রাইজিংবিডি স্পেশাল

শেষ বয়সে শান্তির নীড়ে অশ্রুসজল শকুন্তলা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘আশ্রয়ন প্রকল্পের’ মাধ্যমে গত ছয় মাসে জমির সঙ্গে স্থায়ী পাকা ঘরের মালিকানা পেয়েছেন এক লাখ ২৩ হাজার ২৪৪টি পরিবার। এছাড়া সমাজের পিছিয়ে পড়াদের নিয়ে রয়েছে সরকারের পৃথক প্রকল্প।  এসব প্রকল্পের আওতায় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী পাচ্ছে ভালো থাকার নিশ্চয়তা। বদলে যাচ্ছে তাদের জীবনযাত্রার মানও। বাদ যাচ্ছে না সমতলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীও। তাদের জন্যও সরকারের রয়েছে নানা পদক্ষেপ, প্রকল্প।  রুপকল্প-২০৪১ কে সামনে রেখে পিছিয়ে পড়াদের এগিয়ে আনতে সরকারের নেওয়া এসব কর্মসূচির মাধ্যমে কীভাবে উপকারভোগী হচ্ছেন সুবিধাবঞ্চিত এই মানুষগুলো তা সরেজমিনে দেখেছেন রাইজিংবিডির জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক এসকে রেজা পারভেজ। ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে এসে পরিবর্তনের সেসব গল্পের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে তৃতীয় পর্ব।

কুড়িয়ে আনা প্লাস্টিকের ব্যাগ, ফেলে দেওয়া পলিথিন আর ছনের জোড়া-তালি দিয়ে অস্থায়ী একটি ঘরে স্বামী সন্তান নিয়ে কষ্টে দিন পার করতেন হবিগঞ্জের কামাইছড়া গ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সদস্য শকুন্তলা ভৌমিক। নিজে জমি নেই, নেই ঘরও। তাই ঠিকানা হতো আজ এখানে তো কাল ওখানে। চা বাগানে কাজ করে কোনো মতে চলতো সংসার। 

সারাজীবনে কষ্টের দিন পার করে শকুন্তলা এখন খুব ক্লান্ত, বয়সের ভারে ন্যুজ! ভালো করে হাঁটতেও পারেন না। মাঝে মাঝে দুর আকাশের দিকে চেয়ে থাকেন আর ভাবেন, বয়স হয়েছে, শেষ জীবনে একটু সুখ কি আসবে না? 

জীবনের সঙ্গে লড়ে যাওয়া শুকুন্তলার ভাবনা এখন আর নেই।  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘আশ্রয়ণ প্রকল্পের’ মাধ্যমে ঘর পেয়েছেন তিনি। বেশ সুখেই আছেন স্বামী সংসার নিয়ে।

আরও পড়ুন: স্বামীহারা সঞ্চিতার কান্নার জল মুছে দিলেন প্রধানমন্ত্রী

ঘর পেয়ে কৃতজ্ঞতা জানাতে ভোলেননি বৃদ্ধ শকুন্তলা। বললেন, ‘আমার শেখ হাসিনা পুরি আমারে বহু সুখ দিছে।  আমি আশীর্বাদ করি যে, আমার পুরিডা যেন আরো ভালো থাকে।’

শকুন্তলার মতো হবিগঞ্জ জেলার বাহুবলে উপজেলার কামাইছড়া গ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জীবন বদলে যাচ্ছে এভাবে।  সমাজের মূল ধারার সঙ্গে তাল মেলাতে না পারা এসব জনগোষ্ঠীকে সামনের কাতারে নিয়ে আসতে কাজ করছে সরকার। এর অংশ হিসেবে সমতলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষদের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেওয়া নানা উদ্যোগে ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে তাদের জীবনধারা। 

এখানকার ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীর বেশিরভাগ পরিবার চা বাগানে কাজ করেন। এক সময়ের ‘অবহেলিত’ এই চা শ্রমিকদের জীবনে এখন শুধুই পরিবর্তনের ছোয়া। পাকা বাড়ি ঘর হয়েছে, এসেছে বিদ্যুৎ, পাচ্ছেন সুপেয় পানি, এসেছে ডিজিটাল বিনোদন মাধ্যম।  যেখানে আগে শিক্ষার হার নেই বললেই চলেতো, সেখানে এখন উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে এসব ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সন্তানরা। আর্থসামাজিক উন্নয়নে ধীরে ধীরে সমাজের মূল ধারায় যুক্ত হচ্ছেন এসব জনগোষ্ঠী।

যেমনটি বলছিলেন বাহুবল উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) স্নিগ্ধা তালুকদার। রাইজিংবিডিকে তিনি বলেন, ‘গত ১২ বছরে তাদের জীবনযাপন এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। শিক্ষার হার বেড়েছে। সমতলের এই নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে এখন ৪৪—৪৫ ভাগ শিক্ষিত। তাদের মধ্যে গ্রাজুয়েট আছে বেশিরভাগ। মহিলাদের ক্ষমতায়নের বিষয়ে অগ্রাধিকার দেওয়ায় তারা এখন উদ্যোক্তা হচ্ছেন। তাদের সমাজের মূল ধারায় নিয়ে আসার যে প্রক্রিয়া ছিলো সেই ধারাবাহিকতায় গত ১২ বছরে অনেক এগিয়েছে তারা।’ 

আরও পড়ুন: নতুন ঘরে সুন্দর জীবনের গল্প বুনছেন তারা

কামাইছড়া এই অঞ্চলে প্রায় তিন শতাধিক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বাস। এখানে প্রায় তিন শতাধিক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবারের বাস। ঐতিহ্যগতভাবেই তারা চা-শ্রমিক।  প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তারা বাগানে কাজ করেন এবং বংশ পরম্পরায় বাস করেন বাগানের জমিতেই। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ‘আশ্রায়ণ প্রকল্পে’র প্রথম পর্যায়ে এ গ্রামে চারটি ঘর দেওয়া হয়। গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয়, ক্লিনিক, সমবায় সমিতি রয়েছে।  আগে পরিবারের সবাইকে চা বাগানে কাজ করতে হতো। এখন চা বাগানে কাজ করার পাশাপাশি বিভিন্ন পেশায়ও যুক্ত হয়ে পড়ছেন তারা।

লাল শাহ রবি দাস এমন একজন। ২৫-২৬ বছরের এই তরুণ চা বাগানের কাজের অবসরে নিজের ফার্নিচারের দোকানে কাজ করেন। করেন কৃষিকাজও।  সব মিলে বাবা-মা ও স্ত্রী সন্তান নিয়ে সুখে আছেন বলে জানান তিনি।

বাবা সুভাষ রায় ও মা অপর্ণা রায় দুজনেই চা বাগানে কাজ করেন। আর আদের সন্তান ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী জীবন রায়। তারা স্বপ্ন দেখেন পড়াশোনা করে একদিন জীবন অনেক বড় হবে। বড় হয়ে চা বাগানের কাজ নয়, বরং পুলিশ অফিসার হয়ে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনবে তাদের ছেলে। 

সমতলে বসবাসরত নৃ-গোষ্ঠীভুক্ত জনগণের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বাস্তবায়নাধীন বিশেষ এলাকার জন্য উন্নয়ন-সহায়তা (পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়া) শীর্ষক কর্মসূচির আওতায় বদলে যাচ্ছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জীবন। রয়েছে পাকা রাস্তা। উন্নত হয়েছে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা। রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। চা শ্রমিকের বাইরে সন্তানদের শিক্ষিত করে সম্মানজনক চাকরির স্বপ্ন দেখেন অনেকেই।

নব জীবনের রূপ দেখতে পেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রাণভরে শুভ কামনা জানিয়েছেন বৃদ্ধ শকুন্তলা।

আগের জীবন আর এখনের জীবনের স্মৃতিচারণ করে রাইজিংবিডিকে তিনি বলেন, ‘আগে বহুত কষ্টের দিন গেছে।  এখন ছেলের বিয়া শাদি হয়াছে। ঘর নাই দুয়ার নাই। নতুন বউ লইয়া পোলা ভাঙা ঘরে ঘুমায়ছে।  চাল সিদ্ধ করে বাচ্চা কাচ্চারে খাওয়াইছি।  এতো কষ্ট আমার গেছে।’

‘এরপর শেখ হাসিনা আমারে একটা ভাতা করে দিলো। ওই একটু ভাতা দিয়ে চলছি। এখনো ভাতা পাই।  দিনে যদি খাই রাতে উপোস। রাতে যদি খাই দিনে উপোস, এমন দিন গেছে। আমার কোনো ঘর নাই।  নতুন ঘর, কাপড় কেনবো এমন আমার ভাগ্যে নাই। আমি কার কিতা করবো। আমারে এতো আল্লায় কষ্ট দিতেছে। এখন সুখে রাখি ঘর পেয়ে।  শেখ হাসিনাকে বাঁচায় থাকুক।”

শকুন্তলার নাতি কাঞ্চন ভৌমিক বলেন, ‘আগে ভাঙাচোরা ঘরে আছিলাম।  এখন শেখ হাসিনা ঘর দিয়ে শান্তিতে আছি।  আগে ঘরে পানি পরতো। খুব কষ্ট। এখন সুবিধায় আছি।’

আগে কামাইছড়া চা বাগানে কাজ করতেন বিশ্বনাথ মিশ্র।  বয়স হয়েছে তাই এখন আর কাজ করেন না। ১৯৮৩ সাল থেকে তিনি এ বাগানে কাজ করেন।  তখন ২৪ টাকা বেতন পেতেন।  কাজ করতে হতো ১২-১৩ ঘণ্টা।  তিনি বলেন, এক সময় ছনের তৈরি ঘরে থাকতাম। এখন ভালো আছি। দুই ছেলের একজন মন্দিরে কাজ করেন আরেকজন ইলেকট্রনিক্সের কাজ করেন। এখন পাকা বাড়িতে থাকেন।

তাদের আগের জীবনযাপন আর বর্তমানের আকাশ-পাতাল ফারাক দেখেন বিশ্বনাথ। তিনি বলেন, আগের চা বাগানের আগের চিত্র পাল্টে গেছে।  আগে রাস্তা ছিল না। শেখ হাসিনা রাস্তা করে দিয়েছেন। টিউবওয়েল বসিয়ে দিয়েছেন। গ্রামে স্কুল রয়েছে।  ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনা করছে। অনেকেই নতুন করে উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখছে।

আগের তুলনায় এই অঞ্চলেল ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ ভালো আছেন জানিয়ে কামাইছড়া চা বাগানের পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি বিমল বট পারিশ্রমিক আরও একটু বাড়ানোর দাবি করেন। 

রাইজিংবিডিকে তিনি বলেন, চা শ্রমিকরা যাতে আরও একটু বেশি হারে বেতন পান, সেজন্য যেন সরকার সুদৃষ্টি দেয়। এতে তাদের জীবনমান আরও উন্নয়ন হবে। এলাকার উন্নয়নে সরকারকে ধন্যবাদ জানান তিনি।

বাহুবল উপজেলার উপজেলা নির্বাহী অফিসার-ইউএনও স্নিগ্ধা তালুকদার বলেন, ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অনেকে চা বাগানে কর্মরত আছেন। এছাড়া অন্য পেশায়ও আছেন। অনেকে তাত ও মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত। একটা সময় ছিলো যখন তারা অবহেলিত ছিলো। তারা নিজেদের মেইনস্ট্রিমের সঙ্গে একাত্ম করতে পারতো না। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে তাদের মূল ধারায় যুক্ত করতে যে প্রয়াস শুরু হয়েছে এর মাধ্যমে আমাদের বিভিন্ন প্রকল্প তাদের জন্য রয়েছে।

তিনি বলেন, প্রাণী সম্পদের মাধ্যমে ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর জন্য বিনামূল্যে গরু এবং ছাগল বিতরণ করার কর্মসূচি চলমান রয়েছে। বাহুবলের প্রায় ১০০টি পরিবার এই প্রকল্পের মাধ্যমে সুবিধা আওতাধীন। এছাড়া সমবায় অধিদপ্তরের মাধ্যমে সহযোগিতা করা হচ্ছে। বিভিন্ন ঋণ কার্যক্রম চালু রয়েছে। মহিলা ও সমাজকল্যাণের জন্য পৃথক প্রকল্প রয়েছে। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে তারা সুবিধাভোগী হয়েছে।’ 

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া রাইজিংবিডিকে বলেন, ৪৬টি জেলার ২০৭টি উপজেলায় ক্ষু নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী আছে।  প্রায় ৩৫টির অধিক ক্ষু নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী বসবাস করে এসব জায়গায়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা হচ্ছে, এই সমতলে বসবাসরত ক্ষু নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে কর্মসূচি গ্রহণ করা। তারই ভিত্তিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে। এই ক্ষেত্রে আমরা এ বছরে অর্থাৎ ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩ হাজার ৫৫৪ জন ক্ষু নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী সদস্যদের স্বামী-স্ত্রীর যৌথনামে রেজিস্ট্রার করে ঘর বানিয়ে দিয়েছি।

তিনি বলেন, ‘এই যে মানুষজনকে আমরা ঘর দিচ্ছি এর পরিপ্রেক্ষিতে তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার ক্ষেত্রে, শিক্ষার ক্ষেত্রসহ সার্বিক বিষয়ে কি ধরনের পরিবর্তন আসছে; তাদের জীবনমান উন্নয়নে কি ধরনের উদ্যোগ যুক্ত হচ্ছে; তা মূল্যায়নের জন্য আমরা একটি গবেষণাও করছি।’