আসন সমন্বয় নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক হলেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টির বনিবনা এখনও হয়নি। সমঝোতা করতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে দুটি শর্ত দেওয়া হয়েছে।
জাতীয় পার্টির পছন্দের তালিকা ধরে কমপক্ষে ৩৫ থেকে ৪০ আসন বন্টন করতে হবে। আর সেসব আসনে নৌকার প্রার্থী প্রত্যাহার করে নিতে হবে। আজকে দুপুরের মধ্যে দুই শর্ত মানা না হলে জাতীয় পার্টি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে পারে বলে জানিয়েছেন নির্বাচনে থাকা দলটির একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতীয় পার্টির ওই প্রেসিডিয়াম সদস্য রোববার (১৭ ডিসেম্বর) সকালে রাইজিংবিডিকে বলেন, জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগকে ৬০ আসনের প্রার্থী তালিকা দেওয়া হয়েছে। এই তালিকা থেকে অধিকাংশ নেতাকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ তাদের মতো করে প্রার্থী নির্ধারণ করে দিচ্ছে। যাতে আমাদের কোনো সায় নেই। আমাদের দাবি, আমরা যে তালিকা দিয়েছি সেই তালিকা থেকে আসন সমন্বয় করতে হবে। আর সেসব আসনে নৌকা প্রত্যাহার নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা হবে না। দুপুর পর্যন্ত আমরা দেখবো তারপর নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দেবো।
জানা গেছে, আসন সমন্বয় নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টির বেশ কয়েক দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এসব বৈঠকে জাতীয় পার্টির পক্ষে নেতৃত্ব দেন দলের জ্যেষ্ঠ কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের কাছে একটি তালিকা দেওয়া হয়। বেগম রওশন এরশাদ, তার ছেলে সাদ এরশাদ, সাবেক মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা ও ডাক্তার রুস্তম আলী ফরাজিকে বাদ দিয়ে জাতীয় পার্টির বর্তমান সাংসদসহ প্রায় ৬০ জনের তালিকা দেন। এতে সাবেক মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, শেরিফা কাদের, অ্যাডভোকেট রেজাউল ইসলাম ভুইয়া, মোস্তফা আল মাহমুদ, জহিরুল আলম রুবেল, জহিরুল ইসলাম জহিরসহ দলের মধ্যম সারির বড় একটি অংশের নাম রয়েছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে শুক্রবার সর্বশেষ বৈঠকে ওই তালিকা থেকে ২৬ জনের আসন সমন্বয়ে রাজি হয় আওয়ামী লীগ।
তাতে জাপার বর্তমান ২৩ জন সাংসদের পাশাপাশি সাবেক মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদারসহ আরও তিন জনকে রাখা হলেও দেওয়া হয় মধ্যমসারির বড় অংশটিকে। তবে এতে দলের আসন সমন্বয়ে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারা ভেতরে ভেতরে রাজি হলেও চরম ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন মধ্যম সারির নেতারা। তাদের রোষানলে পড়তে হবে এই ভয়ে এসব নেতা এখন তৃণমূল নেতাকর্মীদের বিরোধিতার সাথে তাল মিলিয়ে যাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে শনিবার জাতীয় পার্টির নেতারা জানতে পারেন ২৬ জনের তালিকা থেকে আর কয়েকজনকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। মধ্যম সারির নেতাদের সঙ্গে ঢাকায় আবু হোসেন বাবলা, কাজী ফিরোজ রশীদ, সালমা ইসলাম, লিয়াকত হোসেন খোকাদের নাম নেই। এতে তারাও ক্ষুব্ধ হন জাতীয় পার্টির মহাসচিবের ওপর। খবর পেয়ে নেতারা ছুটে আসেন দলের কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসের গুলশাসের বাসায়। বিকাল ৫ টা থেকে রাত সাড়ে ১২ টা পর্যন্ত বৈঠক করে বিক্ষুব্ধ নেতারা। বৈঠকে দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদের, মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু, রুহুল আমিন হাওলাদার, কাজী ফিরোজ রশীদ, আবু হোসেন বাবলা, লিয়াকত হোসেন খোকা, রেজাউল ইসলাম ভুইয়া, জহিুরুল আলম রুবেল, শফিকুল ইসলাম সেন্টুসহ শীর্ষ পর্যয়ের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক থেকে জাপা মহাসচিব চুন্নু লাউড স্পিকারে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সাথে কথা বলেন। আসন সমন্বয় নিয়ে নেতাদের ক্ষুব্ধ মনোভাব তুলে ধরেন। চুন্নু তাদের পছন্দের আসন সমন্বয়ের তাগিদ দেন কাদেরকে। নাহলে দল নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নেবে বলেও জানান তিনি। এ সময় ওবায়দুল কাদের দলীয় সভাপতির সঙ্গে আলোচনা করে চুন্নুকে পরবর্তী সিদ্ধান্ত জানানোর কথা বলেন। কিন্তু রাত সাড়ে ১২টায় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি। এতে নেতারা আরও ক্ষুব্ধ হন। কেউ কেউ নির্বাচন করবেন না বলেও হুমকি দিয়ে চলে যান। কাঙ্খিত আসন না পেলে অধিকাংশ নেতা নির্বাচন বর্জনের জন্য চাপ দেন দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদের, ব্যারিস্টার আনিস ও মহাসচিব চুন্নুকে।
জানা গেছে, সকাল থেকে নেতারা ভিড় করছেন জিএম কাদের এর বনানী অফিসে। আসন সমন্বয়ের অপেক্ষায় রয়েছেন তারা। দুপুরে মধ্যে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ঘোষণা না এলে সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিতে পারে জাতীয় পার্টি।
জানা গেছে, এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বনানী অফিসে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের, মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু, কো-চেয়ারম্যান রুহুল আমিন হাওলাদার, কাজী ফিরোজ রশীদ, আবু হোসেন বাবলা, সালমা ইসলাম, রংপুরের মেয়র মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা, রেজাউল ইসলাম ভুইয়া, জহিরুল আলম রুবেল, মোস্তফা আল মাহমুদ, জহিুরুল ইসলাম জহির, বেলাল হোসেন, হেলাল উদ্দিনসহ বিপুলসংখ্যক নেতা উপস্থিত রয়েছেন। পরবর্তী করণীয় নির্ধারণে দফায় দফায় বৈঠক করছেন তারা।
উপস্থিত একজন নেতা জানান, আসন সমন্বয় এর অপেক্ষা করছি আমরা। দ্রুত যদি না হয় নির্বাচন বর্জনের প্রস্তুতি রয়েছে। অধিকাংশ নেতাই চান নির্বাচন বর্জন করতে। যেকোনো সময় ঘোষণা হতে পারে বলেও জানান তিনি।
এদিকে, নির্বাচন বর্জনের দাবিতে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য আলমগীর সিকদার লোটন, দলের সাংগঠনিক সম্পাদক হেলাল উদ্দিন হেলালের নেতৃত্বে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। মিছিলটি জি এম কাদের এর বনানী অফিস থেকে আশেপাশের সড়ক প্রদক্ষিণ করে আবার বনানী অফিসে গিয়ে শেষ হয়। বনানী অফিসে তারা এখনও বিক্ষোভ প্রদর্শন করে শ্লোগান দিচ্ছেন।
বনানী অফিসে নেতাকর্মীদের মিছিল শ্লোগান চলছে। এরই মধ্যে পুলিশ বনানী অফিসে অবস্থান নিয়েছে। দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুসহ সিনিয়র নেতাদের নিয়ে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণে আলাপ আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন।