মো. সেলিম খান একসময় ছিলেন দিনমজুর। রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে হয়েছে ভাগ্যবদল। এরপর হয়েছেন রাজনৈতিক নেতা। আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের স্পর্শে হয়েছেন অঢেল সম্পদের মালিক।
সেলিম খান বর্তমানে চাঁদপুরের ১০ নম্বর লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাটের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিতি আছে তার।
অভিযোগ আছে, অবৈধভাবে অর্জিত কোটি কোটি টাকা বৈধ করতে চলচ্চিত্র প্রযোজনায় নামেন সেলিম খান। চলচ্চিত্রে ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন তিনি। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে এসব অর্থের বৈধ উৎস পাওয়া যায়নি। শাপলা মিডিয়া নামে প্রযোজনা সংস্থা আছে সেলিম খানের।
এর বাইরেও দুদকের অনুসন্ধানে সেলিম খানের প্রায় ২১ কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসবের মধ্যে আছে রাজধানীর কাকরাইলে ৪ তলা ও নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় ১০ তলা বাড়ি, কাকরাইলে ফ্ল্যাট, দুটি ব্যক্তিগত গাড়ি, সাড়ে ৪ একর জমি ইত্যাদি।
গত ২০ সেপ্টেম্বর সেলিম খান ও তার স্ত্রী শাহানারা বেগমের সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিশ পাঠান অনুসন্ধান কর্মকর্তা দুদকের সহকারী পরিচালক আতাউর রহমান সরকার। দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা (পরিচালক) প্রনব কুমার ভট্টাচার্য্য বিষয়টি রাইজিংবিডিকে নিশ্চিত করেছেন। তবে এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা।
অন্যদিকে, অবৈধ সম্পদের অভিযোগ ও নোটিশপ্রাপ্তির বিষয়টি অস্বীকার করে সেলিম খান রাইজিংবিডিকে বলেছেন, ‘আমার সম্পদের বিষয়ে ট্যাক্স ফাইলে বলা হয়েছে। এর বাইরে আমার অবৈধ সম্পদ নেই। দুদকের অনুসন্ধানের বিষয়ে জানা নেই। দুদকের নোটিশ পাইনি।’
এ বিষয়ে দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘সেলিম খানের আয়কর বিবরণীসহ বিভিন্ন নথিপত্র যাচাই শেষে তার পারিবারিক ব্যয়ের হিসাব পাওয়া যায় ৩৪ লাখ ৮৮ হাজার ৮০০ টাকা। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে প্রাপ্ত বেতন- ভাতা ও ঋণসহ তার মোট আয় পাওয়া যায় ৬১ লাখ ৭২ হাজার টাকা। এসব তথ্য-উপাত্ত যদি অনুসন্ধান কর্মকর্তার পাওয়া হিসাব থেকে বাদ দেওয়া হয়, তাহলে সেলিম খানের ২০ কোটি ৬৯ লাখ ৭০ হাজার ৫৮৫ টাকার সম্পদ পাওয়া যায়, যার বৈধ উৎস ও রেকর্ডপত্র নেই।’
দুদকের অনুসন্ধানে পাওয়া সেলিম খানের স্থাবর সম্পদের মধ্যে আছে—চাঁদপুর সদর উপজেলায় ৪.২১ একর কৃষি ও অকৃষি জমি, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় ১০ তলা বাড়ি, ঢাকার কাকরাইলে ৪ তলা বাড়ি ও একটি ফ্ল্যাট। এসব সম্পদের আনুমানিক মূল্য ধরা হয়েছে ১৫ কোটি ৪৫ লাখ ৬৪ হাজার ১৪০ টাকা।
তার অস্থাবর সম্পদের মধ্যে আছে—দুটি জিপ গাড়ি , চারটি ড্রেজার, একটি শটগান, স্বর্ণালংকার ও আসবাবপত্র বাবদ ৩ কোটি ৩ লাখ ৮৯ হাজার ৬০০ টাকা। এছাড়া, ব্যবসায়িক মূলধন হিসেবে ২ কোটি ৪৭ লাখ ১৯ হাজার ২৪৫ টাকাসহ তার অস্থাবর সম্পদের মোট পরিমাণ ধরা হয়েছে মোট ৫ কোটি ৫০ লাখ ৯৮ হাজার ৮৪৫ টাকা।
সেলিম খান ‘শাহেনশাহ’ চলচ্চিত্র নির্মাণে ১ কোটি ২৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও ‘প্রেম চোর’ চলচ্চিত্র নির্মাণে ২ কোটি ৭ লাখ টাকাসহ ৬-৭টি সিনেমা নির্মাণে প্রায় ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকা ব্যয় করেছেন বলে বিভিন্ন নথিপত্রে উঠে এসেছে। এসব অর্থের কোনো বৈধ উৎস এখনো পাননি দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা।
সেলিম খানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয়। তিনি চাঁদপুর সদরের লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়নের বহরিরা বাজার এলাকার গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পে ১ তলা বিশিষ্ট ১০০টি ভবন নির্মাণে অনিয়ম ও ঘর বরাদ্দকালে প্রতিটি ঘর থেকে ১০-১৫ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে।
গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পে নিম্ন মানের কাজ করা ও অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের অভিযোগের বিষয়ে ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর অভিযান চালায় দুদকের কুমিল্লা জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক রাফি মো. নাজমুস সাদাতের নেতৃত্বাধীন একটি দল। অভিযানকালে দুদক টিম সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করে দেখতে পায়, ওই প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়ম হয়েছে। গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পে চেয়ারম্যান মো. সেলিম খান নিজেই বেআইনিভাবে প্রকল্প এলাকার নিকটবর্তী নদী থেকে ড্রেজার দিয়ে লাখ লাখ টন বালু উত্তোলন করেছেন। এতে প্রকল্প এলাকায় নদীভাঙনে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ওই সময়ে প্রকল্পের ১৫টি ঘর নদীতে বিলীন হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। গুচ্ছগ্রামের ঘর বরাদ্দে ঘুষ লেনদেনের সত্যতাও পাওয়া যায়।
ওই বছরের নভেম্বরে সেলিম খানের দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদের বিষয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। এছাড়া, ক্যাসিনোসহ বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসায় জড়িত যে ২০০ জনের তালিকা নিয়ে দুদক অনুসন্ধান করছে সেখানেও সেলিম খানের নাম আছে বলে জানা গেছে।