ধরে পাশাপাশি বসবাস করেছে। এই বৈচিত্র্য দেশের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে এবং মানুষের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা তৈরি করেছে। বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ পহেলা বৈশাখে যেমন সবাই উৎসবমুখর পরিবেশে মেতে ওঠে, তেমনিই ঈদ, দুর্গাপূজা কিংবা বড়দিনের মতো উৎসবগুলোতে সব ধর্মের মানুষ অংশগ্রহণ করে। এটি জাতীয় ঐক্য ও আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির অনন্য উদাহরণ। 

বাংলাদেশের সংবিধান সব ধর্মের মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করেছে। যদিও কিছু উগ্রবাদী গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করে সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করার চেষ্টা করে, যা আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির জন্য হুমকি। কখনও কখনও ধর্মীয় পরিচয়কে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়, যা সম্প্রীতির ক্ষেত্রে নেতিবাচক ভূমিকা রাখে। কিছু ক্ষেত্রে ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে দূরত্ব তৈরির জন্য দায়ী থাকে ভুল ধারণা ও সামাজিকবৈষম্য। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে বিভিন্ন কারণে বারবার আলোচনায় উঠে এসেছে ধর্মীয় সম্প্রীতি ইস্যুটি। সেসময় শেখ হাসিনা ভারতে চলে যাওয়ার পর আওয়ামী নেতা-কর্মীদের বাড়িঘরে হামলার ঘটনা ঘটেছে— যাদের মধ্যে হিন্দু ধর্মাবলম্বীও অনেকে ছিলেন।  কিন্তু কিছু গোষ্ঠী এটাকে ঢালাওভাবে ‘সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা’ হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার অপপ্রয়াসে লিপ্ত হয়েছে। ইস্যুটি নতুন মোড় নিয়েছে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ বা ইসকনের বহিস্কৃত নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী ওরফে চন্দন কুমার ধরের গেপ্তার নিয়ে আলোচনা-সমালোচনায়। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর একাধিক সমাবেশে নেতৃত্ব দেন তিনি। তার দাবি, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উপর হওয়া ‘নিপীড়নের’ বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই এ সমাবেশ। তবে তার কর্মকাণ্ড নিয়ে বিতর্ক দানা বাঁধে। বিশেষত গত মাসে চট্টগ্রামে একটি মিছিলের সময় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার অবমাননার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়, যে মামলায় বর্তমানে তিনি কারাবন্দী। যদিও তার সমর্থকদের দাবি, তাকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তার মুক্তির দাবিতে অনলাইন-অফলাইনে সরব সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। তার মুক্তির দাবিতে বিবৃতি দিয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত। 

অন্যদিকে চিন্ময়ের অপরাধের জেরে ইসকন নিষিদ্ধের দাবি উঠছে জোরেসোরে। এদিকে চিন্ময়ের দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে ইসকন। বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে ইসকনের সাধারণ সম্পদক চারু চন্দ্র দাস ব্রক্ষ্মচারী বলেছেন, ‘চিন্ময়ের কাজ ও বক্তব্য একান্তই তার নিজের। এর দায় ইসকন নেবে না।’

৫ আগস্টের পর আমাদের দেশে যে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কে তিক্ততা তৈরি করছে তার তীব্রতা অতীতে এতোটা প্রকট ছিল না।  হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই হয়েই এখানে একসঙ্গে চিরকাল বসবাস করে এসেছে। যখন মুসলিমরা প্রায় সাত-আটশো বছর ভারতবর্ষ শাসন করেছে তখন এখানে এ ধরনের কোনো সাম্প্রদায়িক বিভক্তি দেখা যায়নি। অন্য সব দেশের মতোই এখানেও ক্ষমতার লড়াই হয়েছে, কিন্তু সেগুলো কোনোভাবেই ধর্মীয় দাঙ্গা ছিল না। ধর্মের ভিত্তিতে আলাদা করার যে মানসিকতা এটা এসেছে মূলত ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশে উপনিবেশ গড়ার পর থেকে। তারা পরিকল্পিতভাবে ধীরে ধীরে শিক্ষাব্যবস্থা, পত্রপত্রিকা, রাজনীতি ও লেখক-সাহিত্যিকদের মাধ্যমে উপমহাদেশের দুই বৃহত্তর ধর্মীয় গোষ্ঠী— হিন্দু ও মুসলিমদের ভিতরে পারস্পরিক বিদ্বেষভাব প্রবেশ করিয়েছে। একে ব্যবহার করে তারা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটিয়েছে। এ সবই তারা করেছে নিজেদের স্বার্থে। কারণ হিন্দু-মুসলমান ঐক্যবদ্ধ থাকলে তারা দু’শো বছর শাসন করতে পারত না। তাদের এই নীতির নাম ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’। তারা চলে গেছে, কিন্তু আমরা এখনও বিভক্তই রয়ে গেছি। 

আমাদের দেশের মাঝে প্রাচীর, মনের মাঝেও প্রাচীর। কাজেই এখন হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান নির্বিশেষে সব ধর্মের অনুসারীদের উচিত বৃহত্তর কল্যাণের চিন্তা থেকে বিভক্তির এই সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসা। আমাদের দোষত্রুটি নিয়ে চিন্তা না করে, বিদ্বেষ লালন না করে ঐক্যের চিন্তা করা, বিভেদ ভুলে ইস্পাত কঠিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাতিসত্তা গড়ে তোলা। যদি আমরা ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে না পারি তবে এই দেশও একদিন ইরাক, সিরিয়া, ফিলিস্তিনের মতো মাটির সাথে মিশে যাবে। আমরা বিভক্ত থাকলে আমাদের উপর ছড়ি ঘোরানোর সুযোগ পাবে সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলো। 

সমস্ত ধর্মের শিক্ষার সারকথা প্রায় এক। কেবল ভিন্ন যুগে, ভিন্ন ব্যক্তির উপর, ভিন্ন স্থানে ও ভিন্ন ভাষায় সেগুলো নাজিল হলেও তাদের শিক্ষা অভিন্ন। কালের কষাঘাতে সেই শিক্ষাগুলো বিকৃত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের নাম ও রূপ ধারণ করেছে। সবাই যার যার ধর্মকে শ্রেষ্ঠ মনে করছে। যে অমিলগুলো সামনে আনা হয়, সেগুলো নিয়ে গবেষণা করলে দেখা যাবে সেগুলো সবই বিকৃতির ফসল ও মূল সত্যের বিপরীত। ইসলাম বলে- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ অর্থাৎ এক আল্লাহ ছাড়া কোনো হুকুমদাতা নেই। সনাতন ধর্ম বলে- একমেবাদ্বীতিয়ম, একমব্রহ্ম দ্বৈত্ব নাস্তি। যার অর্থ হচ্ছে- ব্রহ্ম একজন। তার কোনো দ্বিতীয় নাই।

এখন বিভিন্ন ধর্মের যারা গুরুজন, তারা যদি ধর্মগুলোর মধ্যে নিহিত মিলগুলোকে প্রচার করে সম্প্রীতি স্থাপনের চেষ্টা করেন তাহলে এই সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা হওয়া সম্ভব। ধর্মীয় বিভাজন দূর করার জন্য আন্তঃধর্মীয় সংলাপ ও আলোচনা অত্যাবশ্যক। আমরা ধর্মীয় অনুপ্রেরণা, অংশগ্রহণ এবং সংলাপের মধ্য দিয়েই নিজেদের উন্নততর আদর্শে উন্নীত করতে সক্ষম হবো। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বিজ্ঞজনদের আলোচনা ও আলোকপাত থেকে আমরা জানতে পারব অসাম্প্রদায়িকতা ধর্মহীনতা নয়, বরং তা সকল সম্প্রদায়ের ধর্মমতকে শ্রদ্ধার এক পরম অভিজ্ঞান। নিজের ধর্ম নিজে পালন করবো, অন্যের ধর্মের প্রতিও সমান শ্রদ্ধা রাখবো। তাহলেই সম্ভব হবে সম্প্রীতির বন্ধন সৃষ্টি করা। পাশাপাশি তরুণ প্রজন্মের মধ্যে আন্তঃধর্মীয় সম্মান ও সহনশীলতার মূল্যবোধ তৈরি করতে শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মীয় সহিষ্ণুতা বিষয়ক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। ধর্মীয় বিদ্বেষ ও সহিংসতা প্রতিরোধে কঠোর আইন প্রয়োগ এবং সকল সম্প্রদায়ের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিতের কোনো বিকল্প নেই। 

দায়িত্ব পালন করতে হবে গণমাধ্যমকেও। মিডিয়াকে দায়িত্বশীলভাবে কাজ করে সমাজে ধর্মীয় সম্প্রীতির বার্তা ছড়াতে হবে। সমাজের প্রতিটি স্তরে সচেতনতা, সম্মান ও পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে এই সম্প্রীতি টিকিয়ে রাখা সম্ভব।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী