‘ভেনামি’ চিংড়ি। অল্প পরিশ্রম ও কম খরচে বেশি উৎপাদন, সহজলভ্য এবং খেতে সুস্বাদু এই প্রজাতির চিংড়ি। জন্ম ভিয়েতনামে। তবে, বিচরণ এশিয়ার সব দেশেই। বিশ্বের পুরো চিংড়ির বাজার এখন ‘ভেনামি’র দখলে। তবে, একমাত্র ‘বাংলাদেশ’ বাদে বাকি ১৪টি দেশেই এটি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন হচ্ছে। এই মুহূর্তে আমাদের দেশে এ প্রজাতির চিংড়ি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন সময়ের দাবি।
চিংড়ি চাষি ও রপ্তানিকারকরা বলছেন, দেশে বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম খাত চিংড়ি শিল্পকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে ‘ভেনামি’ চাষের কোনো বিকল্প নেই। একমাত্র ‘ভেনামি’ই পারে দেশের চিংড়ি শিল্পের সম্প্রসারণ করে বিশ্ব বাজার ধরে রাখতে। দ্রুত একটি সহজ নীতির মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে ‘ভেনামি’ চিংড়ি চাষকে উন্মুক্ত করে রপ্তানির পদক্ষেপ নিতে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তারা।
এদিকে বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন এক পরিসংখ্যানে উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশে বাগদা চিংড়ির গড় উৎপাদন হেক্টর প্রতি ৩৪১ কেজি। সেখানে প্রতিবেশি দেশ ভারতে ‘ভেনামি’ চিংড়ির হেক্টর প্রতি গড় উৎপাদন ৭ হাজার ১০২ কেজি। অর্থ্যাৎ বাগদার তুলনায় ‘ভেনামি’র উৎপাদন হেক্টর প্রতি ৬ হাজার ৭৬১ কেজি বেশি। যার প্রমাণ মিলেছে খুলনায় প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলকভাবে চাষকৃত ‘ভেনামি’র উৎপাদনে। তবে, নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে উৎপাদন কিছুটা বাঁধাগ্রস্ত হলেও দেশে এর সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে বলেই মনে করছে চিংড়ি রপ্তানিকারকদের বৃহৎ এ প্রতিষ্ঠানটি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাগদা ও গলদা চিংড়ির উৎপাদন দিন দিন কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশ হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানির প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। এ কারণে ইতোমধ্যে সাদা সোনা খ্যাত চিংড়ি শিল্পে অশনি সংকেত দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে বিশ্ব বাজারে ভেনামি চিংড়ির দাম কমের পাশাপাশি পর্যাপ্ত চাহিদা থাকায় দেশের রপ্তানিকারকরা বাজার ধরে রাখতে পারছে না। যে কারণে আন্তর্জাতিক বাজার ধরে রাখার পাশাপাশি চিংড়ি শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন বিগত প্রায় ২০ বছর ধরে ভেনামি চিংড়ি চাষের অনুমতির জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানিয়ে আসছে। যার ফলে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে এই জাতের চিংড়ি চাষের অনুমতি দেয় সরকার। অনুমোদনপ্রাপ্ত যশোর বিসিক শিল্প নগরের ‘এম ইউ সী ফুডস’ ও সাতক্ষীরার বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘সুশীলন’ যৌথ উদ্যোগে মৎস্য অধিদপ্তর ও মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধীনে খুলনার পাইকগাছা লোনা পানি কেন্দ্রে পরীক্ষামূলকভাবে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
লোনা পানি কেন্দ্রের ৪টি পুকুরে চলছে নতুন প্রজাতির এ চিংড়ির চাষ। সেখানে চলতি বছরের এপ্রিলের শুরুতে প্রায় ৮ লাখ ভেনামি চিংড়ির পোনা ছাড়া হয়। এর আগে ৩১ মার্চ থাইল্যান্ড থেকে বিমানে করে এই পোনা আনা হয়। ইতোমধ্যেই দু’টি পুকুর থেকে চিংড়ি ধরা হয়েছে। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার (৮ জুলাই) দ্বিতীয় পুকুরের চিংড়ি ধরা হয়। যার উৎপাদন সন্তোষজনক বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, খুলনার পাইকগাছা লোনা পানি কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও কেন্দ্র প্রধান ড. মো. লতিফুল ইসলাম রাইজিংবিডিকে বলেন, ভেনামি চিংড়ি চাষের জন্য সরকারের নির্দেশে লোনা পানি কেন্দ্রের ৬টি পুকুর উদ্যোক্তাদের দেওয়া হয়। ২০২০ সালে এ কার্যক্রম শুরু করার কথা থাকলেও করোনার কারণে ২০২১ সালের ৩১ মার্চ প্রথম চিংড়ি ছাড়া হয়। তবে তারা ২টি পুকুর রিজার্ভ রেখে বাকি ৪টি পুকুরে মাছ চাষ করে। ৭ লাখ ৭২ হাজার ৮০০টি পোনা আসে থাইল্যান্ড থেকে। প্রথম পুকুরে কিছুটা উৎপাদন কম হলেও দ্বিতীয় পুকুরে আরও ভালো হয়েছে। পরবর্তী সময়ে আরও দুটি পুকুরের উৎপাদন আরও ভালো হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।
চিংড়ি বিশেষজ্ঞ প্রফুল্ল সরকার (অব. উপ-পরিচালক, মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ) জানান, প্রতি সপ্তাহে চিংড়ির বৃদ্ধি এবং রোগবালাই অনুসন্ধানে নমুনা পরীক্ষা করা হয়। চলতি বছর তাপমাত্রা বেশি থাকায় কিছুটা শঙ্কা থাকলেও নিয়মিত পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে এই চিংড়ির রোগ প্রতিরোধ এবং জীবনধারণ ক্ষমতা বাগদা চিংড়ির তুলনায় অনেক বেশি। পোনা ছাড়ার পর ৭ সপ্তাহ পর্যন্ত রোগবালাইয়ে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকলেও এ প্রকল্পে তেমনটা দেখা যায়নি।
খুলনা ফিস ইন্সপেকশন ও কোয়ালিটি কন্ট্রোল ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি ডিরেক্টর মজিনুর রহমান বলেন, ভেনামি চিংড়ির গ্রোথ ও ফার্টিলিটি রেট খুবই আশাব্যঞ্জক। এই চিংড়ির উৎপাদন সময়কাল ১২০ দিন। যার মধ্যে প্রথম ৬০ দিন যে পরিমাণ বৃদ্ধি হয় পরবর্তী ৬০ দিনে তার ৩ গুণের বেশি বৃদ্ধি হয়। সাধারণ পুকুরে প্রতি হেক্টরে ৩০০-৪০০ কেজি বাগদা উৎপাদন হয়। অন্যদিকে একই পরিমাণ জমিতে ৭ থেকে ৮ হাজার কেজি এই চিংড়ি উৎপাদন সম্ভব। পাশাপাশি গলদা ও বাগদা বছরে একবার চাষ হয়, কিন্তু একই জমিতে ভেনামি চাষ করা যায় বছরে তিনবার।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট এস. হুমায়ুন কবীর বলেন, কাঁচামালের (চিংড়ি) অভাবে ইতোমধ্যেই দেশের ১০৫টি হিমায়িত মৎস্য প্রক্রিয়াজাত ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোনোরকমে চালু আছে মাত্র ২৮টি। বাকি ৭৭টিই বন্ধ হয়ে গেছে। যেকয়টি চালু আছে, তাতে দেশে উৎপাদিত চিংড়িতে সক্ষমতা ও ধারণ ক্ষমতার মাত্র ১০-১৫ ভাগ চাহিদা মিটছে। ফলে প্রক্রিয়াজাত খরচও বেশি হচ্ছে। এ অবস্থায় রপ্তানির এ খাতটি ‘খাদের কিনারে’ এসে দাঁড়িয়েছে। এ শিল্পকে মাথা উঁচু করে ঘুরে দাঁড়াতে হলে ভেনামি চাষ করে চিংড়ির উৎপাদন বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই।
ফ্রোজেন ফুডসের পরিচালক এবং বাংলাদেশে নিবিড়-আধানিবিড় বাগদা চিংড়ি চাষের প্রবর্তক এম এ হাসান পান্না বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে বাগদার চাহিদা ক্রমাগত কমে যাচ্ছে। ভেনামির উৎপাদন খরচ বাগদার থেকে কম এবং বড় হওয়ার সময়কালও কম। তবে ভেনামি চিংড়ি চাষ করতে হলে দেশেই এর এসপিএফ পোনা উৎপাদনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তবেই প্রান্তিক চাষি পর্যায়ে ব্যাপকভাবে এর বিস্তার লাভ করবে। সরকারের অনুমতি পেলে তিনি নিজেই বাণিজ্যিকভাবে ‘মডেল’ হিসেবে ভেনামির পোনা উৎপাদন ও চাষ সম্প্রসারণ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন তিনি।
দেশের প্রথম ভেনামি চিংড়ি চাষের উদ্যোক্তা যশোরের এমইউ সী ফুডসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শ্যামল দাস বলেন, ৩৩ বিলিয়ন ডলারের চিংড়ির বিশ্ববাজার। যার ৮০ ভাগই দখল করে নিয়েছে ভেনামি চিংড়ি। আমাদেরকে লড়তে হয় মাত্র ২০ শতাংশ বাজারের জন্য। সেখানেও নানা প্রতিকূলতায় বাজারের দর পতনের কারণে চিংড়ির উৎপাদন এবং রপ্তানিতে পিছিয়ে যাচ্ছি আমরা। বিশ্ববাজারের চাহিদার কথা বিবেচনাসহ দেশে এ শিল্প টিকিয়ে রাখতে ভেনামি চিংড়ি চাষের কোনো বিকল্প নেই বলেও উল্লেখ করেন তিনি।