গ্রামীণ জীবনে চুলা জ্বালিয়ে রান্নার এখনো অন্যতম উৎস পাটখড়ি। একসময় শহরে পাটখড়ি বহুল ব্যবহার হলেও আধুনিক জীবনে জ্বালানি হিসেবে কমে এসেছে এর ব্যবহার। তবে বর্তমানে বহুমুখী ব্যবহার বিশেষ করে ঘরের বেড়া, ছাউনি দেওয়াসহ নানা ক্ষেত্রে পাটখড়ির চাহিদা বাড়ছে। ফলে ব্যাপারীরা ভালো দামে কৃষকদের কাছ থেকে পাটখড়ি কিনে নিচ্ছেন। এতে একটি মাত্র ফসল থেকে দুইবার আয়ের সুযোগ তৈরি হওয়ায় খুশি পাট চাষিরা।
গাইবান্ধা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র মতে, চলতি বছর জেলায় ১৫ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার চরাঞ্চলের কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বতর্মানে এক বিঘা জমি থেকে উৎপাদিত পাটের যে দাম পাওয়া যায়, পাটখড়ি বিক্রি করেও প্রায় একই দাম পাওয়া যায়। চারপাশে নদী থাকায় পাট জাগ দেওয়া নিয়েও সমস্যায় পড়তে হচ্ছে না তাদের। কয়েক বছর ধরে পাট চাষ করে লাভবান হওয়ায় এই অঞ্চলে আগের তুলনায় ফসলটির উৎপাদনও বৃদ্ধি পেয়েছে।
পানিতে জাগ দেওয়া গাছ থেকে পাট ও খড়ি আলাদা করছেন চাষিরা
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কৃষকরা নিজেরাই নিজেদের উৎপাদিত পাট কেউ নদীতে, কেউ বাড়ির পাশের ডোবায় কেটে জাগ দিয়ে রেখেছেন। তাদের অনেককেই কোমর পানিতে দাঁড়িয়ে পাটখড়ি থেকে আঁশ ছাড়িয়ে নিতে দেখা যায়। পরে তারা রাস্তার পাশে, মাঠে অথবা উম্মুক্ত স্থানে বাঁশ গেড়ে সেখানে দড়ি বেঁধে পাটের আঁশ ও পাটখড়ি রোদে শুকাতে দিচ্ছেন। ভালোভাবে শুকানো হলে সেগুলো বাড়িতে যত্নসহকারে সংরক্ষণ করছেন। শুকনো পাটখড়ি মাথায় করে নৌকায় তুলে কৃষকরা হাটে নিয়ে যাচ্ছেন বিক্রি করতে।
ফুলছড়ি ইউনিয়নের খঞ্চাপাড়া গ্রামের কৃষক হবিবর মিয়া। মাথায় পাটখড়ি নিয়ে তাকে যেতে দেখা যায় ফুলছড়ি হাটে। রাইজিংবিডির সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘১০০ পাটখড়ি দিয়ে একটি মোটা হয়। প্রতিটি মোটা (আঁটি) ১২ থেকে ১৫ টাকায় বিক্রি করি। মাথায় ৮৫টি মোটা আছে। বিক্রি করলে হাজার খানেক টাকা পাওয়া যাবে। সেই টাকায় মাছ, তেল, লবণসহ আনুসাঙ্গিক পণ্য কিনে বাড়ি ফিরবো।’
খঞ্চাপাড়া গ্রামের অপর কৃষক নুর ইসলাম বলেন, ‘এ বছর আট বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছি। এবার ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকার শুধু পাটখড়ি বিক্রি করার আশা করছি। এছাড়া পাট বিক্রি করেও লক্ষাধিক টাকা আয় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’
নৌকায় করে বাজারে বিক্রির জন্য পাট নিয়ে যাওয়া হচ্ছে
খঞ্চাপাড়া গ্রাম থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরের আরেক গ্রাম চর টেংরাকান্দি। সেখানকার ৬০ বছর বয়সী কৃষক আইজল মিয়া বলেন, ‘গ্রামের মানুষ জ্বালানি ছাড়াও পাটখড়ি দিয়ে ঘরের বেড়া, ছাউনি দেন। জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধিতেও পাট চাষ ভালো ভূমিকা রাখে। পাটখড়ির চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। তবে, এই পাটখড়ি নিজ এলাকার বাইরের বিশেষ করে ঢাকাসহ অন্য বিভাগীয় অঞ্চলের ব্যাপারীদের কাছে সরাসরি বিক্রি করতে পারলে আরও ভালো দাম পাওয়া যেত।’
সরদারের চরের গাবগাছি গ্রামের কৃষক খাজা মিয়া ও সাইফুল ইসলাম জানান, এক বিঘা জমির পাটখড়ি বিক্রি হয়ে থাকে ১০ থেকে ১১ হাজার টাকায়। পাটখড়ির বহুমুখী ব্যবহারের কারণে এবার শুধু ফুলছড়ি থেকেই লাখ লাখ টাকার পাটখড়ি বিক্রি হবে দেশের বিভিন্ন জায়গায়।
ফুলছড়ি হাটের কয়েকজন পাটখড়ি ব্যবসায়ী জানান, সারা দেশেই এখানকার পাটখড়ির চাহিদা রয়েছে। এক বিঘা জমির পাটখড়ি মানভেদে তারা ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত দামে কেনেন। পরে সেগুলো দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ১৩ থেকে ১৪ হাজার টাকায় বিক্রি করেন।
মাথায় পাটখড়ির আঁটি নিয়ে যেতে দেখা যায় এক কৃষককে
গাইবান্ধা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক খোরশেদ আলম রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘কৃষকরা পাট বিক্রি করে একদিকে যেমন লাভবান হচ্ছে, অন্যদিকে পাটখড়ি বিক্রি করেও অতিরিক্ত অর্থ পাচ্ছেন। তারা একটি ফসল চাষ করে উভয় দিক থেকেই লাভবান হচ্ছেন। ফলে এ অঞ্চলের কৃষকরা দিন দিন পাট চাষে আরও বেশি আগ্রহী হয়ে উঠছেন। পাটের বহুমুখী ব্যবহার বাড়াতে পারলে কৃষকরা ভবিষ্যতে আরও বেশি লাভবান হবেন।’