বেলাই বিল। গাজীপুর জেলার সদর ও কালীগঞ্জ উপজেলার ঠিক মাঝখানে এ বিলের অবস্থান। বাড়িয়া, ব্রাহ্মণগাঁও, বরক্তাপুর ও বামচিনি মৌজা গ্রাম ঘেরা বেলাই বিলে আজ থেকে ৪০০ বছর আগে গ্রামের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। খরস্রোতা চিলাই নদীর কারণে বিলটিও খরস্রোতা হিসেবে বিরাজমান ছিল।
বর্তমানে বিলটি ৮ বর্গমাইল এলাকায় বিস্তৃত হলেও আগে আরও বড় ছিল। বিশাল এই বিলটির কোনো কোনো স্থানে প্রায় সারাবছরই পানি থাকে, তবে বর্ষায় এর রূপ বেড়ে যায় অনেকাংশে। জেলেরা বিলে চারপাশে ডাঙ্গি খনন করে মাছ ধরেন। আর শুষ্ক মৌসুমে বিলটি হয়ে ওঠে একফসলী জমিরূপে। তখন বোরো ধানের চাষাবাদ করা হয়। ঢাকার কাছে উন্নত ভূমির যেসব বিল রয়েছে, তারমধ্যে বেলাই বিল রূপ-সৌন্দর্যে অনন্য।
এ বিলকে ঘিরেই স্থানীয় হাজারো কৃষকের স্বপ্ন। কৃষকরা এই বিলে বোরো ধান চাষ করে নিজের এবং স্থানীয়দের খাদ্য চাহিদা মেটান। কিন্তু বর্ষাকালে এই বিল হয়ে ওঠে পানিতে টইটুম্বুর। তখন এই বিলকে ঘিরেই কর্মসংস্থান হয় স্থানীয় শত শত মানুষের। বর্ষায় কেউ মাছ ধরে আবার কেউ শাপলা সংগ্রহ করে তাদের কর্মসংস্থান তৈরি করে। আবার বর্ষা মৌসুমে কৃষকের সেই স্বপ্নের মাঠ আর কর্মসংস্থানের জায়গাটি হয়ে যায় স্থানীয়দের নিকলি। অনেকে আবার একে গরীবের নিকলিও বলে থাকেন।
যে দিকে দু’চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। বর্ষা মৌসুমেই দেখা মেলে এমন দৃশ্য। তাই তো জেলার আশেপাশের উপজেলার মানুষ ছুটে আসেন এই বিলে। সাদা ও নীল শাপলা আর শালুকে ভরা বেলাই বিল। স্বচ্ছ টলটলে পানি। এসময় ইঞ্জিনচালিত ও ডিঙি নৌকা দুটোই পাওয়া যায়। কেউ কেউ আবার ছোট লঞ্চও নিয়ে আসেন বিলে। তবে ইঞ্জিনের শব্দের চেয়ে শব্দবিহীন ডিঙি নৌকাই ভালো। দূরের সারি সারি তালগাছ নৌকায় বসে দেখতে বেশ সুন্দর লাগে। যাত্রীরাও তখন সেলফি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
কালীগঞ্জ খেয়াঘাট থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে বেলাই বিলে ঘুরতে এসেছেন ঢাকার একটি বেরকারি সংস্থায় কর্মরত আবু জাফর সোহেল। একই নৌকায় তার সাথে এসেছেন কালীগঞ্জের একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নাজমুল ইসলাম, স্থানীয় একজন ব্যাংক কর্মকর্তা সুবজ মিয়া, ঢাকায় কর্মরত কাউছার আহমেদ জয়, নেত্রকোনায় কর্মরত আরিফুল ইসলাম সুমন, ব্যবসায়ী নুরুল ইসলাম, সৌরভ, শ্রমজীবী সাইফুর রহমান ও মোক্তার হোসেন। কালীগঞ্জ খেয়াঘাট থেকে অপর আরেকটি ইঞ্জিন চালিত নৌকা নিয়ে বেলাই বিলে ঘুরতে এসেছেন পৌর এলাকার মুনশুরপুর গ্রামের বাসিন্দা মুন্না ও তার বন্ধুরা।
আবু জাফর সোহেল জানান, ঈদের পর গত ২৩ জুলাই থেকে কঠোর লকডাউনের কারণে অফিস বন্ধ। বাড়িতে বসে থাকতে থাকতে হাপিয়ে উঠেছি। তাই ছোট-বড় ভাই ও বন্ধুদের নিয়ে বেলাই বিলে ঘুড়তে এসেছি। আসলে বর্ষায় একটি ফসলের মাঠ যে এত রূপ-সৌন্দর্যে ভরপুর হতে পারে তা নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। তাছাড়া কালীগঞ্জ খেয়াঘাট থেকে নৌকা নিয়ে শীতলক্ষ্যা নদী হয়ে বেলাই বিলে যাওয়া পর্যন্ত খালের দু’পাশের সবুজ মনোরম দৃশ্য সত্যি অন্যরকম।
কাজে সবসময় ব্যস্ত থাকেন ঘোরাঘুরি করতে খুব একটা সময় পান না। তাই এই লকডাউনে অফিস বন্ধ থাকায় বন্ধুদের নিয়ে বেলাই বিলে ঘুরতে এসেছেন বলে জানান নাজমুল ইসলাম।
মুন্না বলেন, ঈদের পর কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি। ভেবেছিলাম কিশোরগঞ্জের নিকলি যাবো। কিন্তু দেশের এই পরিস্থিতির কারণে বন্ধুদের নিয়ে গরীবের নিকলি বেলাই বিলেই নৌকা নিয়ে ঘুরতে আসলাম।
কালীগঞ্জ উপজেলার তুমলিয়া ইউনিয়নের রাজনগর গ্রামের বাসিন্দা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী রানা সরকার বলেন, খালের পাশেই আমার বাড়ি। বর্ষায় শীতলক্ষ্যা নদী ও বেলাই বিলের পানি বেড়ে খালটিও ভরে যায়। আর এই খাল দিয়ে প্রতিদিন বহু ইঞ্জিনচালিত নৌকা বেলাই বিলে যায়। দেখতে যেমন ভালো লাগে, তেমনি নৌকা চালকদের বেশ আয়ও হয়। তবে বেলাই বিলের রূপ-সৌন্দর্য উপভোগের জন্য বর্ষার সময় এই বিলকে পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে।
কালীগঞ্জ খেয়াঘাটের মাঝি জামান মিয়া জানান, সাধারণত বর্ষা মৌসুম আসলে তাদের একটু বাড়তি আয় হয়। বিশেষ করে বিকেল হলে খেয়াঘাটে এসে নানা বয়সী মানুষ নৌকা ভাড়া করে ভাদার্ত্তী খাল হয়ে বেলাই বিলে যায়। এ মৌসুমে প্রতিদিনই তাদের ব্যস্ত থাকতে হয়। ১৫০০/২০০০ টাকা হলে নৌকা নিয়ে বেলাই বিল ঘুরে আসা যায় বলেও জানান তিনি। মাঝি জামানের মতো একই কথা বললেন কালীগঞ্জ খেয়াঘাটের মাঝি মনির ও বকুল।
যাবেন যেভাবে
ঢাকার যেকোনো জায়গা থেকে উঠে পড়ুন গাজীপুরের বাসে। গাজীপুর বাসস্ট্যান্ডে অথবা গাজীপুর শিববাড়ি নেমে সিএনজি কিংবা রিকশা করে চলে যান কানাইয়া বাজার। কানাইয়া বাজার ঘাটে বেলাই বিলের নৌকা থাকবে, দরদাম করে উঠে পড়বেন৷ এছাড়া কেউ যদি সিলেট বা চট্টগ্রাম থেকে আসতে চান তাহলে পাঁচদোনা-ঘোড়াশাল হয়ে কালীগঞ্জ বাইপাস বড়নগর বাসন্ট্যান্ডে নেমে সেখান থেকে রিকসা নিয়ে সরাসরি কালীগঞ্জ খেয়াঘাট চলে আসতে পারেন। সেখানে সারি সারি ইঞ্জিনচালিত নৌকা রয়েছে৷ তবে এখান থেকে ভাদার্ত্তী খাল হয়ে বেলাই বিলে যাবেন। যাওয়ার পথে খালের দু’পাশের সবুজ দৃশ্য আপনার মন কাড়তে বাধ্য।
খাবেন যেখানে
বিলের আশেপাশে চা, বিস্কুট আর চিপস ছাড়া ভালো কোনো কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। তাই নিজের ইচ্ছামতো খাবার সঙ্গে রাখুন।
ঢাকার কাছেই যেহেতু, দিনে গিয়ে দিনে আসা যাবে, তাই থাকার ব্যবস্থার কথা না ভাবাই ভালো। সময় থাকলে হাতে নদীর পাশে অবস্থিত ভাওয়াল পরগণা নামে শ্মশান ঘাট/শ্মশান বাড়ি দেখতে যেতে পারেন।