প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘আশ্রয়ন প্রকল্পের’ মাধ্যমে গত ছয় মাসে জমির সঙ্গে স্থায়ী পাকা ঘরের মালিকানা পেয়েছেন এক লাখ ২৩ হাজার ২৪৪টি পরিবার। এছাড়া সমাজের পিছিয়ে পড়াদের নিয়ে রয়েছে সরকারের পৃথক প্রকল্প। এসব প্রকল্পের আওতায় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী পাচ্ছে ভালো থাকার নিশ্চয়তা। বদলে যাচ্ছে তাদের জীবনযাত্রার মানও। বাদ যাচ্ছে না সমতলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীও। তাদের জন্যও সরকারের রয়েছে নানা পদক্ষেপ, প্রকল্প। রুপকল্প-২০৪১ কে সামনে রেখে পিছিয়ে পড়াদের এগিয়ে আনতে সরকারের নেওয়া এসব কর্মসূচির মাধ্যমে কীভাবে উপকারভোগী হচ্ছেন সুবিধাবঞ্চিত এই মানুষগুলো তা সরেজমিনে দেখেছেন রাইজিংবিডির জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক এসকে রেজা পারভেজ। ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে এসে পরিবর্তনের সেসব গল্পের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে প্রথম পর্ব।
২০০৪ সালে স্বামী মারা যাওয়ার পর দুই মেয়েকে নিয়ে একাই যুদ্ধ করছেন বীরাঙ্গনা মায়া খাতুন (৬৭)। সহায়-সম্বলহীন এই মানুষটি তার কষ্টের দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন এভাবে, ‘অত্যন্ত কষ্টে দিন গেছে বাবা। যখন আমার বাচ্চারা ছোট আছিলো…একটা মেয়ে দেড় বছরের আরেকটা মেয়ে একটু বড়..কিন্তু তহন আমার অবস্থা বেশি খারাপ। তিনদিনও না খাইয়া থাকছি। অনেক কষ্ট করছি।’
বলতে গিয়ে গলা ধরে আসে মায়া খাতুনের। কথা বলতে পারেন না। ‘প্রধানমন্ত্রী আমারারে ঘর দিছে..উনারে অসংখ্য ধন্যবাদ। আল্লায় উরেকে দীর্ঘজীবী করুক। আমারা হায়াত বেটিরে (শেখ হাসিনা) দিক।’
মায়া খাতুনের মতো আরেকজন বীরাঙ্গনা শীলা গুহ। বীরাঙ্গনা হওয়ায় নিজের পরিবারও কাছে রাখেনি, তাড়িয়ে দিয়েছে। পরিবার থেকে অনেক দূরে এসে মানুষের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করতেন। একবেলা খেতেন তো আরেক বেলা থাকতেন না খেয়ে। নেই এক টুকরো মাটি, নেই ঘরও। কয়েকদিন আগেও কষ্ট আর দুঃখ যার নিত্যসঙ্গী ছিলো। সেই শীলা শুহ এখন নতুন ঘর পেয়েছেন। পেয়েছেন জমি। বেদনার জীবনের গল্পের শেষ করে এখন সুন্দর জীবনের স্বপ্ন বুনছেন তিনি।
ভূমিহীন রিকশাচালক আমজাদ হোসেনের গল্পটাও খুব কষ্টের। রিকশা চালিয়ে যা ইনকাম করতেন তা ভাড়া ঘরের মালিকের হাতেই তুলে দিতো হতো। এখন নিজের একটা ঘর হয়েছে, তাতে আনন্দের সীমা নেই আমজাদের।
‘আগে কষ্টে দিন কাটাইছি। সরকার ঘর দেওয়ায় বড় উপকার হইলো। ভাড়া ঘরে থাকি। যা ইনকাম করতা তা দিয়ে চলতে পারতাম না। ভাড়ায় সব টাকা নিয়ে যাইতো। নিজের ঘরে শান্তিতে চাইট্টা ভাত খাইতে পারমু। আমগো পক্ষ থেকে শেখ হাসিনারে ধন্যবাদ জানইবেন মামা’, বলছিলেন আমজাদ।
মায়া খাতুন, শীলা গুহ বা আমজাদ-তিনজনের কষ্টের গল্প পৃথক হলেও বুকের মধ্যে চাপা বেদনা ছিলো একই। কবে নিজের ঘরে শান্তিতে থাকবেন? এই তিনজনের কষ্টের দিন আজ নেই। সবাই নিজের একটি ঘর পেয়েছেন। শুধু ঘর নয় হাতে পেয়েছেন ঘরের মালিকানার দলিলও। সারাদেশে তাদের মতো লাখ লাখ ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য ঘর দিতে বিশ্বের অভূতপূর্ব নজিরবিহীন এক প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে ‘শেখ হাসিনা মডেল’ আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় সম্প্রতি দ্বিতীয় দফায় ঘর পেয়েছেন ৫৩ হাজার ৩৪০ টি পরিবার। এর আগে প্রথম দফায় ৬৯ হাজার ৯০৪টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে বিনামূল্যে জমিসহ ঘর পেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘আশ্রয়ন প্রকল্পের’ মাধ্যমে জমির সঙ্গে স্থায়ী পাকা ঘরের মালিকানা দেওয়ার যে কর্মসূচি শুরু করেছেন, তাতে বদলে যাচ্ছে সব হারানো মানুষগুলোর দুঃখের দিন।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘এই যে মানুষজনকে আমরা ঘর দিচ্ছি এর পরিপ্রেক্ষিতে তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার ক্ষেত্রে, শিক্ষার ক্ষেত্রসহ সার্বিক বিষয়ে কি ধরনের পরিবর্তন আসছে; তাদের জীবনমান উন্নয়নে কি ধরনের উদ্যোগ যুক্ত হচ্ছে; তা মূল্যায়নের জন্য আমরা একটি গবেষণাও করছি।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সুলতানপুর ইউনিয়নের উত্তর জাঙ্গল গ্রামে দ্বিতীয় দফার ২০টি পরিবার জমিসহ ঘর পেয়েছেন। ভূমিহীন এবং গৃহহীন এসব মানুষের মুখে এখন রাজ্য জয়ের হাসি, নিরাপদ জীবনের হাতছানি।
এমন একজন আসাদ মিয়া। বাবা নেই, মা আর ছোট বোনকে নিয়ে সংসার। পেটের তাগিদে ঢাকায় ফুটপাতে খেলনা বিক্রি করতেন। বাবার জায়গা-জমি না থাকায় থাকতেন এখানে-সেখানে। ভূমিহীন-গৃহহীন এখন ২ শতক জমিসহ ঘর পেয়েছেন। স্বপ্ন দেখেন বোনকে লেখাপড়া করে অনেক বড় করাবেন।
আনোয়ারা বেগম আরেকজন ভূমিহীন। দুই ছেলে আর এক মেয়ে তিনিও পেয়েছেন ঘর। ছোট মেয়েটা প্রতিবন্ধি। ঘর পেয়ে খুশির কথা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনা বলছে, ভূমিহীনরা দরখাস্ত দেবে..আমরা দিছি..তারপর ঘর পাইছি। খুব খুশি হইছি। আল্লাহ তারে বাঁচায় রাখুন। আমাদের নিজস্ব জায়গা হইছে। আমরারে দলিলপত্র সব দিয়ে দিছি। শেখ হসিনার উছিলায় আমরা শান্তি পাইলাম।’
উপকারভোগীদের একজন মঞ্জিলা বেগম। এক সময়ে স্বচ্ছল জীবনযাপন করা মঞ্জিলার পরিবারের হঠাৎ নেমে আসে বিপদ। স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার চিকিৎসায় ভিটেমাটি সব বিক্রি করে দিতে হয়। পরে আশ্রয় হয় পরের ঘরে। এখন ঘর পেয়ে নতুন করে সুন্দরভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখেন তিনি।
‘মমতামীয় প্রধানমন্ত্রী…আল্লাহ যেনো উনার হায়াত বাড়িয়ে দেন এবং দেশের কাজে মানুষের জন্য এভাবে কাজ করে যেতে পারেন’, বলেন তিনি।
সময় মতো ঘরের ভাড়া দিতে পরিবার নিয়ে অনেক সময় না খেয়েও কাটাতেন ডালিয়া বেগম (৪৫)। ঘর পেয়ে কেমন লাগছে?- জানতে চাইলে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। বলেন, ‘আমরা অনেক শান্তি সুবিধা আছি বাবা। কল (টিউবওয়েল) দিছে, কারেন্ট দিছে সব দিছে। আমরা যদি গায়ের চামড়া দিয়েও জুতা বানাই দেই শোধ হবে না। আমরা নামাজ পরে দোয়া করি তার হায়াত আরও বাড়ায় দিক।’
শ্রীমঙ্গলের মহাজিরাবাদ এলাকায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ১৪টি ঘর পেয়েছেন ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষ। এসব মানুষের সবারই কষ্টের অতীত। প্রধানমন্ত্রী ঘর পেয়ে যেমন জীবনের নতুন সুর খুঁজে পাচ্ছেন এসব মানুষ, তেমনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বুক ভরে দিচ্ছে দোয়া।
২১ বছর বয়সেই স্বামী হারিয়ে দুই ছেলে মেয়েকে নিয়ে অন্ধকার দেখছিলেন রুনা (২১)। ওঠেন বাবা-মার কাছে। কিন্তু বাবা-মাও যে ঘরহীন-ভূমিহীন। তাই কষ্ট আরও বাড়ে পরিবারের। তাদেরও ঘর দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
‘আগে কষ্টে ছিলাম। ঘর পেয়ে ভালো আছি। স্বামী মারা যাওয়ার পর দুই বাচ্চাকে নিয়ে কষ্টে আছিলাম। প্রধানমন্ত্রীরে ধন্যবাদ ও দোয়া করি।’
মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলের মাইজদিহি গ্রামে দ্বিতীয় প্রায় ১১৮ জন নতুন ঘর পেয়েছেন। এদের একজন জহুর আলী। পেশায় কৃষক। ঘর পেয়ে প্রধানমন্ত্রী প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই তার।
‘আমি ফরের বাড়ি থাইকতাম। এখোন আমার ঘর হইছে। অনেকদিন যাপত পরের ঘরে থাকতাম। প্রধানমন্ত্রী আমারে ঘরবাড়ি দিছে এখন আমি অনেক খুশি। আল্লায় তারে ভালো রাখতো, আমি অনেক খুশি, আল্লায় তারে ভালো রাখতো, হায়াত দিক। আমি আশা কইরা তার লাইগা একটা মার্কা বানাইয়া আনছি।’
উপকারভোগীও মো. ফারুকও (৬৫) ঘর পেয়ে নিজের আনন্দের অনুভূতি ব্যক্ত করেন। বলেন, ‘আল্লাহ উনারে লাখ রাখ হায়াত দিক। উনার জন্য দোয়া করি।’
পরের বাড়িতে থাকার কারণে অনেক মানুষের কথা শুনেছেন খোদেজা (৬৬)। এখন নিজের একটা ঘর হয়েছে।
অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, ‘পরের বাড়ি থাকতাম। ঘর বাড়ি নাই। দুই ছেলে খুব আনন্দ লাগছে। আগে পরের বাড়ি থাকায় খুব কষ্টের। বহুত মানুষের কথা হুনছি, আইজ প্রধানমন্ত্রী একটা ঘর দিয়ে খুব খুশি হইছি।’
মৌলভীবাজার জেলার প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান জানান, মাইজদিহি গ্রামে যেখানে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর করা হয়ছে এই ৩০ একর জায়গায় বেদখলে ছিলো। সেটি জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে দখলমুক্ত করে ঘর করে দেওয়া হয়েছে। মাটি ফেলার পর প্রকল্পের জন্য ঘর তৈরির জন্য উপযুক্ত করা হয়েছে।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের দ্বিতীয় দফায় মৌলভীবাজারে ১১৫১টি ঘর নির্মাণ হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, এর মধ্যে ৬৫৭টি হস্তান্তর করা হয়েছে।
হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান রাইজিংবিডিকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ভূমিহীন ও গৃহহীনদের মাঝে ঘর দেওয়ার মাধ্যমে মানুষের মুখে হাসি ফুটেছে। তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের পাশপাশি পুরুষ ও নারী, দুজনের নামেই কিন্তু ঘর হয়েছে। এতে নারীর ক্ষমতায়নে নতুন মাইলফলক সৃষ্টি হয়েছে। এই অভিনব উদ্যোগের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশ গড়ার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দেশ এগিয়ে গেলো।
তিনি বলেন, হবিগঞ্জ জেলায় প্রথম দফায় ৭৮৭ জন ঘর পেয়েছেন। কেউ ছাগল, মুরগি, সবজি চাষ করছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই নজরিবিহীন প্রশংসিত কর্মযজ্ঞে অংশীদার হতে পেরে আমরা গর্বিত।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া বলেন, আমরা দেখেছি শুধু প্রধানমন্ত্রীর ঘর তৈরি করে দেওয়া ও মালিকানা দেওয়ার মাধ্যমে যে সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল আছে সেই গোলসের ৮টি ইন্ডিকেটরসকে সরাসারি অ্যালাইন করেছে এই কর্মসূচি।
‘এর বাইরে পরোক্ষভাবে আরও প্রায় ৬ থেকে ৭টি ইন্ডিকেটরসকে ক্রসকাট করছে এই গৃহপ্রদান কর্মসূচি। আমরা আশা করি এই ঘর দেওয়ার ফলে একটা হচ্ছে সমতলে এক ধরনের ঘর একই সাথে পাহাড়ি এলাকায় ঘর দেওয়া হচ্ছে। আবার সমতলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীকেও ঘর দেওয়া হচ্ছে’, বলেন মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া।
আরও পড়ুন > শেষ বয়সে শান্তির নীড়ে অশ্রুসজল শকুন্তলা
স্বামীহারা সঞ্চিতার কান্নার জল মুছে দিলেন প্রধানমন্ত্রী