পজিটিভ বাংলাদেশ

ভয়ঙ্কর ভালোবাসা

রাজু আহমেদ (২৪)। সদ্য পড়ালেখা শেষ করে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। কর্মজীবনের শত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি ডাক পড়লেই ছুটে যান ভালোবাসার প্রাণীটিকে বাঁচাতে। এতে সব সময়ই যে তিনি প্রশংসিত হন এমন নয়, কটূ কথাও শুনতে হয় তাকে। কারণ রাজু সাপ ভালোবাসেন। এই প্রাণীটি মানুষের জন্য বিপজ্জনক হিসেবেই পরিচিত। অথচ সব বিপদ স্বীকার করেই রাজুর প্রিয় প্রাণী হয়ে উঠেছে সাপ। যেখানেই সাপের খবর পান, সেখানেই হাজির হন রাজু। বিশেষ করে মানুষের হাতে ধরা পড়া বিপদগ্রস্ত সাপ বাঁচাতেই তার চেষ্টা থাকে বেশি। পাশাপাশি এ বিষয়ে সমাজে সচেতনতা সৃষ্টিতেও এই তরুণ কাজ করছেন।

এ পর্যন্ত নির্বিষ ও বিষধর প্রায় একশ সাপ বাঁচিয়েছেন রাজু আহমেদ। বর্তমানে বাংলাদেশ স্নেক রেসকিউ টিমের সভাপতি তিনি। গ্রামের বাড়ি পাবনার ভাঙ্গুড়ার চরপারা গ্রামে। পড়াশোনা শেষ করে বেছে নিয়েছেন চাকরিজীবন। বাবা সাকোয়াত হোসেন এবং মা মোছা রিনা খাতুনের তিন সন্তানের মধ্যে বড় তিনি।

কৃষিনির্ভর পরিবারে বড় হয়েছেন রাজু। গ্রামে বেড়ে ওঠার কারণে ছোটবেলা থেকেই সাপ দেখেছেন।  এ ছাড়া পাবনা বিল এলাকা হওয়ায় বর্ষা মৌসুমে সাপের আনাগোনা অনেক বেশি থাকে। সাপের প্রতি রাজুর  ভালোবাসা ছোটবেলা থেকেই। রাজু যখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়েন, তখন একদিন এক সাপুড়ে খেলা দেখাচ্ছিলেন। সেদিন রাজুর আগ্রহে তার গলায় দুটি সাপ পেঁচিয়ে দিয়েছিলেন সাপুড়ে। রাজু লক্ষ্য করলেন, সাপগুলো তাকে কামড় দিলো না। সেদিনের পর থেকেই ভয় ভেঙে যায় রাজুর। 

রাজু জানান, সেদিন সাপের আচরণ তাকে অবাক করেছিল। এরপর ডিসকভারি, জিওগ্রাফিক চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে সাপের চরিত্র বোঝার চেষ্টা করেন তিনি। এ জন্য অনেক বইও পড়েছেন। পড়ে জেনেছেন কোন সাপ নির্বিষ, কোনগুলো বিষধর, কোন সাপ বেশি দেখা যায়, কোনটা দিনে দেখা যায়, কোনটা রাতে। এভাবে সাপের আচরণ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেন তিনি। পরবর্তীতে সাপ ধরার কৌশলও শিখে নেন। গ্রামে জাল দিয়ে মাছ ধরার সময় যখন নির্বিষ সাপগুলো জালে আটকে যেত, তখন সেই সাপ বিপদমুক্ত করে নিরাপদে ছেড়ে দিতেন রাজু। 

রাজু বলেন, ‘একসময় অনুভব করলাম, সাপকে নিরাপদ করতে চাইলে আমার ট্রেনিং দরকার। তবে প্রথমে প্রাতিষ্ঠানিক ট্রেনিং নেওয়ার সুযোগ পাইনি। সাপ সম্পর্কে জানার পর আস্তে আস্তে সাপ উদ্ধার শুরু করি। সাপ ধরার কৌশলগুলো শিখে নিই। তখন থেকেই সাপকে নিয়ন্ত্রণ করতে পাড়তাম। পরে সিদ্দিকুর রহমান রাব্বি পরিচালিত স্নেক রেসকিউ টিমের সন্ধান পাই। সেখানে দুই বছর আগে বিষধর সাপ ধরার ট্রেনিং নিয়েছি।’

‘সাপ নিয়ে কাজ করি জেনে অনেকে হাসি-ঠাট্টা করত। বেদে বা সাপুড়িয়া বলেও ডাকত। কিন্তু যখন তারা দেখলো আমি মানুষের বাসস্থানে ঢুকে যাওয়া সাপ রেসকিউ করে তাদের বিপদমুক্ত করছি, সাপ বনে অবমুক্ত করে পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক রাখছি, তখন থেকে উপহাসের কিছুটা অবসান হয়। প্রথমে বাসা থেকেও নিষেধ করত। এখন আর করে না।’ বলেন রাজু। 

সাপ নিয়ে সমাজের চিন্তাধারা বদলাতে কাজ করছেন এই তরুণ। ‘সাপের কথা শুনলেই আমরা ভয় পেয়ে যাই, মারার জন্য অস্থির হয়ে যাই। একটু সচেতন থাকলে আমরা সাপের থেকে বাঁচতে পারি, সাপকেও বাঁচতে দিতে পারি। প্রকৃতিতে সাপের অবদান আছে। কৃষি জমির জন্য ইঁদুর ক্ষতিকারক। ইঁদুরের প্রজনন অনেক দ্রুত হয়। যদি ইঁদুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তবে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক্ষেত্রে সাপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ ছাড়া সাপের বিষ থেকে বিভিন্ন ওষুধ তৈরি হয়।’

‘বেশিরভাগ প্রজাতির বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য শৃঙ্খল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি খাদ্য শৃঙ্খল থেকে কেবল একটি উপাদান সরিয়ে ফেলা হয়, তাহলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর প্রতিক্রিয়ায় কোনো প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।’ যোগ করেন রাজু। 

প্রসঙ্গত, স্নেক রেসকিউ টিম শিক্ষার্থীনির্ভর একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। ২০২০ সালে সিদ্দিকুর রহমান রাব্বি এটি গঠন করে। টিমটি ২০টিরও বেশি জেলায় কাজ করছে। বর্তমানে নতুন সদস্যদের অনলাইনে বেসিক শেখানো হচ্ছে। দলে সক্রীয় রেসকিউয়ার আছেন ২৫ জন।