রাষ্ট্রপতি অপসারণে নৈতিক আপত্তি নেই বলে জানিয়েছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। তবে এটার প্রক্রিয়া কী হবে, সাংবিধানিক ভিত্তি কতটুকু আছে, এ বিষয়গুলো নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনার প্রয়োজন আছে বলে মনে করে জোটটি।
রাজধানীর পুরানা পল্টনের মুক্তি ভবনে মঙ্গলবার (২৯ অক্টোবর) বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতারা এই মতামত ব্যক্ত করেন।
বৈঠকে বাম গণতান্ত্রিক জোটের পক্ষে ছিলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন (প্রিন্স), বাসদের সহকারী সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন, বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক ও বাসদের (মার্ক্সবাদী) সমন্বয়ক মাসুদ রানা, বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য আবদুস সাত্তার, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক পার্টির নির্বাহী সভাপতি আবদুল আলী এবং গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু।
অপরদিকে, যৌথ প্রতিনিধিদলে জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসিরুদ্দিন পাটোয়ারী ছাড়াও মুখপাত্র সামান্তা শারমিন, রাজনীতিবিষয়ক সম্পাদক আরিফুল ইসলাম আদীব, সদস্য সাইফ মোস্তাফিজ এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ও সদস্যসচিব আরিফ সোহেল ছিলেন।
বৈঠক শেষে বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক ও বাসদের (মার্ক্সবাদী) সমন্বয়ক মাসুদ রানা বলেন, আমরা বলেছি, রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার। ভবিষ্যতের কর্মপরিকল্পনার ব্যাপারেও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে একমত হয়ে পরবর্তী কার্যক্রমগুলো পরিচালনা করা দরকার। রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের ব্যাপারে আমাদের নৈতিক আপত্তি নেই বলে আমরা জানিয়েছি। কিন্তু এটার প্রক্রিয়া কী হবে, সাংবিধানিক ভিত্তি কতটুকু আছে, এ বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের নিজেদের মধ্যে আলোচনার প্রয়োজন আছে।
বৈঠকে সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রসঙ্গও এসেছে বলে জানান বাম জোটের সমন্বয়ক।
তিনি বলেন, দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের ঘোষণার বিষয়ে আমরা বলেছি, এই অভ্যুত্থানের মূল স্পিরিটকে আমাদের ধারণ করা উচিত। সেটা হচ্ছে আমরা একটা বৈষম্যহীন বাংলাদেশ চাই। এটাকে স্পিরিট হিসেবে নিয়ে ফ্যাসিবাদ থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের লড়াইকে আমরা মূল জায়গা মনে করি।
মুক্তিযুদ্ধ আওয়ামী লীগের কোনো সম্পত্তি নয় বর্ণনা করে তিনি বলেন, লাখ লাখ মানুষের জীবনদানের মধ্য দিয়ে যে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, সেই জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে আমাদের লড়াইটা এগিয়ে নেওয়া উচিত।
গণ–অভ্যুত্থান ঘিরে হত্যাকাণ্ডের বিচার, আহত-নিহতদের তালিকা প্রকাশ, চিকিৎসা ও পুনর্বাসন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া, রেশনিং ব্যবস্থা চালু, অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য চালু করা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ, বেসামরিক প্রশাসনের কার্যকর ভূমিকা—এ বিষয়গুলোও জোটের পক্ষ থেকে বৈঠকে তুলে ধরা হয় বলে জানান মাসুদ রানা।
তিনি বলেন, এই সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা এবং তার জন্য যতটুকু সংস্কার প্রয়োজন, সেই সংস্কারে এই সরকারের হাত দেওয়াটা দরকার।
সিপিবি নেতা রুহিন হোসেন বলেন, বিএনপি দেশের একটি বড় রাজনৈতিক দল। এক্ষেত্রে ঐকমত্য হতে গেলে বিএনপিসহ বামপন্থীরা কথা বলে ঐকমত্য তৈরি করতে হবে। সেটা না হলে তো আর এগোনোর বিষয় নেই। রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় নিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলে অন্তর্বর্তী সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দেশের এ ধরনের বড় গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে সংকট সমাধানে সরকারেরই উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
বাসদ নেতা রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, গণঅভ্যুত্থান কোনো আইন মেনে হয়নি। কিন্তু একটা রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গেলে আইন লাগে। ফলে একদিকে গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করতে হবে, আবার গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য এমন পদ্ধতি নিতে হবে, যাতে ফ্যাসিবাদ থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণ ঘটে। তিনি বলেন, এমন কোনো পথ আমরা এখনই নিতে চাই না, যা নতুন কোনো ষড়যন্ত্রের পথ খুলে দিতে পারে।
বৈঠকে আলোচনা নিয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসিরুদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, রাষ্ট্রপতির অপসারণের বিষয়ে বাম গণতান্ত্রিক জোটের নৈতিক সমর্থন রয়েছে। কিন্তু প্রক্রিয়াটা কীভাবে হবে, সে বিষয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা চলছে। তারা দেশের বিশিষ্টজন, নিজেদের দলীয় ফোরাম ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে এবং এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গেও আলোচনা করবে।
বাম জোট বিগত তিনটি নির্বাচনকে অবৈধ মনে করে উল্লেখ করে নাসিরুদ্দিন আরও বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের স্পিরিট ধারণ করে সব মানুষের অংশগ্রহণে প্রক্লেমেশন অব সেকেন্ড রিপাবলিক ডিক্লারেশনের বিষয়ে দুটি মতামত নিয়ে আমরা তাদের সঙ্গে সম্মত হয়েছি৷ দ্রব্যমূল্যের ব্যবস্থাপনায় তারা সিন্ডিকেটের বিষয়টি এনেছেন। কতগুলো রাজনৈতিক দল সেই সিন্ডিকেটগুলো এখনো চালিয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতার পরিবর্তন হয়েছে, ব্যক্তি চলে গেছে, কিন্তু ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা অন্যান্য দল দখলে নিয়েছে। জোটের নেতারা বলেছেন, সেই ব্যবস্থার বিলোপের জন্য নিকট ভবিষ্যতে মাঠের সংগ্রামে তারা আমাদের সঙ্গে থাকবেন।
রাষ্ট্রপতির অপসারণসহ পাঁচ দফা দাবি নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা ছয় দিনে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ ছয়টি দল ও তিনটি জোটের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। মঙ্গলবার বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।