সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কার এবং অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে রাষ্ট্র মেরামতে ৩১ দফা ঘোষণা করেছে বিএনপি। বৃহস্পতিবার (১৩ জুলাই) দুপুরে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব দফা ঘোষণা করেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
রূপরেখা উপস্থাপনের আগে মির্জা ফখরুল জানান, গত বছরের ১০ ডিসেম্বর বিএনপির সমাবেশ থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা ঘোষণার কথা বলা হয়েছিল। এরপর ১৯ ডিসেম্বর তারেক রহমান ২৭ দফা ঘোষণা করেন। সেই ঘোষণাতেই তিনি উল্লেখ করেছিলেন, ২৭ দফা হচ্ছে বিএনপির রূপরেখা। পরে অন্য দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে আরও পরামর্শ হলে সেগুলো রূপরেখায় যোগ করার কথা তিনি বলেছিলেন।
বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘আমাদের আন্দোলন কেবল ক্ষমতার পরিবর্তনের জন্য নয়, সরকার পরিবর্তনের জন্য নয়, সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রের গুণগত পরিবর্তনের জন্য এই রূপরেখা। যুগপতে যুক্ত অন্য দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে রূপরেখা তৈরি করা হয়েছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও স্থায়ী কমিটির সদস্যরা আন্তরিকভাবেই এই রূপরেখা প্রণয়ন করেছেন।
বুধবার (১২ জুলাই) এক দফার সমাবেশে এই ৩১ দফা ঘোষণা দেওয়ার কথা থাকলেও একদিন পর এসে সেই ঘোষণা দিলো বিএনপি।
সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণ গণতন্ত্র, সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিল, সেই রাষ্ট্রের মালিকানা আজ তাদের হাতে নেই। বর্তমান কর্তৃত্ববাদী সরকার বাংলাদেশ রাষ্ট্রকাঠামোকে ভেঙে চুরমার করে ফেলেছে। এই রাষ্ট্রকে মেরামত ও পুনর্গঠন করতে হবে। দেশের জনগণের হাতেই দেশের মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে জয়লাভের পর বর্তমান ফ্যাসিস্ট সরকার হটানোর আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে একটি ‘জনকল্যাণমূলক জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ প্রতিষ্ঠা করা হবে।’
ফখরুল আরও বলেন, গত এক দশকের বেশি আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার হীন উদ্দেশ্যে অনেক অযৌক্তিক মৌলিক সাংবিধানিক সংশোধনী এনেছে। একটি ‘সংবিধান সংস্কার কমিশন’ গঠন করে সব বিতর্কিত ও অগণতান্ত্রিক সাংবিধানিক সংশোধনী ও পরিবর্তনগুলো পর্যালোচনা করে এসব রহিত/সংশোধন করা হবে এবং অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় সাংবিধানিক সংস্কার করা হবে। সংবিধানে গণভোট ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হবে।
বিএনপির ঘোষিত ৩১ দফা রূপরেখার উল্লেখযোগ্য দিক হলো—বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ও সম্প্রীতিমূলক সামাজিক চুক্তিতে পৌঁছানো; ‘নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থা প্রবর্তন; সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভার নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা; পর পর দুই টার্মের অতিরিক্ত কেউ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবে না; সংসদে ‘উচ্চকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা’ প্রবর্তন; সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করার বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে (দেখা হবে) বিবেচনা করা; স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার বাতিল; ‘বিচারপতি নিয়োগ আইন’ প্রণয়ন; ‘প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন’ গঠন; ‘মিডিয়া কমিশন’ গঠন; সংবিধান অনুযায়ী ন্যায়পাল নিয়োগ; দেড় দশকে গুম-খুনের বিচার; ‘অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন’ গঠন; ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, উপাসনালয় ভাঙচুর এবং তাদের সম্পত্তি দখলের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ; বাংলাদেশ ভূখণ্ডের মধ্যে কোনও প্রকার সন্ত্রাসী তৎপরতা বরদাশত না করা; মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের একটি তালিকা প্রণয়ন; যুক্তরাজ্যের আদলে সর্বজনীন স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন; সবার জন্য স্বাস্থ্য কার্ড চালু করা।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, ড. আব্দুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সেলিমা রহমান।