দুর্গাপূজা বাঙালি হিন্দুর ধর্মীয় কৃত্য। তবে, ধর্মীয় কৃত্য হলেও, মনে রাখা প্রয়োজন, সম্প্রদায়-নির্বিশেষে কোনো বাঙালিরই ধর্ম ধ্রুপদী শাস্ত্রের পূর্ণ অনুসারী নয়। লৌকিক চেতনাদৃপ্ত সকল বাঙালির ধর্মকেই মনীষী বিনয়কুমার সরকার ‘বাঙালি ধর্ম’ আখ্যা দিয়েছিলেন। সেই ধর্মই বাঙালি হিন্দুদের পুরাণ ভাবনায় ও অনুষ্ঠান-পরিকল্পনায় দুর্গাপূজার মধ্যে এক অভিনব রূপ ধারণ করেছে। এ রকমটি ঘটানো হয়েছে রামায়ণের মতো প্রাচীন ভারতের মহাকাব্যের বাঙালিকরণ ঘটিয়ে।
মধ্যযুগের বাঙালি কবি কৃত্তিবাস সংস্কৃত ভাষায় রচিত বাল্মীকি রামায়ণের মূল কাঠামোটি বজায় রেখেই বাংলায় রামায়ণ রচনা করেছিলেন বটে, কিন্তু এর কাহিনী-বিন্যাসে ও চরিত্র-চিত্রায়ণে তিনি এমন সব অভিনব রূপান্তর ঘটান যে- তা একান্তভাবেই বাঙালির নিজস্ব মহাকাব্যে পরিণত হয়ে যায়। কৃত্তিবাসের হাতে রামচন্দ্র হয়ে যান দুর্গাপূজারী- দুর্গাপূজা করেই তিনি রাবণ বধের শক্তি লাভ করেন। অথচ, বিশ্বজগতের পালনকর্তা দেবতা বিষ্ণুর অবতাররূপে পূজিত শ্রীরামচন্দ্র অন্যকোনো দেবতার পূজা করবেন- এমন কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না উত্তর ভারত তথা বাংলার বাইরের হিন্দুরা। সেই হিন্দুরা রামচন্দ্রের শুধু পূজাই করেন না, রামের নাম করে অনেক অঘটনও ঘটিয়ে থাকেন। সবচেয়ে বড় অঘটনটি ঘটানো হয় রামের একটি কল্পিত মন্দিরকে আশ্রয় করে। কল্পনাসৃষ্ট সেই মনিদ্র রক্ষার অজুহাতে একান্ত বাস্তব একটি ভজনালয় (অর্থাৎ ‘বাবরি মসজিদ’) গুড়িয়ে ফেলার মতো জঘন্য অপকর্ম করে ফেলে একদল রামভক্ত। বাস্তব বাবরকে অবজ্ঞা ও উপেক্ষা এবং কল্পিত রামমন্দিরের প্রতি অন্ধ ভক্তি প্রদর্শন-এদের সীমাহীন মূর্খতা ও বিদ্বেষান্ধ সাম্প্রদায়িকতারই পরিচায়ক।
এরকম বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িক ভাবনায় বাঙালিদের ভাবিত করে না। হ্যাঁ, পাকিস্তানপন্থি রাজাকার ও তাদের কিছু অন্ধ অনুসারীর হাতে বাংলাদেশে মন্দির ও মূর্তিভাঙার মতো অপকর্ম সাধিত হয় অবশ্যই। তবে এরা সংখ্যায় একেবারেই মুষ্টিমেয়। সম্প্রদায় নির্বিশেষে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি কখনো অন্ধ ভক্তির আবেগে ভেসে গিয়ে যুক্তিকে বিসর্জন দেয় না।
বাঙালির দুর্গাপূজাও তাই সাম্প্রদায়িক ধর্মকৃত্যের সীমায় আবদ্ধ থাকে না, পরিণত হয়ে যায় সর্বজনীন উৎসবে। সর্বজনীন দুর্গোৎসব আবার বাঙালির বৈপ্লবিক ভাবনারও ধারক হয়ে ওঠে। কৃত্তিবাস যে ভাবনার সূচনা ঘটিয়েছিলেন, প্রাক-আধুনিক কালেই তার উত্তরসূরি কবিবৃন্দ সে ভাবনায় ক্রমাগত নতুন নতুন মাত্রার সংযোগ ঘটিয়ে চলেন। আধুনিককালে এসে মাইকেল মধুসূদন দত্ত থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ ও বুদ্ধদেব বসু পর্যন্ত অনেকের হাতেই আরো নতুনতর মাত্রা সংযোজিত হয়েছে। পুরাণের নবনব জন্ম সংঘটিত হয়েছে। তবে বিপ্লবী কবি কাজী নজরুল ইসলাম যে দৃষ্টিতে পূরাণের নবজন্ম ঘটিয়েছেন, বিশেষ করে রামায়ণের কাহিনী ও চরিত্রসমূহের যে ভাষ্য নির্মাণ করে সেসবের ভেতর যে বৈপ্লবিক মাত্রার সংযোজন ঘটিয়েছেন তা একেবারেই অভিনব ও অভূতপূর্ব।
রামায়ণের অন্তর্গত বিভিন্ন আখ্যান ও বর্ণিত চরিত্রের যে তাৎপর্য নজরুল উদঘাটন করেছেন, তেমনটি তার আগে কারো চিন্তাতেই আসেনি। জগৎ ঘটকের সংগ্রহ থেকে প্রাপ্ত নজরুলের একটি রচনার খসড়ায় তো এ বিষয়টি একেবারেই স্ফটিকস্বচ্ছ রূপে ধরা পড়েছে। নজরুলের বিবেচনায় রামায়ণের অন্যতম চরিত্র জনক হলেন সেই মানুষদের প্রতিনিধি যারা ‘শস্য বা ফসল উৎপাদন করে’। আর সীতা ‘জনক বা শস্য-উৎপাদকের কন্যা’ অর্থাৎ ‘শস্য’। রাম হলেন ‘জনগণ বা কৃষকের প্রতিনিধি’। রাবণ ‘সেই শস্য বা সীতাকে হরণ করে, সে ‘লোভের’ প্রতীক। ‘যে বিশ হাত দিয়ে লুণ্ঠন করে, দশমুখ দিয়ে গ্রাস করে’ সেই রাবণ। কৃষকের প্রতিনিধি রাম সেই লুণ্ঠনকারী ধনিক রাবণকে হত্যা করে ‘শস্য’ বা সীতাকে উদ্ধার করেন। আবার রামায়ণেই আছে সীতার পাতাল-প্রবেশের কাহিনী। নজরুলের দৃষ্টিতে এর তাৎপর্য হলো- ‘রাম অর্থাৎ কৃষকদের প্রতিনিধি যখন শস্যকে অবহেলা করে জনগণের দুর্বুদ্ধিপ্রসূত স্বর্ণকে গ্রহণ করেন, তখন শস্য পাতালে প্রবেশ করেন। অর্থাৎ শস্য উৎপাদিকা শক্তিকে অবহেলা করে স্বর্ণরৌপ্যকে (স্বর্ণসীতাকে) বড় করে ধরলে দেশের সমূহ সর্বনাশ হয়।’
‘খসড়া’ টিতেই নয় শুধু, রাম-রাবণ-সীতাসহ রামায়ণের অন্যান্য চরিত্র ও কাহিনীগুলোর এ রকম বৈপ্লবিক ভাষ্য নজরুলের বহু রচনাতেই উঠে এসেছে। কৃত্তিবাসী রামায়ণে বর্ণিত রামচন্দ্রের দুর্গাপূজার বিষয়টিও নজরুল বিপ্লবীর দৃষ্টিতেই অবলোকন করেছেন। এখনকার বাঙালিরা যে দুর্গাপূজা করে তা নজরুলের বিবেচনায় নিতান্তই ‘অভিনয়’ মাত্র। ‘প্রলয় শিখা’ কাব্যের ‘পূজা-অভিনয়’ কবিতায় তিনি স্পষ্ট বলে দিয়েছেন-
‘এমনি শরৎ সৌরশ্বিনে অকাল বোধন মহামায়ার যে পূজা করিল বধিতে রাবণে ত্রেতায় স্বয়ং রামাবতার, আজিও আমরা সে দেবী পূজার অভিনয় করে চলিয়াছি।’
রামচন্দ্র যে দুর্গাদেবীর পূজা করেছিলেন তার মর্মার্থটি সর্বাংশে ভুলে গিয়ে আমরা এর খোলশটি নিয়েই মাতামাতি করছি। শক্তির প্রতীক রূপেই দুর্গার কল্পনা করা হয়েছে। তাই, দুর্গাপূজা মানেই হচ্ছে নিজের ভেতর সেই শক্তির সঞ্চার ঘটানো যে শক্তি দিয়ে সকল অপশক্তিকে প্রতিহত ও নির্মূল করা যায়। ত্রেতাযুগের রামচন্দ্র যেমন ‘শস্য’ তথা ধন-উৎপাদকের সংগ্রামী নেতারূপে সীতা-অপহরণকারী (অর্থাৎ উৎপাদক মেহনতি মানুষদের উৎপাদিত সামগ্রীর লুণ্ঠনকারী) রাবণের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য দুর্গাপূজা করেছিলেন (অর্থাৎ আত্মশক্তি লাভের সাধনা করেছিলেন), কলিযুগ বা বর্তমান যুগের প্রতিটি শোষিত বঞ্চিত মানুষকেও তো তাই করতে হবে। কারণ এ যুগেও তো রাবণরা প্রবল প্রতাপেই বিদ্যমান। এ যুগের রাবণদের সম্পর্কেই নজরুল বলেছেন- ‘দশ মুখো ঐ ধনিক রাবণ, দশদিকে আছে মেলিয়া মুখ, বিশ হাতে করে লুণ্ঠন তবু, ভরে না ক ওর ক্ষুধিত বুক।’
একালের এই রাবণদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর দায়িত্ব যে বর্তেছে আমাদেরই ওপর, সে কথা যেন আমরা ভুলে বসে আছি। অথচ প্রতি বছরই সাড়ম্বরে দুর্গাপূজার অনুষ্ঠান করা হচ্ছে। পূজা করা হচ্ছে মাটির মূর্তিকে। কিন্তু সে মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠায় ও আত্মশক্তির জাগরণ ঘটানোয় পূজারীদের কোনো গরজ নেই। এই অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতিকে ধিক্কার জানিয়েই নজরুল একে ‘পূজা-অভিনয়’ আখ্যা দেন।
পূজাকে কেন্দ্র করে যে উৎসব তা-ও উৎসবের মূল মর্মকে পরিত্যাগ করে হয়ে ওঠে বহিরঙ্গসর্বস্ব। কেথাও কোথাও তা না ক্লেদাক্ততা ও আবিলতায় একান্ত পঙ্কিলও হয়ে ওঠে। অবশ্য এ রকমটি যে কেবল একালেই ঘটছে, তা নয়। একালে বরং দুর্গোৎসবের অনেক বেশি গণায়ন ঘটেছে, এবং তার ফলে ক্লেদাক্ততা ও আবিলতাও অনেক পরিমাণে প্রতিরুদ্ধ হয়েছে। ইতিহাস থেকে জানা যায়- ষোড়শ শতাব্দীতে রাজশাহীর তাহিরপুরের রাজা কংসনারায়ণ বহু লক্ষ টাকা ব্যয় করে শারদীয় দুর্গাপূজার সাড়ম্বর অনুষ্ঠান করেন। সেই থেকেই এই দুর্গাপূজা বাঙালি হিন্দুর বিশেষ ধর্মীয় ঐতিহ্যে পরিণত হয়ে যায়। তবে রাজা কংসনারায়ণ কেবল যে একটি ধর্মীয় ঐতিহ্যই সৃষ্টি করেছিলেন তেমন কথাও বলা যায় না। রাজার আসল উদ্দেশ্য ছিল ঐশ্বর্য প্রদর্শন। অর্থাৎ ঐশ্বর্যের দাপট দেখানো। সেই থেকে দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে ঐশ্বর্যশালীদের দাপট দেখানোর একটি অপ ঐতিহ্যও সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। সেই ঐতিহ্য অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও তার উত্তরসূরিরা বেশ নিষ্ঠার সঙ্গেই বহন করে যেতে থাকেন! তারপর ঊনবিংশ শতাব্দীতে কলকাতা নগরীকে কেন্দ্র করে যে নব্যধনী বা ‘হঠাৎ নবাবদের’ উদ্ভব ঘটে, তারা সে ঐতিহ্যকে আরো বেগবান (!) করে ফেলেন।
অশ্লীল কদর্য নৃত্যগীত, মদ্যপান ও বেশ্যাগমন- তাদের দুর্গাপূজার অপরিহার্য অনুসঙ্গী হয়ে পড়ে। ঐসব উপসর্গ যুক্ত হওয়ার পর পূজা ও উৎসব- দুই-ই চরিত্রভ্রষ্ট হয়ে যায়। ঐসব উপসর্গ যেখানে খুব প্রকট নয়, সেখানেও এবং বর্তমানেও পূজা ও উৎসব একান্তভাবেই চরিত্রভ্রষ্ট। এই চরিত্রভ্রষ্টতা দূর করা ও ‘পূজা অভিনয়’ কে অভিনয় মুক্ত করার জন্যই সচেতন জনগণের প্রতি নজরুলের আহ্বান। সে আহ্বানে জনগণকে সাড়া দিতেই হবে। অর্থাৎ একালের দুর্গাপূজা ও দুর্গোৎসবের মূল লক্ষ্য হতে হবে ‘দশ মুখো ঐ ধনিক রাবণ’ দের উৎখাত করে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য শক্তি আহরণ করা। জনগণ সেই শক্তি প্রয়োগ করেই যে ঐ রাবণদের ‘বিশ হাতে লুণ্ঠন’ করার প্রক্রিয়ার অবসান ঘটাবে- নজরুল সে-ব্যাপারেও দৃঢ় প্রত্যয় ও সঙ্গত আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। পৌরাণিক অনুষঙ্গ প্রয়োগ করেই তিনি জানান যে- ধন-উৎপাদক কৃষক-শ্রমিকদের মধ্য থেকেই রামচন্দ্রের মতো নতুন নেতৃত্বের উদ্ভব ঘটবে, এবং সেই নেতৃত্বই এ যুগের রাবণদের তথা শোষক বঞ্চকদের উৎখাত ঘটাবে- ‘হয়ত গোকুলে বাড়িয়ে সে আজ, উহাকে কল্য বধিবে যে গোয়ালার ঘরে খেটে লাঠি করে হলধর রূপী রাম সেজে।’
এভাবে দুর্গোৎসবের সর্বজনীন ও বৈপ্লবিক তাৎপর্য অনুধাবন করেই উৎসবটিকে যথার্থ সার্থক করে তোলা সম্ভব।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ অক্টোবর ২০১৬/সাইফ