রাইজিংবিডি স্পেশাল

স্তন ক্যান্সার স্ক্রিনিং প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে হচ্ছে ৪ গুণ

দেশের সব উপজেলায় জরায়ু-মুখ ও স্তন ক্যান্সার স্ক্রিনিং সেবা চালুর লক্ষ্যে নেওয়া প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় প্রতিনিয়ত বাড়ানো হচ্ছে। ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সাড়ে ৪৯ কোটি টাকার ‘ইলেকট্রিক ডাটা ট্র্যাকিংসহ জনসংখ্যাভিত্তিক জরায়ু-মুখ ও স্তন ক্যান্সার স্ক্রিনিং কর্মসূচি (ইপিসিবিসিএসপি)’ প্রকল্পটির অনুমোদন দিয়েছিল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। পরে প্রথম সংশোধনের মাধ্যমে প্রকল্পটির ব্যয় ৫৬ কোটি ৭৮ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয় এবং মেয়াদ এক বছর বাড়ানো হয়। বর্তমানে প্রকল্পটির পরিধি ও কার্যক্রম বাড়িয়ে দ্বিতীয় সংশোধনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। দ্বিতীয় সংশোধনীতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৯৮ কোটি টাকা ৯৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রকল্পের ব্যয় প্রায় ৪ গুণ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, সব উপজেলায় জরায়ু-মুখ ও স্তন ক্যান্সার স্ক্রিনিং সেবা চালু করতে এ প্রকল্পটি নিয়েছে সরকার। এর মাধ্যমে দেশে জরায়ু-মুখ ও স্তন ক্যান্সার স্ক্রিনিং, ব্যবস্থাপনা এবং ফলো-আপের জন্য কার্যকর রেফারাল পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করে ক্যান্সারজনিত মাতৃমৃত্যুর হার কমনোর চেষ্টা করা হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) বাস্তবায়িতব্য প্রকল্পটির ব্যয় ও মেয়াদ বাড়নোর লক্ষ্যে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। প্রথমে প্রকল্পের আওতায় ২০০টি উপজেলা থাকলেও এখন প্রত্যেক উপজেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে চায় বিএসএমএমইউ।

বিএসএমএমইউ জানায়, বাংলাদেশে জরায়ু-মুখ ও স্তন ক্যান্সার স্ক্রিনিং, ব্যবস্থাপনা এবং ফলো-আপের জন্য কার্যকর রেফারাল পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করে মাতৃমৃত্যুর হার কমানো হবে। সরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে (ইনস্টিটিউট, মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, জেলা হাসপাতাল, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, নির্বাচিত কমিউনিটি ক্লিনিক) ইলেকট্রনিক ডাটা ট্র্যাকিংসহ জরায়ু-মুখ ও স্তন ক্যান্সার স্ক্রিনিংয়ের অবকাঠামো উন্নয়ন করা হবে। সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এ সংক্রান্ত চিকিৎসার সুবিধা বাড়ানো হবে। এর পাশাপাশি জরায়ু-মুখ ও স্তন ক্যান্সার রোগীদের উন্নত চিকিৎসাসেবা দেওয়ার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনকোলজি ভবনে (ব্লক-এফ) ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণের মাধ্যমে ৩৩ হাজার ৫১২ বর্গফুট জায়গায় অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে।

প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক ডা. আশরাফুন্নেসা বলেছেন, ‘এ প্রকল্পের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে জরায়ু-মুখ ও স্তন ক্যান্সার রোগীদের জন্য ৯০টি শয্যা বাড়ানো ও অবকাঠামো উন্নয়ন করা হবে। ৬৪টি জেলা ও ৪৯২টি উপজেলায় জরায়ু-মুখ ও স্তন ক্যান্সার স্ক্রিনিং সেবা যুক্ত করা হয়েছে সংশোধিত প্রস্তাবে। এছাড়া, ৬০০টি সরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ৯ হাজার ১৬৬ জন সেবা প্রদানকারীর (কর্মকর্তা, চিকিৎসক, নার্স, মিডওয়াইফ ও এফডাব্লিউভি) দক্ষতা বাড়ানো হবে।

পরিকল্পনা কমিশনের সিনিয়র সহকারী প্রধান সাইনী আজিজ প্রকল্পের বিষয়ে রাইজিংবিডিকে বলেছেন, ‘স্টিয়ারিং কমিটির মিটিং অনুয়ায়ী প্রকল্পটির কার্যপরিধি বাড়ানো হয়েছে। প্রথমে এ প্রকল্পের মাধ্যমে ২০০টি উপজেলায় কাজ করার কথা ছিল। কিন্তু স্টিয়ারিং কমিটির সিদ্ধান্ত অনুয়ায়ী এখন দেশের সব উপজেলায় প্রকল্পের কাজ করা হবে। সেজন্য প্রকল্পটি সংশোধনের প্রস্তাব পাঠিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। প্রকল্পটির ওপর আগামী ২৭ জানুয়ারি পিইসি সভা হবে। প্রকল্পটি নেওয়াই হয়েছে ব্রেস্ট ক্যান্সার ও জরায়ু-মুখ ক্যান্সার স্ক্রিনিংয়ের জন্য। নারীদের ক্ষেত্রে প্রকল্পটি সহায়ক হবে। প্রকল্পের কাজ ভালোভাবেই করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ ৫৫-৫৬ শতাংশ হয়েছে। যথাসময়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে এর সুফল পাবে জনগণ।’   

জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটের ক্যান্সার ইপিডেমিওলজি বিভাগের ডা. মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন রাইজিংবিডিকে বলেছেন, ‘এ কর্মসূচিতে গত ১৫ বছরে মাত্র ১০ শতাংশ লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। ক্যান্সারের স্ক্রিনিংয়ের যে তাত্ত্বিক দিক আছে, এ বিষয়টা বিএসএমএমইউর কর্মসূচিতে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। এ পুরো প্রোগ্রামটা ফ্যাসিলিটিবেইজড। হাসপাতালে মানুষজন আসবে এবং টেস্ট করিয়ে চলে যাবে। কিন্তু মানুষদের যে বুঝিয়ে নিয়ে আসতে হবে সে বিষয়ে, সেটা কিন্তু হচ্ছে না। বাস্তবে এ কর্মসূচির মাধ্যমে কাভারেজ হয়েছে ৭ থেকে ৮ শতাংশ।’

তিনি বলেন, ‘এখন এ কাভারেজ বাড়াতে হলে প্রথমেই আমাদের হাসপাতালভিত্তিক পদ্ধতি থেকে বের হয়ে কমিউনিটিভিত্তিক প্রোগ্রামে যেতে হবে। এবার কোভিডের ভ্যাকসিন দিতে যেভাবে কাজ করা হয়েছে, সেভাবে ইউনিয়ন পর্যায় থেকে এ প্রোগ্রাম শুরু করতে হবে। গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে কী পরিমাণ ক্যান্সার রোগী আছেন, সেটা ঢাকায় বসে নির্ণয় করা সম্ভব না। ট্র্যাকিং সিস্টেমে শুধু ধারণা পাওয়া সম্ভব, নির্ণয় করা সম্ভব না। স্যতিকার অর্থে ক্যান্সারের ইনসিডেন্ট বের করতে গেলে তাত্ত্বিক এবং প্রায়োগিক দিকগুলো বিবেচনায় নিতে হবে। কিন্তু এগুলো এই কর্মসূচিতে বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না।’ 

এদিকে, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পিইসি সভায় যেসব বিষয়ে আলোচনা করা হবে, তা হচ্ছে— ১. গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের ক্রমপুঞ্জিভূত অগ্রগতির বিষয়ে পিইসি সভায় জানাতে হবে।

২. প্রকল্পের আওতায় আউটসোর্সিং খাতে নতুন করে ৪৫ জনকে নিয়োগের প্রস্তাব করা হলেও ৩৭ জনের জন্য অর্থ বিভাগের সুপারিশ নেই। প্রস্তাবিত ৩৭ জনের পরিবর্তে ৮ জনের সংস্থান রাখা যেতে পারে। এছাড়া, প্রকল্পের আওতায় তিনটি গাড়ির প্রস্তাব করা হলেও আউটসোর্সিং খাতে চারজন ড্রাইভারের সংস্থান রাখা হয়েছে, যার যৌক্তিকতা জানা প্রয়োজন। প্রস্তাবিত আরডিপিপিতে তিনটি যানবাহনের সংস্থান থাকলেও চারটি যানবাহন মেরামতের ব্যয় প্রাক্কলনে দেখানো হয়েছে।

৩. প্রকল্পের অর্থায়নের নিশ্চয়তা সংক্রান্ত সচিবের প্রত্যয়নপত্র ও এমটিবিএফ সংক্রান্ত তথ্যাদি আরডিপিপিতে সংযুক্ত করা হয়নি।

৪. প্রকল্পের আওতায় যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম, বই ও সাময়িকী এবং ইন্টারনেট/ফ্যাক্স/টেলেক্স কেনার ক্ষেত্রে অদ্যাবধি চুক্তি হয়নি। এসব ক্ষেত্রে ক্রয় পদ্ধতি হিসেবে আরএফকিউএম ও ডিপিএমের পরিবর্তে ওটিএমের সংস্থান রাখা প্রয়োজন। অনুরূপভাবে, সেবা ক্রয়ের ক্ষেত্রে কনসালটেন্সি ছাড়া সকল ক্ষেত্রে ক্রয় পদ্ধতি হিসেবে যেকোনো একটি পদ্ধতির এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ওটিএমের সংস্থান রাখা প্রয়োজন।

৫. প্রকল্পের আওতায় ‘ইলেক্ট্রোসার্জিক্যাল ইক্যুইপমেন্ট উইথ হারমোনিক স্কালপেল সেট (২০ লাখ টাকা), অটোক্লেভ (৪০ লাখ টাকা), ম্যামোগ্রাফি মেশিন অ্যান্ড একসেসরিজ ও সিআর মেশিন’ (২ কোটি ২০ লাখ টাকা), আল্ট্রাসাউন্ড মেশিন ও অন্যান্য একসেসরিজ (১ কোটি ৮০ লাখ টাকা) ইত্যাদিসহ বেশকিছু নতুন যন্ত্রপাতির প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া, কতিপয় যন্ত্রপাতির ইউনিটপ্রতি মূল্য অনুমোদিত আরডিপিপির চেয়ে বেড়েছে। এ বিষয়গুলোর যৌক্তিকতা জানা প্রয়োজন।

৬. আসবাবপত্রের আওতায় বেশকিছু নতুন যন্ত্রপাতির প্রস্তাব করা হয়েছে। এর প্রয়োজনীয়তা জানা যেতে পারে। এছাড়া, নতুন প্রস্তাবিত আসবাবপত্রের মধ্যে হাসপাতাল বেডের সংস্থান রাখা হয়েছে। বিভিন্ন প্রকল্পসহ সেক্টর কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন হাসপাতালে বেড সরবরাহ করা হয়, তাই এ প্রকল্প থেকে বেডের সংস্থান বাদ দিতে হবে।

৭. সব আসবাবপত্র সুনির্দিষ্ট স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী উল্লেখ করা প্রয়োজন। অনুমোদিত আরডিপিপিতে আসবাবপত্রের পরিমাণ বাড়ানোর যৌক্তিকতা দেখাতে হবে।