নরসিংদীতে হলুদ রঙের (গেন্ডারি) আখ চাষ করে ভাগ্যবদলের স্বপ্ন হাজারো কৃষকের। ফলে অন্যান্য ফসলের চেয়ে দীর্ঘ মেয়াদী হলেও লাভ বেশি হওয়ায় ক্রমেই জেলাজুড়ে প্রতিবছরই বাড়ছে আখ চাষের সংখ্যা।
স্থানীয় কৃষি বিভাগ বলছে, আবহাওয়া ও মাটির গুণাগুণের কারণে আশানুরূপ ফলন ও বাজারে বেশ চাহিদা থাকায় দিন দিন আখ চাষের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। তবে কৃষকরা বলছেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে অচিরেই অধিক হারে পতিত জমিতে চাষ আরও সম্প্রসারণ সম্ভব।
আখ একটি রসালো ও মিষ্টি জাতের খাবার। এ জেলার আখ খেতে খুবই মিষ্টি ও সুস্বাদু হওয়ায় সব জেলার মানুষের কাছে খুব জনপ্রিয়। তাই স্থানীয় মানুষের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি অন্যান্য জেলায়ও সরবরাহ করা হচ্ছে এখানকার আখ।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, একসময় নরসিংদীর আখের খ্যাতি ছিল। এখানকার আখের উপর ভিত্তি করে একটি চিনির কলও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু চিনির কল বন্ধ হয়ে যাওয়াসহ নানা কারণে আখ চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন কৃষকেরা। এতে করে আখের জায়গা দখল করে নেয় অন্যান্য ফসল। তবে এখন আখের চাহিদা বাড়ছে। বাজারে ন্যায্য মূল্যও পাওয়া যাচ্ছে। ফলে অন্যান্য ফসলের তুলনায় বেশি লাভ হওয়ায় দীর্ঘ দিন পর আবারও আখ চাষের প্রতি আগ্রহী হচ্ছেন কৃষকরা।
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে জেলায় ১৪০ হেক্টর জমিতে আখের চাষ হয়েছে। এক বছর আগে তা ছিল ১৩৫ হেক্টর এবং ৫ বছর আগে ছিল মাত্র ৮০ হেক্টর। এ বছর কৃষি সম্প্রাসার অধিদপ্তরের দেওয়া ঈশ্বরদী ১৫, ১৭, ২৭ এবং বিএসআরআই-১ জাতের আখের চারা রোপণের ফলে চলতি মৌসুমেই আখ চাষে বাম্পার ফলন পেয়েছেন কৃষকরা।
তুলনামূলক কম খরচ ও শ্রমের পাশাপশি অনুকূল আবহাওয়া ও মাটির গুণাগুণের কারণে আখের আশানুরূপ ফলন হচ্ছে। তাছাড়া অন্যান্য ফলের চেয়ে খরচ এবং শ্রম কম থাকার পাশাপাশি বাজারে ব্যাপক চাহিদার ফলে মৌসুমী এই ফল বাণিজ্যিকভাবে চাষ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন জেলার অনেক কৃষক।
বিঘা প্রতি ৩০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা খরচ করেই বিক্রি হচ্ছে দেড় থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত। খুচরা বাজারে আকারভেদে প্রতিটি আখ বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ১৫০ টাকায়। এতে কৃষকদের লাভের পাশাপাশি বছরে তিন মাস বাজারে আখ বেচাকেনা করে লাভবান হচ্ছেন খুচরা ও পাইকারী ক্রেতা-বিক্রেতারাও।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কেউ জমি থেকে আখ কাটছেন, কেউ আঁটি বাঁধছেন, কেউ আবার আখের আঁটিগুলো ভ্যান গাড়িতে তুলে দিচ্ছেন। এই জেলার আখ স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ হচ্ছে।
আখ চাষিরা বলেন, আমাদের এলাকার মাটিতে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম ও খনিজ উপাদান বিদ্যমান থাকায় এখানকার মাটি ও আবহাওয়া আখ চাষের জন্য খুবই উপযোগী। তবে ঝড়-তুফানে কোনো ক্ষতি না করলে আখ চাষ নিয়ে তেমন কোনো ক্ষতিতে পড়তে হয় না। তাছাড়া আখ চাষে সার ও কীটনাশক তেমন ব্যবহার করতে হয় না। তবে পর্যাপ্ত সেচের প্রয়োজন হয়। স্বল্প পরিশ্রম ও কম খরচে আখ চাষে বেশি লাভবান হওয়া যায়। আখের সঙ্গে সাথি ফসল হিসেবে অন্য ফসলও চাষ করা যায়।
আখ চাষ পদ্ধতি সম্মর্কে কৃষকরা আরও বলেন, আখ চাষ করতে প্রথমে জমি ৩ থেকে ৪ বার চাষ দিয়ে কয়েকবার মই দিয়ে প্রস্তুুত করে নিয়ে হয়। যেহেতু আখের জমিতে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন, সেজন্য সমস্ত জমিকে ১৫.১ মিটার প্রশস্ত ৩১ থেকে ৬২ মিটার দৈর্ঘ্যে ভাগ করে নিয়ে নিষ্কাশনের জন্য নালা কেটে নিতে হয়। পরে কার্তিক-অগ্রহায়ণ থেকে শুরু করে ফাল্গুন-চৈত্র মাস পর্যন্ত আখ চারা বপন করা হয়।
শিবপুর উপজেলার মুন্সেফেরচর এলাকার আখ চাষি জাকির হোসেন বলেন, আগে যেখানে অন্য ফসলের চাষ করতাম, সেখানে এখন আখের চাষ করি। এ মৌসুমে এক বিঘা জমিতে আখ চাষ করেছি। এতে খরচ হয় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। ফলন ভালো হয়েছে, এক থেকে দেড় লাখ টাকা আখ বিক্রি করতে পারবো।
একই এলাকার আখ চাষি হিরণ মিয়া জানান, জেলার মধ্যে সবচে বেশি আখ চাষ হয় শিবপুর উপজেলায়। এখানকার আখ সুস্বাদু। তাই বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকারা এসে জমি থেকেই কিনে নিয়ে যান। তিনি চলতি মৌসুমে ৩৫ শতাংশ জমিতে আখ চাষ করছেন, এতে তার খরচ হয়েছে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। তিনি এ জমির আখ বিক্রি করতে পারবেন দেড় লাখ থেকে ২ লাখ টাকা।
আখ চাষি আসাদ মিয়া বলেন, আমাদের আখের বাজারজাত নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা করতে হয় না। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা জমি থেকে কিনে নেন যান। জমি কেনার পদ্ধতিও চমৎকার। প্রথমে কৃষকের কাছ থেকে একদল পাইকার দামদর করে শতাংশ হারে ক্রয় করেন। পরে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা জমি থেকে আখ কেটে বাজারে বিক্রি করেন। জমি থেকে প্রকারভেদে আখ পাইকারী দরে ১০০ আখ ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা বিক্রি হয়।
শিবপুর চরপিতাম্বদী এলাকায় কথা হয় আখ পাইকারী ক্রেতা আতাউর রহমানের সাথে। তিনি জানান, তিনি এক কৃষকের কাছ থেকে ৫ শতাংশ আখ চাষ করা জমি ১৮ হাজার টাকায় ক্রয় করছেন। জমি থেকে তার নিজ দায়িত্বে আখ কেটে নিয়ে যাচ্ছেন। এ আখ তিনি সিলেট, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনাসহ বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করবেন। এছাড়া এখানকার আখ রাজধানী ঢাকা, গাউছিয়া ও ভৈরবসহ বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করা হয়।
শিবপুর ইটাখোলা গোলচত্তর এলাকায় খুচরা আখ ব্যবসায়ী ফারুক আহম্মেদ বলেন, এখন আখের বাজার ভালো। তিনি সাড়ে ৩ লাখ টাকা দিয়ে দুইটি আখ খেত কিনেছেন। এর মধ্যে একটি খেতের আখ ২ লাখ টাকা বিক্রি করেছেন। আর একটি আখ খেত ৩ লাখ টাকা বিক্রি করতে পারবেন বলে তিনি আশা রাখছেন।
নরসিংদী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাহাবুবুর রশিদ বলেন, আখ চাষে সার ও কীটনাশক তেমন ব্যবহার করতে হয় না। তবে পর্যাপ্ত সেচের প্রয়োজন হয়। স্বল্প পরিশ্রম ও কম খরচেই আখ চাষ করে বেশি লাভবান হওয়া যায়। এছাড়া আখের সঙ্গে সাথী ফসল হিসেবে অন্য ফসলও চাষ করা যায়। আখ চাষে উদ্বুদ্ধ করতে চাষিদের নানাভাবে প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে কৃষি বিভাগ।