নিলুফা বেগম (৬০)। গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার চরখামের গ্রামের একজন বাসিন্দা। এক সময় নিজের ও পরিবারের দু’মুঠো ভাত জোগাড় করতে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়েছে। বয়সের ভারে কাজও করতে পারছিলেন না তিনি। তার স্বামীও দীর্ঘ দিন ধরে অসুস্থ, ঘরের বিছানায় শুয়ে থেকে সময় কাটে তার। একমাত্র মেয়ে বিয়ের পর চলে গেছেন অন্যের ঘরে। ক্ষুধার যন্ত্রণা যেন কুড়ে খাচ্ছিল তাকে।
এমন পরিস্থিতে সরকারের পক্ষ থেকে একটি দোকান ও মালামাল পেয়ে তার জীবনের মোড় ঘুরে গেছে। নিলুফা বেগম এখন আর ভিক্ষা করেন না।
তিনি জানান, খাবারের জন্য মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হাত পাততে হতো তাকে। ঠিক এমন সময় এ বছরের শুরুর দিকে কাপাসিয়ার ইউএনও মোসা. ইসমত আরা তাকে ডেকে পাঠালেন। সরকার তাকে দোকান করে দেবে, দোকানের মালপত্র কেনার জন্য মূলধনও দেওয়া হবে বলে জানানো হলো।
এখবর শুনে তার যেন খুশি আর ধরে না। শেষে গত ২৬ মার্চ সেই দোকান ও মালপত্র বুঝিয়ে দিলেন ইউএনও ইসমত আরা। এরপরও ঘুরে গেলো নিলুফার ভাগ্যের চাকা।
তিনি আর ভিক্ষুক নন, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। স্বামীর ওষুধের টাকার জন্য অন্যের কাছে হাত পাততে হয় না। মুদি দোকান চালিয়ে এখন দৈনিক ১২শ’ থেকে ১৫শ’ টাকা আয় করছেন।
সরকারের দেওয়া দোকান ও মূলধন পেয়ে একইভাবে ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন কাপাসিয়া উপজেলার কড়িহাতা ইউনিয়নের রামপুর গ্রামের শারীরিক প্রতিবন্ধী আবুল হোসেনের স্ত্রী হেলেনা বেগম (৪৫)। দোকান পাওয়ায় তার ১০ বছরের ভিক্ষাবৃত্তির অভিশাপের অবসান হয়েছে।
একই উপজেলার পাকিয়াব গ্রামের হতদরিদ্র নাজিম উদ্দিনও পেয়েছেন সরকারি দোকান ও মালপত্র। অনিচ্ছা সত্ত্বেও শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে একসময় তাকে ভিক্ষা করতে হয়েছে। সরকারিভাবে তাকে সহায়তা করায় এখন তিনি আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠছেন এবং তার মধ্যে নতুনভাবে বাঁচার আশা সঞ্চার হয়েছে। ক্ষুদ্র দোকানের মাধ্যমে তার এখন যে আয় হচ্ছে, তাতেই তিনি স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাকি জীবন কাটাতে পারবেন বলে আশা করছেন।
কাপাসিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইসমত আরা বলেন, আমার উপজেলায় সরকারি সহায়তার মাধ্যমে ৬ জন ভিক্ষুককে ভিক্ষাবৃত্তি থেকে সরিয়ে এনে স্বাবলম্বী করা হয়েছে। স্থানীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও বাজারগুলোতে ক্ষুদ্র দোকান নির্মাণ করে মালামাল কিনে দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে যে আয় হবে, তা দিয়ে তারা সংসার চালাতে পারবেন।
তিনি বলেন, আমরা ভিক্ষুক পুনর্বাসনের জন্য যে বরাদ্দ পাচ্ছি, তা দিয়ে এ প্রকল্প অব্যাহত রাখার পাশাপাশি তালিকায় থাকা অনেককেই ভিক্ষাবৃত্তির অভিশাপ থেকে বের হয়ে আসার জন্য কাউন্সিলিং করছি।
গাজীপুর সমাজসেবা বিভাগের উপ-পরিচালক এসএম আনোয়ারুল করিম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী গত দুই বছর আগে ভিক্ষুকমুক্ত গাজীপুর গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এজন্য প্রাথমিক অবস্থায় জেলার ৫টি উপজেলায় জরিপ করে ভিক্ষুক বাছাই করা হয়। জরিপে কালিয়াকৈরে ৫৭৮ জন, কালীগঞ্জে ২৩৬ জন, শ্রীপুরে ৪৬৬ জন, কাপাসিয়ায় ৭৮ জন, গাজীপুর সদরে ১৭০ জনসহ মোট ৯৫০ জন ভিক্ষুক বাছাই করা হয়। পরে তাদের এ পেশা থেকে ফিরিয়ে আনতে পর্যায়ক্রমে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, সরকারিভাবে ভিক্ষুক পুনর্বাসন করতে এযাবৎ মোট ৭ লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া যায়। এর মধ্যে গাজীপুর সদরে ৮ জন, কাপাসিয়ায় ৬ জন, কালিগঞ্জে ৩ জন, কালিয়াকৈরে ৫ জনকে মুদি দোকান তৈরি করে দেওয়া হয়। এছাড়াও এ প্রকল্পের আওতায় শ্রীপুরে ১২ জন ভিক্ষুককে আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তুলতে পালনের জন্য ছাগল দেওয়া হয়েছে।
উপ-পরিচালক আরও বলেন, সব মিলিয়ে ২৮ জন ভিক্ষুককে পুনর্বাসন করে ভিক্ষাবৃত্তি থেকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এছাড়াও জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে অনেককেই আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে অভিশপ্ত পেশা ভিক্ষাবৃত্তি থেকে বের করে কাজের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে। পরনির্ভরশীলতা দূরীকরণে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে। তাই ভিক্ষাবৃত্তির পেশায় নিয়োজিতদের আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তুলতে আমাদের কাজ অব্যাহত রয়েছে।
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এসএম তরিকুল ইসলাম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ভিশন ও নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা সারাদেশের মতো গাজীপুরকে ভিক্ষুকমুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছি। ইতোমধ্যেই আমরা কাজ শুরু করেছি। অনেকেই এখন সরকারি সহায়তার মাধ্যমে ভিক্ষা ছেড়ে আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠছেন। এটা আমাদের জন্য আনন্দের সংবাদ।