রবীন্দ্রনাথের বহুমাত্রিক ভাবনা ও চেতনার অন্যতম দিক স্বদেশ ভাবনা ও চেতনা। রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন সময়ে বহু দেশ ঘুরেছেন, বহু দেশে বেশ কিছু দিন অবস্থানও করেছেন। দেশগুলোর মধ্যে এশিয়ার চীন-জাপান থেকে ইউরোপের ইংল্যান্ড-জার্মানি প্রভৃতি। কিন্তু কোনো দেশেরই পরিবেশ, প্রকৃতি, নিসর্গ, মাটি, নদী, ফুল, পাখি কিংবা মানুষ তাঁকে টানেনি। ইচ্ছে করলে নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথ পৃথিবীর যে কোনো দেশেই বসবাসের জন্য স্থায়ী হতে পারতেন, কিন্তু মধুসূধনের মতো ‘হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিধিত রতন’ বলে স্বদেশের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে আশি বছরের জীবনকে বাংলার মাটি ও মানুষের জন্য উৎসর্গ করে গেছেন। গীত বিতানে তাঁর ‘স্বদেশ বিষয়ক ৪৬টি গানের পরতে পরতে দেশ, মাটি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসায় নান্দনিক চিত্র ফুটে উঠেছে। সেই ভালোবাসা যেমনি গভীর তেমনি নিবিড়। স্বদেশ বিষয়ক গানগুলোর এক নম্বর গানটি আমাদের বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। রবীন্দ্র-ভক্ত বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর এই গানটিকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত করেন। উল্লেখ্য যে, ভারত ও শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীতের রচয়িতাও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি বাংলার নদী, মাটি-খেয়াঘাট, ঋতু-প্রকৃতির বর্ণনা দিয়ে কত সহজ করে, কত প্রাণবন্ত করে এই গানে বলেছেন, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি। চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি। ওমা ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে, মরি হায়, হায় রে- ওমা অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধূর হাসি’ এর পরের চরণগুলোতে আরো নিবিড়ভাবে বর্ণনা করেছেন, ‘কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ কী মায়া গো- কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে।’ নদীমাতৃক দেশের গ্রামের দৃশ্য চিত্রায়িত করে আরো আকুলতায় পরবর্তী চরণে উচ্চারণ করেছেন, ‘তোমার এই খেলাঘরে শিশুকাল কাটিল রে, কামারি ধুলোমাটি অঙ্গে মাখি ধন্য জীবন মানি।’ জীবন ধন্য করেই তিনি শেষ করেননি, গানের শেষ চরণগুলোতে তিনি মাতৃভূমি মা’র চরণে নিজের মাথা পেতে দিয়েছেন। বলছেন, ‘ও মা, তোর চরণেতে দিলে এই মাথা পেতে দে গো তোর পায়ের ধূলো, সে যে আমার মাথার মানিক হবে’ স্বদেশকে ভালোবেসে স্বদেশের মাটির কাছে মাথা নত করার উদাহরণ রবীন্দ্রনাথই দেখিয়েছেন এই গানে। যে কারণে এই গানটি ত্রিশ লাখ মানুষের রক্তে স্নাত বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের মর্যাদা পেয়েছে। দুই নম্বর গানটিও রবীন্দ্রনাথের আত্মসমর্পণ যেন দেশের মাটির কাছে। নিবেদিত প্রাণের সুধা ঢেলে দিয়েছেন তিনি। কত আকুতি, কত বিনয়, কত গর্ব দেশ মাতৃকাকে নিয়ে। সন্তান মা’র বুকে মাথা রেখে সুখ-শান্তি পায়, তেমনি রবীন্দ্রনাথের উচ্চারণ, ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার ‘পরে ঠেকাই মাথা। তোমাতে বিশ্বময়ীর তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা। তুমি মিশেছ মোর দেহের সনে, তুমি মিলেছ মোর প্রাণের সনে, তোমার ওই শ্যামলবরণ কোমল মূর্তি মর্মে গাঁথা। ওগো মা, তোমার কোলে জনম আমার, মরণ তোমার বুকে।’ শুধু দেশের শ্যামল মাটির কাছে নিজেকে বিলিয়ে, মিলিয়ে, মিশিয়েই দেননি, দেশের অর্থাৎ বাংলার পূণ্য, পূর্ণ, বাঙালিদের সত্য ও একতা কামনা করেছেন শব্দ ও ছন্দের কারুকাজে। ২০ নম্বর গানে তাই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল পূণ্য হউক... বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ পূর্ণ হউক... বাঙালির পণ, বাঙালির আশা, বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষা সত্য হউক... বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন, বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন- এক হউক...।’ স্বদেশ চেতনায় রবীন্দ্রনাথের এই আহবান ও ঐক্য কামনা এক অনন্য উদাহরণ। পরের গান অর্থাৎ ২১ নম্বর গানটিতে রবীন্দ্রনাথ আশাবাদী বাণীতে দেশমাতৃকার জয়গান গেয়েছেন। তাঁর সোনার বাংলা-বাংলাদেশের রূপে মুগ্ধ হয়ে তিনি গাইছেন, ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি, তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী। ওগো মা, তোমায় দেখে আঁখি না ফিরে। তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে।’ জন্মদাত্রী মা’র জন্য সন্তান যেমন গর্বিত ও গৌরববোধ করে, তেমনি রবীন্দ্রনাথও তাঁর জন্মভূমির জন্য গৌরবান্বিত। বাংলার প্রকৃতি ও নিসর্গের বর্ণনা ও চিত্রকল্পের মাধ্যমে এবং উপমার ব্যবহারে ২৪ নম্বর গানে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে। সার্থক জনম, মা গো তোমায় ভালোবেসে। জানিনে তোর ধনরতন আছে কিনা রাণীর মতন; শুধু জানি আমার অঙ্গ জুড়ায় তোমার ছায়ায় এসে। কোন বনেতে জানি নে ফুল গন্ধে এমন করে আকুল, কোন গগনে ওঠে রে চাঁদ এমন হাসি হেসে। আঁখি মেলে তোমার আলো প্রথম আমার চোখ জুড়ালো, ওই আলোতেই নয়ন রেখে মুদব নয়ন শেষে পুরো গানটিই এখানে তুলে ধরা হলো। গানটিতে রবীন্দ্রনাথ আরো বলেছেন, মা যতই দরিদ্র হোক, গরিব হলেও তিনি মা। তাই তিনি মা’কে ছেড়ে কোথাও যেতে চান না। পরের গানেই অর্থাৎ ২৫ নম্বর গানে আরো আবেগ ও নিষ্ঠাবানের মতো বলেছেন, ‘যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক, আমি তোমায় ছাড়বো না মা! আমি তোমার চরণ, মা গো আমি তোমার চরণ করব শরণ, আর কারো ধার ধারব না মা। কে বলে তোর দরিদ্র ঘর, হৃদয়ে তোর রতন রাশি। আমি জানি গো তার মূল্য জানি পরের আদর কাড়ব না মা॥ মনের আশে দেশ-বিদেশে যে মরে সে মরুক ঘুরে- তোমার ছেঁড়া কাঁথা আছে পাতা, ভুলতে সে যে পারব না মা।’ হ্যাঁ স্বদেশ ছেড়ে রবীন্দ্রনাথ কোথাও যেতে চান না। তাই জননী-জন্মভূমিকে উদ্দেশ্য করে উচ্চারণ করেছেন ২৯ নম্বর গানে : ‘মা কি তুই পরের দ্বারে পাঠাবি তোর ঘরের ছেলে? তারা যে, করে হেলা, মারে ঢেলা, ভিক্ষাঝুলি দেখতে পেলে।’ অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য পরিষ্কার স্বদেশ, স্বদেশই। তাই তিনি স্বদেশের সকলকে আহবান জানিয়েছেন, উদ্দীপনা যুগিয়েছেন, দেশের জন্য কাজ করতে বলেছেন, বলেছেন, দেশকে ভালোবাসতে। বেশ ক’টি গানে তিনি তাঁর আহবান প্রতিষ্ঠিত করেছেন। যে আহবানের মধ্যে শেঁকড় গেড়ে আছে তাঁর দেশপ্রেম অর্থাৎ স্বদেশ চেতনা। পরপর কয়েকটি গানের অংশ বিশেষ উদ্ধৃতি দেওয়া যাক। ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে। তোর আপন জনে ছাড়বে তোরে তা বলে ভাবনা করা চলবে না। নিশিদিন ভরসা রাখিস ওরে মন হবেই হবে। যদি পণ করে থাকিস সে পণ তোমার রবেই রবে। আগে চল, আগে চল্ ভাই পড়ে থাকা পিছে, মরে থাকা মিছে প্রতি নিমিষেই যেতেছে সময়।’ রবীন্দ্রনাথ পরক্ষণেই আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। আশাবাদী করেছেন সকলকে। সাহসী ও দৃঢ়চিত্তে সকলকে আবারো ডাকা দিচ্ছেন সামনে চলার, এগিয়ে যাওয়ার জন্য। পথ চলতে হলে নানা বাধা-বিপত্তি কিংবা তরি ভাসালে ঝড় তুফান আসতে পারে। তবে সে বাধা, ঝড়-তুফান অতিক্রম করতে হবে। সমস্ত ভয়কে জয় করতে হবে। রবীন্দ্রনাথ ৭ নম্বর গানে বলেছেন, ‘আমি ভয় করব না ভয় করব না। দু’বেলা মরার আগে মরব না, ভাই, মরব না। তরী খানা বাইতে গেলে মাঝে মাঝে তুফান মেলে তাই বলে হাল ছেড়ে দিয়ে ধরব না, কান্নাকাটি ধরব না।’ উপযুক্ত গানগুলো নিয়ে সামান্য আলোচনা করে দেখা গেল যে, স্বদেশ বিষয়ক গানগুলোতে রবীন্দ্রনাথের দেশপ্রেমের এক অসাধারণ কৃতিত্ব ও স্বাক্ষর বহন করছে। তাঁর গানের স্বদেশ চেতনার আলোচনা শেষ করার আগে এই পর্বের ১০ নম্বর গানটির উল্লেখ না করলেই নয়। এই গানটি আমরা সকলেই গাই, গানটি আমাদের ভেতরে অন্যরকম ইমেজ তৈরি করে আমাদের আনন্দ দেয়। কারণ- ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে। নইলে মোদের রাজার সনে মিলবো কী স্বত্বে?’
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ মে ২০১৫/তাপস রায়