অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ রাশেদ আল মামুন। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি অনুষদের ডিন এবং কৃষি শক্তি ও যন্ত্র বিভাগের চেয়ারম্যান। ইতোমধ্যে তিনি দেশের কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ও আধুনিক করতে বিভিন্ন গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
গবেষণা দলে সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. তৌফিকুর রহমান ও মো. জানিবুল আলম সোয়েব এবং শিক্ষার্থী মারিয়া সুলতানা জেনিন, তানজিনা রহমান মিম, মো. রাইসুল ইসলাম রাব্বী, মো. নুরুল আজমীর, মিনহাজ উদ্দিন নয়ন, রুকন আহমেদ ইমন, শঙ্খরুপা দে, জিনাত জাহান, আনিকা তাসনিম, শহিদুল বাসার, আসিফ আল রাযী নাবিল, সাদিয়া আশরফি ফাইরুজ, সাদিকুর রহমান, আবু হানিফ, মো. আলমগীর আলম, সাব্বাহ তাহসিন চৌধুরী ও তুহিনুল হাসান।
তিনি আধুনিক কম্পিউটার ভিশনের মাধ্যমে চায়ের ইমেজ প্রসেসিং প্রযুক্তি দিয়ে চায়ের দানার টেক্সচারাল ফিচার এবং বাহ্যিক গুণাগুণের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন চায়ের চারটি গ্রেডকে নির্ভুলভাবে নির্ণয়ের পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। সেচ ব্যবস্থাকে সহজ করে আবাদি জমিতে সঠিক মাত্রায় আর্দ্রতা বজায় রাখার লক্ষ্যে মাইক্রোকন্ট্রোলারে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ব্যবহার করে উদ্ভাবন করেছেন স্বয়ংক্রিয় সেচযন্ত্র। এর মাধ্যমে প্রয়োজন অনুযায়ী মাটির আদ্রর্তা ও পানির উচ্চতা পরিমাপ করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাম্প চালু এবং বন্ধ হবে। ভিন্ন ভিন্ন শস্যের ক্ষেত্রে পানির চাহিদা অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন আদ্রর্তা ও উচ্চতায় এই যন্ত্রের সুবিধা নেওয়া যাবে।ফলে কৃষকরা সময় সাশ্রয়ের পাশাপাশি আর্থিকভাবে লাভবান হবেন।
মাইক্রো-কন্ট্রোলার ভিত্তিক স্মার্ট অটোমেশন সিস্টেম এবং স্বয়ংক্রিয় ডিম ঘুরানোর পদ্ধতি সংযোজিত করে ডিমের প্রকার ও প্রজাতি ভেদে আলাদা আলাদা তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নির্ধারণ করার মাধ্যমে অধিক সুস্থ ও সবল বাচ্চা উৎপাদন করার লক্ষ্যে উদ্ভাবন করেছেন অত্যাধুনিক ইনকিউবেটর। এটি দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার প্রোটিনের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি গ্রামীণ পর্যায়ে পোল্ট্রি ব্যবসাকে আরও লাভজনক ও জনপ্রিয় করবে।
বাংলাদেশে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নের লক্ষ্যে লাকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি উদ্ভাবনও করেছেন তরুণ বিজ্ঞানী ড. রাশেদ। দেশে প্রতিদিন ব্যাপক পরিমাণ চা, মাছ ও গবাদিপশুর বর্জ্য তৈরি হয়। যা সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে পরিবেশের উপর নানাবিধ ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। এমনকি এটা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। এই বর্জ্য পচে প্রচুর পরিমাণে মিথেন গ্যাস নির্গত হয়, যা গ্রিনহাউজ গ্যাস হিসেবে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের চেয়ে ২৫ গুণ বেশি ক্ষতিকর। অথচ মাছের বর্জ্য, চায়ের বর্জ্য ও গবাদিপশুর বর্জ্য মিশিয়ে ৬৫ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন করা সম্ভব।
এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ২০১৫ সালে প্রায় ৩০.২১ মিলিয়ন গরু ও মহিষ, ২৫.৬৯ মিলিয়ন ছাগল ও ভেড়া, এবং ১৬০.৭০ মিলিয়ন পোল্ট্রি রয়েছে, যা থেকে প্রায় ১০ বিলিয়ন কেজির মতো বর্জ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হতো। যদি এর ৫০ শতাংশ বর্জ্যও নবায়নযোগ্য জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়, তবে তা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।
এদিকে বছরের অর্ধেকটা সময় বিশেষ করে বর্ষায় জলাবদ্ধতার কারণে দেশের প্রায় ৩০ লাখ হেক্টর জমি অনাবাদি থাকে। ফলে জলাবদ্ধ জমিতে কোনো কৃষিকাজ হয় না। সেসব এলাকায় এই সময়টুকুতে কোনো কর্মসংস্থানেরও সুযোগ থাকে না। এসময় জমিতে উৎপাদন না হওয়ায় কৃষকের লোকসানসহ ঘাটতি দেখা দেয় শাক-সবজি ও অন্যান্য খাদ্যসামগ্রীর। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও চাষযোগ্য জমির পরিমাণ দিন দিন হ্রাস পাওয়ার ঝুঁকি মোকাবিলা করে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি দেশের হাওরাঞ্চলসহ নিম্নাঞ্চলে বছরব্যাপী কৃষিকাজ অব্যাহত রাখতে উলম্ব ভাসমান খামারে (ভার্টিক্যাল ফ্লটিং বেড) একক স্থান হতে অধিক ফসল উৎপাদন করে ক্রম-হ্রাসমান ভূমির উপর চাপ কমানোর এক অভিনব প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন ড. রাশেদ।
এ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বন্যাক্রান্ত অঞ্চলে বদ্ধ পানির উপর কাঠামোটি ভাসিয়ে কৃষকরা অনায়াসেই চাষাবাদ করতে পারবেন। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর কাঠামোটি শুকনো অনাবাদি জমির উপর স্থাপন করে কৃষিকাজ সচল রাখতে সক্ষম হবেন। সম্পূর্ণরূপে অব্যবহার্য জলাবদ্ধ ভূমির উপর কাঠামোটি স্থাপন করে কয়েকটি উলম্ব স্তরে চাষাবাদ করার ফলে কম জায়গা ব্যবহার করে অধিক ফলন নিয়ে আসা যাবে, যা গতানুগতিক চাষাবাদ পদ্ধতিতে পাওয়া অসম্ভব। সাশ্রয়ী এবং সহজলভ্য উপাদান দিয়ে তৈরি এই কাঠামোটি দীর্ঘ দিন ধরে ব্যবহার করা যাবে।
এখনো পর্যন্ত দেশে টমেটো সংরক্ষণের জন্য অত্যাধুনিক কোনো পদ্ধতি নেই, ফলে কৃষকরা ফসল উৎপাদনের পর যথাযথ পদ্ধতিতে সংরক্ষণের অভাবে অনেক টমেটো পচে যায়। তারা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। এ সমস্যা দূর করতে টমেটোর জন্য বিশেষভাবে মিনি কোল্ড স্টোরেজ তৈরি করা হয়েছে, যেখানে ২০ দিন পর্যন্ত টমেটো সংরক্ষণ করা সম্ভব। এক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কাঁচামাল ব্যবসায়ীরা তাদের অবিক্রিত টমেটো সংরক্ষণের মাধ্যমে গুণগত মান অক্ষুন্ন রেখে ভোক্তাদের সরবরাহ করতে পারবেন।
আবার শীতকালীন রবি শস্য, যেমন ফুলকপি, বাঁধাকপি, শিম, বেগুন ইত্যাদি উৎপাদন করার পর পরিবহন জনিত সমস্যার কারণে যথাসময়ে পণ্য বাজারজাত করা সম্ভব হয় না, ফলে এসব পণ্য পচে যাওয়ার কারণে কৃষকরা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এ সমস্যা সমাধানে অল্প খরচে ইভাপোরেটিভ কুলিং চেম্বার স্থাপন করে ৭ থেকে ১০ দিন সংরক্ষণ করা সম্ভব, যাতে পণ্যের গুণগত মান অক্ষুন্ন থাকে এবং তৃণমূল কৃষক সম্ভাব্য লোকসান থেকেও বাঁচতে পারে।
অব্যবহৃত ফুড অ্যান্ড বেভারেজের অ্যালুমিনিয়াম ক্যানগুলো দিয়ে স্বল্প খরচে সোলার ড্রায়ার তৈরি করে মৌসুমি কৃষিজাত পণ্য ও বীজ বছরজুড়ে সংরক্ষণ করা যাবে। যা একদিকে পরিবেশ দূষণ রোধ করবে এবং অপর দিকে কৃষিপণ্যের অপচয় কমানো সম্ভব হবে। এছাড়াও যেসব অঞ্চলে গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট বিদ্যমান, সেসব অঞ্চলে উদ্ভাবিত সোলার কুকার দিয়ে রান্নাবান্নার কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব। এতে জীবাশ্ম জ্বালানি দিয়ে পরিবেশ দূষণ রোধসহ গ্যাস বিদ্যুৎ চালিত চুলা কিংবা লাকড়ির চুলার জন্য যে অর্থের প্রয়োজন হয়, তা সাশ্রয় হবে। নগর জীবন ও গ্রামীণ অঞ্চলে সোলার কুকার ব্যবহারের মাধ্যমে জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করা সম্ভব হবে।
ড. রাশেদ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসি, এমএস ইন ফার্ম পাওয়ার অ্যান্ড মেশিনারি, জাপানের কুমামোতু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যাডভান্সড টেকনোলজি (নবায়নযোগ্য জ্বালানি) বিষয়ের উপর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন এবং একই বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রাউন্ড ওয়াটার লিডারশিপ প্রোগ্রামে রিসার্চ সায়েনটিস্ট হিসেবে গবেষণা করেন।
তিনি জাপানের মনবুকাগাকুশু, কুমামোতু বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরাল কোর্স ও জাসসু স্কলারশিপ এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি-জেএসপি) ও এশিয়ান ইনিস্টিটিউশন অব টেকনোলজি ফেলোশিপ অর্জন করেন। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের সম্মানিত সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। বর্তমানে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন কাউন্সিলের সম্মানিত আহবায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
তিনি জাপান, ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ড. রাশেদ ইতোমধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উপর একটি বই লিখেছেন এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তার ৪০টির বেশি পিয়ার রিভিউড বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রবন্ধ বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন কনফারেন্স, সেমিনার, সিম্পজিয়াম ও ওয়ার্কশপে বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন তিনি।
তিনি নিউজিল্যান্ড, আমেরিকা ও সিংগাপুরে অনুষ্ঠিত কনফারেন্সে এক্সিলেন্ট ও বেস্ট রিসার্চ পেপার অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। তিনি কুমামোতু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট (জাপান) অ্যাওয়ার্ড, কিংডম অব সৌদি এরাবিয়া (মরক্কো) অ্যাওয়ার্ড, ভেনাস ইন্টারন্যাশনাল রিসার্চ অ্যাওয়ার্ড (ভারত) থেকে আউটস্টেন্ডিং সায়েনটিস্ট ইন ফার্ম পাওয়ার অ্যান্ড মেশিনারি শীর্ষক আর্ন্তজাতিক পদকসহ সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেস্ট পাবলিকেশন (বাংলাদেশ) অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন।
তিনি চলমান গবেষণার পাশাপাশি দেশে কৃষি উন্নয়নের লক্ষ্যে এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড বায়োসিস্টেমস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের উপর কাজ করার বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। বিশেষ করে নবায়নযোগ্য জ্বালানি, প্রিসিশন এগ্রিকালচার, লাকসই কৃষিপণ্য উৎপাদন, পোস্ট-হারভেস্ট ম্যানেজমেন্ট, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ বিষয়ে গবেষণা পরিচালনা করার লক্ষ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতা কামনা করেন।
ড. রাশেদ গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দুই কন্যা সন্তানের জনক। ১৯৯৭ সালে কালীগঞ্জ রাজা রাজেদ্র নারায়ণ (আরআরএন) পাইলট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়র থেকে এসএসসি এবং ১৯৯৯ সালে কালীগঞ্জ শ্রমিক কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন।