লক্ষ্মীপুরে দিন দিন বাড়ছে পান চাষ। ধান, আলুসহ অন্যান্য ফসলের চেয়ে পান চাষ লাভজনক হওয়ায় অনেকেই ঝুঁকছেন পান চাষে। জেলাজুড়ে বেশকিছু গ্রামের মাঠে নিজ মেধা ও উদ্যোগে পান চাষ করে ব্যাপক সফলতা পাচ্ছেন কৃষকরা।
একরপ্রতি পানের বরজে প্রায় এক থেকে দেড় লাখ টাকা খরচ করে পরবর্তী বছর থেকে প্রতি বছর লাভ করছেন ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা। এবছর লক্ষ্মীপুরে প্রায় ৩ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন পান উৎপাদন হয়েছে বলে ধারণা করছে কৃষি বিভাগ। তবে জেলায় কোনো সংরক্ষণাগার না থাকায় বিড়ম্বনায় পড়তে হয় পান চাষিদের।
লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার উত্তর চরআবাবিল এলাকার জাকির হোসেন, কামাল হোসেন, আবুল কাশেম, তোফায়েল, দুলাল ব্যাপারী, হানিফ কবিরাজ, আরিফ দীর্ঘ দিন ধরে পান চাষ করে আসছেন। তাদের সফলতায় পার্শ্ববর্তী উদমারা, চরবংশি, হায়দারগঞ্জসহ বিভিন্ন গ্রামের চাষিরা পান চাষের দিকে ঝুঁকছেন।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিবিঘা জমির পানের বরজে মাটির আইল, বেড়া, ছাউনি, শ্রমিক, পানের লতাসহ ১ থেকে দেড় লাখ টাকা প্রাথমিক অবস্থায় খরচ হয়। পরের বছর থেকে খরচ খুবই সামান্য হয়। কারণ একটি পানের বরজ তৈরি করার পর মাটির আইল, বেড়া, ছাউনি সংস্কার ছাড়া ৪০-৪৫ বছর পর্যন্ত পানের বরজ অক্ষুণ্ণ থাকে। সেখান থেকে পান পাওয়া যায়। বৈশাখ থেকে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত পানের ভরা মৌসুম। ভাদ্র থেকে মাঘ মাস পর্যন্ত পানের উৎপাদন কম হয়। ফালগুন মাসে বাড়ন্ত লতিকে নিচে নামিয়ে দেওয়াতে পানের উৎপাদন হয় না বললেই চলে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য মতে, চলতি বছর লক্ষ্মীপুর সদর, রায়পুর, রামগঞ্জ, কমলনগর ও রামগতি উপজেলায় প্রায় ৫০০ হেক্টর জমিতে ছোট-বড় প্রায় আড়াই হাজার বরজে পান চাষ হয়েছে। এর মধ্যে রায়পুর উপজেলায় ৪০০ হেক্টর জমিতে প্রায় ১ হাজার ৬২০টি বরজে পান চাষ করেন কৃষক। এবছর প্রতি হেক্টর জমিতে প্রায় ১৫-১৬ হাজার বিড়া (৭২টি পানে এক বিড়া) পান উৎপাদন হয়েছে।
স্থানীয় বাজারগুলো থেকে পাইকাররা এক পাই (১২ বিড়া), এক কুড়ি (৪৮ বিড়া) ও এক গাদি (১৯২ বিড়া) হিসেবে আকারভেদে ক্রয় করছেন। বর্তমানে প্রতি বিড়া পান আকারভেদে ১০০ থেকে ১৪০ টাকা দরে পাইকারি বিক্রি হয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। রায়পুর উপজেলায় সবচেয়ে বড় পানের পাইকারি বাজার বসে সোমবার এবং শুক্রবার রায়পুর, শনি এবং বুধবার হায়দারগঞ্জ, রবি-বৃহস্পতিবার ক্যাম্পেরহাট বাজারে। ব্যবসায়ীরা এখান থেকে পান কিনে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পানের চাহিদার যোগান দিচ্ছেন।
রায়পুর উপজেলার উত্তর চরবংশী গ্রামের পানচাষি জাকির হোসেন বলেন, স্বপ্ন ছিল প্রবাসে যাবো। পাসপোর্টও করেছি। পরে পার্শ্ববর্তী এলাকায় পান চাষে লাভবান হওয়ায় নিজেই ২০ শতাংশ জমিতে শুরু করি। ওই বছর ১ লাখ টাকা লাভ হয়। পরে আরও ২৬ শতাংশ জমি নিয়ে মোট ৪৬ শতাংশ জমিতে পান চাষ শুরু করি। এখন বছরে লাভ হয় ৪-৫ লাখ টাকা। এছাড়া উৎপাদন খরচের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ লাভ হওয়ায় পান চাষের দিকে ঝুঁকছেন অধিকাংশ কৃষক। তবে প্রয়োজনীয় পুঁজির অভাবে পানের বরজের প্রসার ঘটাতে পারছেন না তিনি।
ঢাকা হাবিব উল্যাহ কলেজ থেকে মাস্টার্স শেষ করে পান চাষ করছেন কামাল হোসেন। তিনি বলেন, দেশে ভালো কোনো চাকরি যেন সোনার হরিণ। দীর্ঘ দিন চাকরির খোঁজ করে না পাওয়ায় বাবার সাথে পানের বরজে সময় দেই। বর্তমানে আমার ৫০ শতক জমিতে পানের বরজ রয়েছে। গত চার বছরে এ বরজ তৈরি ও আবাদ করতে ২ লাখ টাকার মতো ব্যয় হয়েছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৭-৮ লাখ টাকার বেশি পান বিক্রি করেছেন বলে জানান তিনি।
রায়পুর উপজেলার উত্তর চরবংশী ইউপি চেয়ারম্যান আবুল হোসেন জানান, এখানকার উৎপাদিত পান সুস্বাদু হওয়ায় বাজারে এর চাহিদা ও দাম বেশি। পান চাষকে ঘিরে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা বদলে যাচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর লক্ষ্মীপুরের উপ-পরিচালক বেলাল হোসেন খাঁন বলেন, পান চাষে রোগবালাই ও ঝুঁকি কম থাকায় স্থানীয় কৃষকদের মাঠ পর্যায়ে পরামর্শ দিচ্ছে কৃষি বিভাগ। লাভজনক হওয়ায় দিন দিন এ অঞ্চলে পান চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এবার উৎপাদিত পান থেকে প্রায় ৭০ কোটি টাকা আয় হবে বলে জানালেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা।
স্থানীয়দের দাবি, প্রয়োজনীয় ঋণ সুবিধা ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে লক্ষ্মীপুরের উৎপাদিত পান রপ্তানি করে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখা সম্ভব।