একটি ধানগাছ বছরে পর্যায়ক্রমে পাঁচবার ফলন দেবে। শুনলে অবিশ্বাস্য হলেও নতুন এই ধানের জাত আবিষ্কার করেছেন মৌলভীবাজারের জিন বিজ্ঞানী ড. আবেদ চৌধুরী। আবিষ্কারের পর থেকেই সাড়া পড়েছে দেশজুড়ে।
গবেষক ড. আবেদ চৌধুরীর বাড়ি মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার হাজিপুর ইউনিয়নের কানিহাটি গ্রামে। তিনি অস্ট্রেলিয়ায় জাতীয় গবেষণা সংস্থার প্রধান ধান বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।
প্রবাসে থাকলেও দেশের ধানের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনে কাজ করছেন তিনি। নিজের উদ্ভাবিত জাতের ধান উৎপাদনে জন্মস্থান কানিহাটি গ্রামের পারিবারিক জমিতে গড়ে তুলেছেন খামার। এই খামারেই নতুন উদ্ভাবিত ধান চাষ করা হয়। প্রথমবারের মতো একই গাছে এক বছরে পাঁচবার ফলন এসেছে।
এ বিষয়ে প্রবাসী জিন বিজ্ঞানী ড. আবেদ চৌধুরী রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমি দেখেছি যারা ধান চাষ করেন, তারা উন্নত জীবনযাপন করতে পারেন না। তাদের খরচ অনেক বেশি, খরচ করার পর যা ধান পান, ওটা বিক্রি করে তো পোষায় না। যারা ধানের উপর নির্ভরশীল, তারা দরিদ্র থেকেই যান। ধান বিক্রির টাকা, উৎপাদন খরচ দিয়ে খেয়ে-পরে বাঁচতে পারেন না। ছেলে-মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে পারেন না। এটাই বাস্তবতা। এটা আমার জন্য খুব পীড়া দায়ক ছিল।’
তিনি বলেন, ‘আমরা কৃষি নির্ভর পরিবারকে দেখেছি দেশে খুব অবহেলিত। মানুষ শুধু চায় কমদামে ধান পেতে। কিন্তু কৃষকরা যে মূল্য পাচ্ছে না, সেটা নিয়ে কারো কোনো মাথা ব্যথা নেই। আমি আমার ব্যক্তিগতভাবে কৃষিতে কিভাবে আয় বাড়ানো যায়, ব্যয় কমানো যায়, এটা নিয়ে আমি সারাক্ষণ চিন্তা করি। একটা ধান জমিতে থাকবে, বিশাল আকার ধারণ করে অনেক অনেক ধান দেবে। আমি এই জিনিসটাই করতে চেয়েছি, অত্যন্ত আনন্দের বিষয়, আমি করতে পেরেছি।’
বিজ্ঞানী আরও বলেন, ‘বোরো হিসেবে বছরের প্রথমে লাগানো এ ধান ১১০ দিন পর পেকেছে। ওই গাছেই পর্যায়ক্রমে ৪৫ দিন পরপর একবার বোরো, দুইবার আউশ এবং দুইবার আমন ধান পেকেছে। কম সময়ে পাকা এই ধানের উৎপাদন বেশি, খরচও কম। তবে, প্রথম ফলনের চেয়ে পরের ফলনগুলোতে উৎপাদন কিছুটা কম। কিন্তু পাঁচবারের ফলন মিলিয়ে উৎপাদন প্রায় পাঁচ গুণ বেশি।’
জানা যায়, ১১০ দিনের মধ্যে ৮৫ সেন্টিমিটার থেকে এক মিটার উচ্চতার গাছে ফসল আসে। পরে মাটি থেকে ৩৫ সেন্টিমিটার উচ্চতায় পরিকল্পিতভাবে ওই ধান কেটে ফেলা হয়। মে মাসের প্রথম দিকে প্রথমবার কাটা ধানে হেক্টরপ্রতি উৎপাদন হয়েছে ৪ টন। তারপর থেকে ৪৫ দিন অন্তর প্রতিটি মৌসুমে হেক্টরপ্রতি কখনো ২ টন, কখনো ৩ টন ফলন এসেছে।
আবেদ চৌধুরী জানান, যে জাতগুলোর ধান পাকার পর কেটে নিয়ে গেলে আবার ধানের শীষ বের হয়, সেগুলো তিনি আলাদা করেন। এভাবে ১২টি জাত বের করেন। তিন বছর ধরে জাতগুলো চাষ করে দেখলেন নিয়মিতভাবে এগুলো দ্বিতীয়বার ফলন দিচ্ছে। তারপর তিনি শুরু করেন একই গাছে তৃতীয়বার ফলনের গবেষণা। চারটি জাত একই গাছ থেকে পাঁচবার ফলন দিচ্ছে। এই চারটি জাতের ওপর ১০ বছর ধরে চলছে গবেষণা। চলতি বছরের জানুয়ারিতে বোরো ধানের এই চারটি জাত দুই বিঘা জমিতে রোপণ করা হয়। পরিমাণমতো ইউরিয়া সার প্রয়োগ করা হয়। সঠিকভাবে সেচ ও পরিচর্যা করার পর ১১০ দিনের মধ্যে ৮৫ সেন্টিমিটার থেকে এক মিটার উচ্চতার গাছে ফসল আসে। পরে মাটি থেকে ৩৫ সেন্টিমিটার উচ্চতায় পরিকল্পিতভাবে ওই ধান কেটে ফেলা হয়। সব জাতের ধান হেক্টরপ্রতি প্রায় ১৬ টন ফলন দিয়েছে।
বছরের যে কোনো সময়ে এ ধান রোপণ করা যায়। এখন পরের ধাপগুলোতে কিছুটা কম উৎপাদন হচ্ছে। আমার চেষ্টা থাকবে, আরও বেশি ফলন বের করার। এ ধানের বীজ সংগ্রহ সহজ। কৃষকরা নিজেরাই তা করতে পারবেন। অন্য ধানের মতো বীজতলায় রোপণের পর চারা তুলে চাষ করতে হয়।
ধানের নাম সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘একে ব্রীহি বলা হয়। এটা যেহেতু পাঁচবার ফলন দিয়েছে, তাই আপাতত এর নাম পঞ্চব্রীহি রেখেছি। পরবর্তী সময়ে চিন্তা ভাবনা করে নাম নির্ধারণ করবো। ‘ষষ্ঠবার ফলনে সফল হলে এই জাতের নামকরণ ‘ষষ্ঠব্রীহি’ করা যেতে পারে। আবার ‘বর্ষব্রীহি’ বলা যায়, যেহেতু বছরজুড়ে ফলন হয়। ‘চিরব্রীহি’, ‘অমরব্রীহি’ নামও রাখা যেতে পারে, যেহেতু গাছটি মরছে না। আবার আমার গ্রাম কানিহাটির নামেও রাখতে পারি।’
ড. আবেদ চৌধুরীর খামার দেখভাল করেন রাসেল মিয়া নামের একজন। তিনি বলেন, ‘পরীক্ষামূলকভাবে দুই বিঘা জমিতে ধান রোপণ করা হলে সফলভাবে পাঁচবার গাছ থেকে ধান কাটা হয়েছে। এই জমিনে ৪/৫ দিন আগে শেষবারের মতো ধান কাটা হয়ে গেছে। প্রথমবার উৎপাদনে যে খরচ হয়, পরের বার উৎপাদনে তেমন খরচ নেই। কৃষকরা খুব কম খরচে এই ধান উৎপাদন করতে পারবেন।’
‘গাছ থেকে একবার ধান কাটা হলে গাছের গোড়া যত্ন করে রেখে দিলে সেই গাছে আবার ফলন আসে। তাই আগামী বোরো মৌসুমে এ অঞ্চলে প্রায় ২০ বিঘা জমিতে আবার উদ্ভাবনী নতুন ধান রোপণ করা হবে’, বলেন তিনি।
এ ধরনের ধানগাছকে পরিবেশের জন্য আশীর্বাদ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এক জমি একাধিকবার চাষ দিলে মিথেন গ্যাস ও কার্বনড্রাইঅক্সাইড প্রচুর নির্গত হয়, যা পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর। কিন্তু এ ধান একবার চাষে উৎপাদন খরচ অনেকটা কম হবে। চাষাবাদ অন্য ধানের মতোই সহজ। এজন্য একে পরিবেশবান্ধব, জলবায়ু পরিবর্তন বান্ধব বলে থাকি আমি। উদ্ভাবিত বিভিন্ন জাতের ধানের নাম তার গ্রামের নামে কানিহটি ১ থেকে ১৬ পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে।’
সরেজমিনে দেখা যায়, কানিহাটি গ্রামের দিগন্তজোড়া মাঠে এখন সোনালি ফসল। ড. আবেদ চৌধুরীর বাড়ি থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে কানিহাটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে দুই বিঘার মধ্যে বিস্ময় জাগানো এই ধানের চাষ হয়েছে। চারা রোপণের পর এ নিয়ে পঞ্চমবারের মতো ধান কাটা হলো। একবার রোপণে এ ধানের গাছে বছরজুড়ে পাঁচবার ফলন আসায় নিভৃত কানিহাটি গ্রাম থেকে সৃষ্টি হবে নতুন এক ইতিহাস। এলাকার মানুষ এ নিয়ে আনন্দিত।
কানিহাটি গ্রামের কৃষক রুশন মিয়া বলেন, ‘আমাদের এলাকার ড. আবেদ স্যার যে ধান উৎপাদন করেছেন, সেটা আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। খরচ একদম কম হওয়ায় এখন আমরা এই ধান নিজেরা চাষ করতে চাই।’
আরেক কৃষক শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের এলাকায় জন্ম নেওয়া আবেদ চৌধুরী একটি ধান আবিষ্কার করেছেন। ধানটা খুবই ভালো। একবার রোপণ করলে পাঁচবার কেটে নেওয়া যায়। আমিও এই ধান এনেছি। এই ধানটার জন্য গর্বিত। আমরা সবাই আগ্রহী, যাতে এই ধান আরও বেশি বেশি উৎপন্ন হয়।’
কুলাউড়ার কানিহাটি গ্রামের সন্তান আবেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে কৃষি বিষয়ে উচ্চশিক্ষা শেষে চাকরি নিয়ে চলে যান অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানকার জাতীয় গবেষণা সংস্থার প্রধান ধানবিজ্ঞানী হিসেবে ধানের জিন নিয়ে গবেষণা করে কাটিয়ে দিয়েছেন ২০ বছর। এ পর্যন্ত তিনি প্রায় ৩০০ রকমের নতুন ধান উদ্ভাবন করেছেন। পেশাগত কারণে বিদেশের মাটিতে গবেষণা করলেও দেশে তার গ্রাম কানিহাটিতে গড়ে তুলেছেন খামার। তার নামে আবেদ ধানও এলাকায় চাষ করে ব্যাপক সফল হয়েছেন কৃষকরা।