মাছি চাষ করে সফলতা পেয়েছেন ভোলার চরফ্যাশনের নার্গিস অ্যাগ্রো ফার্মের ব্যবস্থাপক মিজানুর রহমান। ইউটিউব দেখে ‘ব্লাক সোলজার ফ্লাই’ নামের মাছি চাষ করে তার লার্ভা বিভিন্ন মাছের খামারে বিক্রির মাধ্যমে প্রচুর টাকা আয় করছেন তিনি। একই সঙ্গে তার এই খামারে অনেক বেকার যুবকের কর্মসংস্থান হয়েছে।
গত বছরের পুরোটা সময় মাছি চাষ নিয়ে গবেষণা করেন মিজানুর রহমান। ভালো ফলাফল পেয়ে বাণিজ্যিকভাবে ২০২৪ সালে ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার ওসমানগঞ্জ ইউনিয়নের উত্তর ফ্যাশনে তিনি গড়ে তোলেন ব্লাক সোলজার ফ্লাই মাছির খামার। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। প্রতি মাসে মাছির লার্ভা মাছের উৎকৃষ্ট খাবার হিসেবে বিক্রি করছেন তিনি।
মিজানুর রহমান জানান, মাছ চাষ করার প্রবল ইচ্ছে অনেক আগে থেকেই ছিল তার। এমন ভাবনা বাস্তবায়নের জন্য তিনি স্বল্প পরিসরে মাছ চাষ শুরু করেন। একদিন, ইউটিউব দেখে তিনি জানতে পারেন, সারা পৃথিবীতে মাছের খাবারের বিকল্প হিসেবে ব্লাক সোলজার ফ্লাই মাছির লার্ভা ব্যবহার হচ্ছে। এর খরচ বর্তমানে মাছের খাবারের পেছনে যে পরিমাণ টাকা খরচ করতে হচ্ছে, তার চেয়ে কম। মাছির লার্ভা প্রাকৃতিক হওয়ায় মাছের বৃদ্ধিও ভালো হয়। এরপর ২০২৩ সালে পরীক্ষামূলকভাবে ব্লাক সোলজার ফ্লাই মাছির লার্ভা তেলাপিয়া ও পাঙ্গাসসহ বিভিন্ন ধরনের মাছকে খাওয়ান তিনি। কিছুদিন পর মাছের বৃদ্ধি দেখে বুঝতে পারেন লার্ভার গুরুত্ব কতোটা। তিনি ভাবতে শুরু করেন, এই খাবার দিয়ে অধিক লাভ করা যায় এমন মাছের কথা। তখন তিনি শোল ও কোরাল মাছ চাষ করার সিদ্ধান্ত নেন। আর এই মাছের খাবার জোগানের জন্য ২০২৪ সালে ব্লাক সোলজার ফ্লাই মাছির খামার গড়ে তোলেন তিনি।
তিনি আরও জানান, শুরুতে নরসিংদী থেকে ব্লাক সোলজার ফ্লাই মাছির লার্ভা সংগ্রহ করতেন। তারপর পচনশীল খাবার খাইয়ে লার্ভাগুলো কে বড় করে তোলেন। লার্ভাগুলো যখন কালো বর্ণ ধারণ করে, তার কয়েকদিনের মধ্যে মাছিতে পরিণত হয়।
সরেজমিনে উত্তর ফ্যাশনে গিয়ে দেখা যায়, ব্লাক সোলজার ফ্লাই মাছি রাখার জন্য আলাদা একটি ঘর মশারি দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। যা ‘লাভ কেজ’ নামে পরিচিত। লাভ কেজে মাছিগুলো প্রজনন বৃদ্ধির জন্য একে অন্যের সঙ্গে মিলিত হয়। কিছুদিন পর স্ত্রী মাছিগুলো ডিম দেয়। মাছির ডিম দেওয়ার স্থানও অন্যভাবে প্রস্তুত। একটা বালতি তার ওপর দুইপাশে থাকে কাঠের টুকরো। ওই কাঠের টুকরোর ফাঁকে ফাঁকে গিয়ে মাছি ডিম পাড়ে। সেখান থেকে খামারের লোকজন ডিম নিয়ে হ্যাচারিতে সংরক্ষণ করেন। ২-৩ দিনের মধ্যে সেই ডিম থেকে ছোট লার্ভা বের হয়। পরবর্তীতে সেই লার্ভা খামারের অন্য একটি ঘরে নিয়ে রাখা হয়। ওই ঘর মূলত লার্ভাগুলোর খাবারের ঘর হিসেবে তৈরি করা হয়েছে।
সেই ঘরে ইট-সিমেন্ট দিয়ে তৈরি চতুর্ভুজ আকৃতির কিছু স্থানে রয়েছে। সেই স্থানে প্রতিদিন বাজার থেকে সংগ্রহ করা পচনশীল খবার যেমন, সব ধরনের শাক সবজি, মাছ, ফল দেওয়া হয়। ছোট লার্ভাগুলো মূলত সেই পচনশীল খাবারের মধ্যে রাখা হয়। খাবার খেয়ে পিউপা (কীটপতঙ্গের একটি জীবন পর্যায়। পতঙ্গের অপরিপক্ব এবং পরিণত পর্যায়ের মধ্যবর্তী রূপান্তরের অবস্থাই হচ্ছে পিউপা) তারপর সেগুলোকে লাভ কেজে নিয়ে রাখা হয়। কয়েকদিন পরে সেটি পরিপূর্ণ একটি মাছিতে রূপান্তরিত হয়।
মিজানুর রহমান বলেন, ‘এই মাছিটিকে (ব্লাক সোলজার ফ্লাই) বন্ধু মাছিও বলা হয়। পরিবেশের বর্জগুলো খেয়ে প্রোটিনে কনভার্ট করা এই মাছির কাজ। এর মাধ্যমে পরেবেশ ভালো রাখা সম্ভব।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই মাছি চাষে তেমন খরচ নেই। এর লার্ভা মাছের খাবার হিসেবে খুবই ভালো এবং দামেও সস্তা। ইতোমধ্যে এলাকার কয়েকজন মাছ চাষি এই খাবার মাছকে খাইয়েছেন। তারা ভালো ফলাফল পেয়ে এই লার্ভা মাছের খাবার হিসেবে নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।’
এই খামারি বলেন, ‘প্রতিদিন এই খামারে ১০০-১৫০ কেজি লার্ভা উৎপাদন হচ্ছে। খামারে প্রতিদিন এক টন পর্যন্ত মাছির লার্ভা উৎপাদন সম্ভব। বানিজ্যিকভাবে মাছের খাবার হিসেবে লার্ভা বিক্রি করা হচ্ছে খামার থেকে। প্রতিকেজি ৪০-৪৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে এই লার্ভা।’
মিজানুর রহমানের ছোট ভাই আরিফুল ইসলাম বলেন, আমার ভাইয়ের সাথে আমিও এই খামার দেখাশোনা করি। শুরুতে অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। এখন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। অনেক ভালো সম্ভাবনা দেখছি, এই মাছি চাষে।
মিজানুর রহমানের খামারে ১০-১৫ জন শ্রমিক কাজ করেন। এখানে কাজ করে পরিবার পরিজন নিয়ে খুব ভালো আছেন তারা। শ্রমিক মেহেদী হাসান বলেন, এখানে কাজ করে ভালো টাকা মাসে বেতন পায়।
স্থানীয় বাসিন্দা মো. ইউনুস বলেন, মাছি চাষ ভবিষ্যতে এই এলাকার জন্য একটি আশির্বাদে রূপ নেবে। মাছি চাষ শুরু হওয়ায় অনেক বেকার ছেলের চাকরির ব্যবস্থা হয়েছে। ভবিষৎতে এখানে আরও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এমনটাই আশা করছি।
ভোলা জেলার মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার দেব বলেন, মাছির লার্ভা মাছের খাবার হিসেবে খুবই ভালো। এটিতে প্রচুর পরিমাণে আমিষ রয়েছে। এই আমিষ মাছের বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।