তাবলীগ জামাতের (একাংশ) শীর্ষ আলেম ও দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাজের বর্তমান মুরব্বী মাওলানা সাদকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ; তাদের অনুসারীদের কার্যক্রম বন্ধ, সর্বস্তরে ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক, আলেমদের সব মামলা প্রত্যাহারসহ ৯ দফা দাবি জানিয়েছেন তাবলীগ জামাতের অপর অংশের (জুবায়েরপন্থী) আলেম-ওলামারা। তবে তাদের বেশিরভাগ দাবিই তাবলীগের ‘বিরোধী পক্ষ’ মাওলানা সাদ ও তার অনুসারীদের কার্যক্রম নিয়ে। তারা ডিসেম্বরে মাওলানা সাদকে বাংলাদেশে ঢুকতে না দেওয়ারও হুমকি দেন। এমনকি ব্যবস্থা না নিলে অন্তর্বর্তী সরকার পতনেরও হুঁশিয়ারি দেন।
মঙ্গলবার (৫ নভেম্বর) দুপুরে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত ইসলামী মহাসম্মেলন থেকে এসব দাবি করা হয়। দাবি উপস্থাপন করেন শায়খুল হাদিস পরিষদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও বেফাক মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক।
৯ দফা দাবি—
→ কওমি শিক্ষাকে দারুল ওলুম দেলবন্দের আওতায় পরিচালনা করতে হবে। তাবলীগ নিয়ে বিচ্ছিন্ন মহলের সব ষড়যন্ত্র বন্ধ করতে হবে।
→ সাধারণ শিক্ষা সিলেবাসে ধর্মশিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে।
→ আলেমদের বিরুদ্ধে বিগত সরকারের যাবতীয় মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।
→ শাপলা চত্বরের গণহত্যায় জড়িত আসামিদের দেশে এনে শাস্তি নিশ্চিত এবং সারা দেশে দায়ের করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।
→ ২০১৮ সালে টঙ্গী ময়দানে সাদপন্থীদের নৃশংস আক্রমণের বিচার করতে হবে।
→ সাদপন্থীরা নবী করিম (সা.)সহ সাহাবীদের সমালোচনা করে আসছে। সাদ তাবলীগের নীতিমালা উপেক্ষা করে আসছে। তাই দারুল উলুম দেলবন্দ সাদ সাহেবকে দেশে আসতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। কোনও অবস্থাতেই আসতে দেওয়া হবে না।
→ আলেমপন্থীদের বিশ্ব ইজতেমাই সরকার ঘোষিত দুই পর্বে করতে দিতে হবে। এর মধ্যে আগামী বিশ্ব ইজতেমা প্রথম পর্ব অনুষ্ঠিত হবে ২৭,২৮ ও ২৯ জানুয়ারি, দ্বিতীয় পর্ব ৭,৮ ও ৯ ফেব্রুয়ারি করার ঘোষণা করা হলো। এ বিষয়ে সরকারের সার্বিক সহযোগিতা কামনা করছি।
→ কাকরাইল মসজিদ সাদপন্থীদের কোনো কার্যক্রম চালাতে দেওয়া হবে না। কাকরাইল আজ থেকে কেবলমাত্র শুরায়ি নেজামে পরিচালিত হবে।
→ অভিশপ্ত কাদিয়ানিদের অবিলম্বে অমুসলিম ঘোষণা করতে হবে।
‘দাওয়াত ও তাবলীগ, মাদারেসে কওমিয়া এবং দীনের হেফাজতের লক্ষ্যে’ এ মহাসম্মেলনের আয়োজন করে কওমিপন্থী ওলামা মাশায়েখ বাংলাদেশ। সকাল ৯টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আলেম-ওলামাদের ঢল নামে।
মূলত কওমি ঘরানার আলেম-ওলামা ও রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীরা মহাসম্মেলনে যোগ দেন।
মহাসম্মেলনে মাওলানা সাদের অনুসারীরা আসন্ন বিশ্ব ইজতেমাকে কেন্দ্র করে ভয়াবহ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সহিংসতা করার ষড়যন্ত্র করছে বলে অভিযোগ করা হয়। তারা কোনোভাবেই সাদকে বাংলাদেশে ঢুকতে দেবেন না বলে হুঁশিয়ারি দেন। এ বছর তাদের ইজতেমা করতে দেওয়া হবে না বলেও হুমকি দেন তারা।
মাওলানা আব্দুল হামিদ (পীর মধুপুর) বলেন, বিশ্ব ইজতেমা নিয়ে সরকার দুই পক্ষের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিতে চাইছে। আমি বলব, কীসের পরামর্শ? এই সম্মেলন থেকে যে সিদ্ধান্ত আসবে, সরকারকে এটাই বাস্তবায়ন করতে হবে। ভিন্ন কোনো চিন্তা করলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে।
তিনি বলেন, আমরা সরকারকে সহযোগিতা করব। সরকারকেও আলেমদের সহযোগিতা করতে হবে। নয়তো পূর্ববর্তী সরকারের মতোই তাদের দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হবে। স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, যদি বেয়াদবকে বাংলাদেশে আসতে দেয়; তাহলে সরকারকেও পালিয়ে যেতে হবে।
সরকারের প্রতি দাবি জানিয়ে হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শাহ মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী বলেন, যতদিন মাওলানা সাদ তার গোমরাহী বক্তব্য থেকে তাওবা না করবে, ততদিন তাকে বাংলাদেশে আসতে দেওয়া যাবে না। টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা আলেমদের তত্ত্বাবধানে শুরায়ি নেজামে পরিচালিত হবে। কাকরাইল মারকাজের কার্যক্রম ওলামায়ে কেরামে জিম্মাদারিতে চালু রাখতে হবে।
তিনি বলেন, ব্যক্তি মাওলানা সাদের কারণে ছাত্রজনতা ও আলেম ওলামাদের কোরবানির বদৌলতে অর্জিত স্বাধীন নতুন এই বাংলাদেশে বিশৃঙ্খলা তৈরি হোক এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বেকায়দায় পড়ুক, আমরা চাই না। আমি আশা করি, সার্বিক বিবেচনায় সরকার সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
বাবুনগরী বলেন, দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাজের বর্তমান মুরব্বী মাওলানা সাদ বিভিন্ন সময় কুরআন, হাদিস, ইসলাম, নবী-রাসুল, নবুয়ত, সাহাবায়ে কেরাম এবং শরয়ী মাসআলা-মাসায়েল নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন। তার বক্তব্যগুলো কুরআন-সুন্নাহবিরোধী, যা মেনে নেওয়া যায় না।
তিনি বলেন, দ্বীনের বিভিন্ন বিষয়ে তার চিন্তাগত বিচ্যুতি ও বিচ্ছিন্নতা এবং অনেক বিষয়ে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত ও জুমহুরের মুত্তাফাকা তথা ঐক্যমতসমর্থিত মাসআলা ও মাযহাবের খেলাফ করার কারণে শরীয়ত মতে তার এতা’য়াত জায়েজ নেই।
‘তার এসব আপত্তিকর মন্তব্যের জন্য দারুল উলুম দেওবন্দসহ বিশ্ব আলেমদের কাছে তিনি চরম বিতর্কিত হয়েছেন। আলেমরা দায়িত্ব নিয়ে তাকে সংশোধন করার চেষ্টা করেছেন। তিনি আলেমদের পরামর্শ গ্রহণ করে নিজের বক্তব্য সংশোধন করতে রাজি হননি’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
হেফাজতের আমির বলেন, দাওয়াতে তাবলীগ প্রতিষ্ঠা হয়েছে দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে। যারা মাওলানা সাআদের বিরোধীতাকারী আলেমদের দেওবন্দি, হেফাজতি বলছে তারা গোমরাহিতে আছে। হযরতজি ইলিয়াছ (রহ.) বলে গেছেন, যদি তাবলীগ থেকে ইলম ও জিরিক উঠে যায়, তাহলে দাওয়াতে তাবলীগের কাজে গোমরাহি ঢুকে যাবে।
বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, বিশ্ব ইজতেমাকে কেন্দ্র করে স্বঘোষিত আমির সাদ ও তার অনুসারীরা বিশৃঙ্খলা করার পরিকল্পনা নিয়েছে। আমরা কোনোভাবেই সেটি হতে দেব না। তাদের সমস্ত ষড়যন্ত্র যে কোনো মূল্যে আমরা ব্যর্থ করে দেব।
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বলব, আপনারা রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন। আমরা আপনাদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করব। আপনাদের মনে রাখতে হবে, ছাত্রজনতার আন্দোলনে অনেক ওলামায়ে কেরাম শাহাদাতবরণ করেছেন। আমরা শাপলা চত্বরে জীবন দিয়েছি। আওয়ামী জালিম সরকারের অনেক অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হয়েছি।
তিনি বলেন, বিশ্ব ইজতেমা নিয়ে আজকের সম্মেলন থেকে ওলামায় কেরামের পক্ষ থেকে যে ঘোষণা দেওয়া হবে, সরকারকে সেই নির্দেশনা মানতে হবে। এর বাইরে কারও সিদ্ধান্ত তৌহিদী জনতা মেনে নেবে না।
মহাসম্মেলনে আল্লামা খলিল আহমাদ কাসেমী, হাটহাজারী, আল্লামা আব্দুল রহমান হাফেজ্জী, আল্লামা নুরুল ইসলাম, আদিব সাহেব, মাওলানা ওবায়দুল্লাহ ফারুক, মাওলানা রশিদুর রহমান, আল্লামা শাইখ জিয়াউদ্দিন, আল্লামা শায়েখ সাজিদুর রহমান, আল্লামা আব্দুল কুদ্দুস, ফরিদাবাদ, আল্লামা নূরুল ইসলাম ওলিপুরী, মাওলানা মাহফুজুল হক, মাওলানা আবু তাহের নদভী, মাওলানা আরশাদ রহমানি, মাওলানা সালাহউদ্দীন নানুপুরী, মাওলানা মুস্তাক আহমদ, খুলনা, অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান চৌধুরী পীর সাহেব দেওনা, মাওলানা আনোয়ারুল করীম, মাওলানা মুফতি মোহাম্মদ আলী, মাওলানা মুফতি মনসুরুল হক, মাওলানা মুফতি দেলাওয়ার হোসাইন, মাওলানা জাফর আহমাদ, ঢালকানগর, মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব, মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি, মাওলানা বাহাউদ্দীন জাকারিয়া, মাওলানা আব্দুল আউয়াল, মাওলানা মুহিউদ্দিন রাব্বানী, মাওলানা নাজমুল হাসান কাসেমী, মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ সা’দী, মাওলানা মামুনুল হক, মাওলানা জিয়াউদ্দিন, মাওলানা আব্দুল হক, মাওলানা ইউনুস প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।