রাজনীতি

এবারের বাজেট গণবিরোধী: বিএনপি

২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটকে ‘নজিরবিহীন লুটপাট ও গণবিরোধী’ বলে আখ্যা দিয়েছে বিএনপি।

বুধবার (৭ জুন) দুপুরে রাজধানীর গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্য‌ালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বাজেট প্রতিক্রিয়া জানান দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘সরকার ১ জুন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার যে বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেছে, তা বর্তমান ফ্যাসিস্ট লুটেরা সরকারের অর্থনৈতিক দুর্নীতির ধারাবাহিকতা রক্ষার বার্ষিক ঘোষণাপত্র মাত্র। এটি কল্পনাবিলাসী, বাস্তবায়ন অযোগ্য এক উচ্চাভিলাষী বাজেট। এটা স্রেফ দুর্নীতিবাজ বর্তমান সরকারের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার লুটের লক্ষ্যে প্রণীত অর্থ লুটেরাদের বাজেট। বাজেটে চলমান অর্থনৈতিক সঙ্কট, ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্য, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে যাওয়া, বেপরোয়া অর্থপাচার, জনগণের কাঁধে রাষ্ট্রীয় ঋণের বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার কথা একবারের জন্যেও স্বীকার করা হয়নি। পরিত্রাণের উপায়ও বলা হয়নি। তেমনভাবে সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে সুশাসন ও ন্যায়বিচারকে।’

‘এই বাজেটে পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৩.৪% এবং উন্নয়ন ব্যয় ৩৬.৪%। বাজেটের এই অর্থের সংস্থান হবে ৫ লাখ ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় থেকে এবং বাকি ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা ঋণের মাধ্যমে। রাজস্ব আয়ের ৩২.৮% পরোক্ষ কর (ভ্যাট) এবং ৩০.৭% প্রত্যক্ষ কর। এরই সাথে সরকার জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭.৫% এবং মুদ্রাস্ফীতির হার ৬% প্রত্যাশা করছে। এ বাজেট বাস্তবতাবিবর্জিত, প্রতারণামূলক, লোক দেখানো। এটি জনকল্যাণমূলক বাজেট নয়।’

‘বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি ও বিনিয়োগসহ সামষ্টিক অর্থনীতির যেসব প্রক্ষেপণ করা হয়েছে, তা অর্জনযোগ্য নয়। জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭.৫% ঠিক করলেও তা কিভাবে অর্জন করা হবে, তার কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। চলতি অর্থবছরেও ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করা হয়েছে, প্রবৃদ্ধি হবে ৭.৫%। সংশোধনী বাজেটে তা পরে ৬.৩% পুনঃনির্ধারণ করা হয়। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, এবারও ৭.৫% টার্গেট অর্জন সম্ভব হবে না। কেনে না অর্থনীতি এমনিতেই চাপের মধ্যে আছে।’

'বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনীতি ও সাধারণ মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ। এ চাপ মোকাবিলায় বাজেটে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই। বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবহন এবং তেল, চাল, আদা, চিনি, ডিম, মুরগিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য অনেক আগেই মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। বিবিএসের সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী, গত মে মাসে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯.৯৪%, যা গত ১১ বছরে সর্বোচ্চ। বাস্তবে যা ১৮-২০% এর উপরে হবে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন। অর্থমন্ত্রী বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ে আমরাও শঙ্কিত। সারা বিশ্বে এখন উচ্চ মূল্যস্ফীতি। তবে, আমরা খাবার তো বন্ধ করতে পারব না। একটি নমনীয় পথে এগুচ্ছি। তার কথাটি সঠিক নয়। বাস্তবতা হচ্ছে চীন, আমেরিকা, ভারতসহ বিশ্বের নানা দেশে যথাযথ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়েছে। বিশেষভাবে খাদ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছে। রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার (আরবিআই) চলতি সপ্তাহের তথ্য অনুযায়ী, ভারতে বার্ষিক খুচরা বাজারের মূল্যস্ফীতি বর্তমানে ৬ দশমিক ৫২ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে এর পরিমাণ ছিল ৫ দশমিক ৭২ শতাংশ।’ 

'অর্থমন্ত্রী বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কোন পথরেখা না দিয়েই কিভাবে মূল্যস্ফীতি টার্গেট ৬% ঘোষণা করেছে, তা বোধগম্য নয়। বাজেটে একদিকে বিনিয়োগ ২৭.৪% এ উন্নীত করার কথা বলা হয়েছে। অপরদিকে, ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক থেকে ১ লক্ষ ৩২ হাজার কোটি টাকারও বেশি ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এত বিপুল পরিমাণ অংকের ঋণ যদি সরকার নিজেই নেয়, তবে বেসরকারি খাত নিঃসন্দেহে ঋণপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবে। তাহলে বিনিয়োগ আসবে কোত্থেকে? এক বছরের ব্যবধানে বিনিয়োগ কিভাবে ২৭.৪% এ উত্তীর্ণ হবে, তার কোনো নির্দেশনা দেননি অর্থমন্ত্রী'।

‘অর্থপাচার অব্যাহতভাবে বাড়ছে। জিএফআই বলছে, ২০০৯ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে ৪,৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়। সিআইডি বলছে, শুধু হুন্ডি প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে গড়ে বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। অন্যান্য মিলে প্রতিবছর কমপক্ষে দেড় লাখ কোটি টাকার সমপরিমাণের বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে পাচার হচ্ছে।’

‘দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংক ব্যবস্থায় নজিরবিহীন নৈরাজ্য চলছে। ব্যাংকের অতিরিক্ত ক্যাশ লিকিউডিটি কমেছে ৫৭ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা। ২০০৯ সালে যেখানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা, এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। তবে, পুনঃতফসিলকৃত ঋণ যোগ করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ ৪ লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। গত বছরের প্রথম নয় মাসেই খেলাপি বেড়েছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা। দেশে খেলাপি ঋণ বাড়ার প্রধান কারণ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা।’

‘এমনিতেই গত ৬ বছরে বিদেশী ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এক্ষণে চীন ও রাশিয়া থেকে নেওয়া কঠিন শর্তের ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ২০২৪ সন থেকেই বর্তমানের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাবে। সে সময় পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। ২০২১-২২ অর্থবছরে মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণের বোঝা ছিল ৩২৪ মার্কিন ডলার, টাকার অংকে যা প্রায় ৩২ হাজার ৭৪০ টাকা (প্রতি ডলার ১০১ টাকা দরে)। বর্তমানে আরও বেড়েছে। আইএমএফ চাচ্ছে, সরকারি ব্যাংকগুলোতে ১০ শতাংশের নিচে ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে ৫ শতাংশের নিচে থাকুক খেলাপি ঋণের পরিমাণ। কিন্তু, বর্তমানে কৌশলে এক ব্যাংকের আদায়যোগ্য খেলাপি ঋণ আরেক ব্যাংকে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া চলছে।’

‘বাজেটে আয় বৃদ্ধির জন্য কর্মসংস্থানের বিশেষ কোনো পদক্ষেপের উল্লেখ করা হয়নি। আর কর্মসংস্থান না হলে মানুষের আয় বাড়বে না। মূল্যস্ফীতির ধাক্কা তারা সামলাবে কিভাবে?’

'সরকার করযোগ্য আয় নেই এমন ব্যক্তিদেরও ৪৪ ধরনের সেবা গ্রহণে টিন গ্রহণ বাধ্যতামূলক করেছে, যা মধ্যবিত্তের ওপর জুলুম। প্রশ্ন হলো, যার আয় কম তিনি কি ওসব রাষ্ট্রীয় সেবা পাবেন না! একদিকে ন্যূনতম আয়কর সীমা বাড়িয়ে ৩,৫০,০০০ টাকা প্রস্তাব করেছে; অপরদিকে আয় না থাকলেও মিনিমাম ২ হাজার টাকা আয়কর ধার্য করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তা সাংঘর্ষিক, ন্যায়নীতিবর্জিত এবং আয়ের ওপর কর নীতিরও পরিপন্থী। একদিকে মধ্যবিত্তের ওপর ন্যূনতম ২ হাজার টাকা কর আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে, অন্যদিকে ৪ কোটি টাকা পর্যন্ত মোট সম্পদের ওপর কোনো সারচার্জ দিতে হবে না।’

‘এ পর্যন্ত ক্যাপাসিটি চার্জের নামে ১ লক্ষ কোটি টাকার বেশি লুট করেছে তারা। বাড়তি বিদ্যুৎ ভর্তুকি কিভাবে ব্যবহার করা হবে, তা স্পষ্ট করা হয়নি। আগামী অর্থবছরে বিদ্যুৎ বিভাগের জন্য বরাদ্দ হয়েছে ৩৩ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৪০% শতাংশ বেশি। অনেকে বিশ্বাস করেন, বিদ্যুৎ খাতে অতিরিক্ত বরাদ্দের মূল কারণ ক্যাপাসিটি চার্জ ও কুইক রেন্টালের নামে অর্থ লোপাটের আরও সুযোগ করে দেওয়া। অথচ সারাদেশে মারাত্মক লোডশেডিং চলছেই। গ্রামে তো বিদ্যুৎ বলতে গেলে থাকেই না। রাজধানীতেই বিদ্যুৎ লোডশেডিংয়ে সকলের ত্রাহি অবস্থা। অথচ উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ ফেরি করে বিক্রি করতে হবে বলে পার্লামেন্টে অহমিকা করেছে সরকার। এদিকে ডলারের অভাবে কয়লা কিনতে না পারায় পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ খাতের এই বিপর্যয়ের জন্য প্রধানত দায়ী এই অবৈধ সরকারের নজিরবিহীন দুর্নীতি। সরকার দেশীয় উৎস থেকে গ্যাসসহ অন্যান্য জ্বালানি আবিষ্কার ও উত্তোলনে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা না নিয়ে বোধগম্য কারণে আমদানিনির্ভরশীলতা বাড়িয়েছে।'

‘প্রস্তাবিত বাজেটে শেয়ারবাজারে ক্ষতিগ্রস্ত লাখো বিনিয়োগকারীর জন্য কোনো আশার আলো নেই। শেয়ারবাজারে সর্বস্বান্ত মানুষের আহাজারি সরকারের কানে পৌঁছে না। এ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে শেয়ারবাজারের সংকট দূর হবে বলে কেউ বিশ্বাসও করে না। শেয়ারবাজার বিপর্যয়ের ওপরে গঠিত তদন্ত রিপোর্ট আজও প্রকাশিত হয়নি।’

‘স্বাস্থ্য খাতে মোট বাজেটের ৫% শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিল বাজেটের ৫.৪% শতাংশ, অর্থাৎ ০.৪% কমানো হয়েছে। এদিকে, জিডিপির শতকরা হারেও স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ ০.৮৩% থেকে ০.৭৬% এ হ্রাস পেয়েছে। শিক্ষা খাতেও মোট বরাদ্দ জিডিপির তুলনায় ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ, যা চলতি অর্থবছরে ছিল জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ। গত বছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতের বরাদ্দ ছিল জিডিপির শতকরা হারে ২.২৫%। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতের বরাদ্দ হ্রাস পেয়ে জিডিপির শতকরা হারে ২.০৮% এ দাঁড়িয়েছে। এ দেশে এই প্রথম শিক্ষা উপকরণ কলমের ওপর ১৫% ভ্যাট বসানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। যা শিক্ষা সংকোচন নীতিরই বহিঃপ্রকাশ। কৃষি খাতে আগামী অর্থবছরে টাকার অঙ্কে বাজেট বরাদ্দ বাড়লেও খাতওয়ারি বরাদ্দের নিরিখে এই খাতে বরাদ্দ শতকরা ০.৩৩% কমেছে।’

'এই বাজেটের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ অর্থায়ন বা রাজস্বপ্রাপ্তি। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আয়ের টার্গেট ৫ লক্ষ কোটি টাকা। চলতি বছরে প্রথম ১০ মাসে এনবিআর তাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে ব্যর্থ হওয়া সত্বেও আগামী অর্থবছরে ৬০ হাজার কোটি টাকা বৃদ্ধি করে ৪ লক্ষ ৩০ হাজার কোটি টাকার টার্গেট নির্ধারণ করা হয়েছে, যা কোনোভাবেই বাস্তবায়নযোগ্য নয়। অর্থাৎ প্রক্ষেপণকৃত আয় মূলত একটি কাগুজে গোঁজামিল ছাড়া আর কিছুই নয়'।

‘বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম প্রতি ব্যারেলে কমে ৭০-৭৫ ডলারে নেমেছে। অথচ বাংলাদেশে দাম কমানো হলো না। বাজেটে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি ও অর্থপাচার প্রতিরোধে কোনো দিক নির্দেশনা নেই। ক্ষমতার বলয়ের বাইরে সাধারণ মানুষের অনুকূলে এ বাজেট কোনো ভূমিকা রাখবে না। এ বাজেট গণবিরোধী বাজেট। গত এক দশকে গোষ্ঠীস্বার্থে পলিসি ইস্যুজ, ব্যাংকিং ব্যবস্থা, রাজস্ব সেক্টর বা আর্থিক খাতসহ অন্যান্য জরুরি খাতে কাঠামোগত বড় কোনো সংস্কার করা হয়নি। এই বাজেটেও এসকল সংস্কারের কোনো ইঙ্গিত নেই।'