রাইজিংবিডি স্পেশাল

শিশু বয়সেই পথের কন্যাশিশু হয়ে ওঠে ‘নারী’

দিনভর কাজ শেষে ক্লান্তদেহে ঘুমিয়ে ছিল সাদিয়া (ছদ্মনাম)। ওর বয়স ১২। নানা কারণে আজ সে পথেই ঘুমায়। বেশিরভাগ সময়ই ঘুমাতে হয় রেল স্টেশনে বা কোনো ওভার ব্রিজের উপরে। ঘুমের মধ্যে সে প্রায়ই দেখে দুষ্টু-মিষ্টি স্বপ্ন। স্বপ্নগুলো ফিকে হয় ঘুম ভাঙলেই। তখন সে ভাবে, কল্পনার জগতই বেশি সুন্দর। রাজধানীর রাজপথে ঘুমায় সাদিয়ার মতো অগণিত কন্যাশিশু। 

ঢাকায় উদ্বাস্তু শিশুদের মধ্যে ঠিক কতোজন বা কতো শতাংশ মেয়ে তার সঠিক পরিসংখ্যান মেলেনি। তবে, অনুসন্ধান ও পথশিশুদের সাক্ষাৎকার থেকে ধারণা করা যায়, শুধু ঢাকাতেই হাজারো পথ-কন্যাশিশু রয়েছে। একজন শিশুর জীবন ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলতে পারে এমন সব বৈশিষ্ট্য আছে তাদের জীবনযাপনে। জরাজীর্ণ সেসব জীবনে বাবা-মা কিংবা কোনো আপনজনের দেখা মেলে না। ওদের খাবারের খোঁজ থাকে না, গোসল, পোশাক কিংবা ঘুমের কোনো রুটিন নেই। শিক্ষার অধিকার নেই। যৌন নিরাপত্তা তো নেইই। ওদের জীবনের কোনো গন্তব্য থাকে না। ওরা যখন পথে নামে, তখন চিন্তা করে না শেষ পরিণতি সম্পর্কে। হয়তো কোনো একদিন পথের ঘরে ঘরণী কিংবা যৌনকর্মীতে পরিণত হয় ওরা।

ঢাকার রাস্তার জীবন কাটানো ২০ জন পথ-কন্যাশিশুর সাক্ষাৎকার নেয় রাইজিংবিডি। শিশুদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, ভিক্ষা ছাড়াও ওরা নানা কাজ করে। ময়লা আবর্জনা থেকে প্লাস্টিক, বোতল, লৌহজাত পণ্য আলাদা করে বিক্রি করে। ওরা ফুটপাতের রেস্তোরাঁ কিংবা চায়ের দোকানে কাজ করে। চাপকলের পানি পৌঁছে দেয় দোকানে দোকানে। ফুল বিক্রি করে। এসব কাজের পারিশ্রমিকেই হয় খাবারের ব্যবস্থা। মোটের ওপর নিজের খাবারটুকুর ব্যবস্থা করাই যেন ওদের জীবনের সারকথা-শেষকথা। খাবার পেলেই হলো, তা কুড়িয়ে হোক, কোনো কাজের বিনিময়ে হোক কিংবা ভিক্ষার টাকায় হোক। এরপর রাতের পথে, ফুটপাতে, স্টেশনে ওরা ঘুমিয়ে থাকে। পথে ঘুমন্ত সেই মেয়েটি শিকার হয় শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের।

ঢাকার ফ্লাইওভারে একাধিক মেয়ে পথশিশুর রাত কাটে

যৌনতা বোঝার আগেই ওদের অনেকে সতীত্ব হারায়। উন্মুক্ত স্থানে অনিরাপদ রাত্রিযাপনের কারণে অনেক সময় এমন ঘটনা ঘটে। যৌনশিক্ষা তো দূরের কথা, বরং যৌন সুরক্ষাই মেলে না এই অবুঝ কন্যাদের। কোনো ছেলে পথশিশু, হকার, রিকশা চালক বা পথের উদ্বাস্তু তরুণ-যুবকদের সঙ্গে ওরা মিলিত হয়। জোরপূর্বক কিংবা প্রলোভিত করা এই ঘটনাগুলো অপরাধের তালিকায়ও ওঠে না। 

শুধু অনিচ্ছাকৃত নয়, স্বেচ্ছায়ও ওরা যৌনতায় জড়ায়। বাধাহীন, ভীতিহীন, শাসনহীন জীবনব্যবস্থার কারণে খুব অল্প বয়সে ভাসমান শিশুরা এ পথে পা বাড়াতে বাধ্য হয়। ফলে, বিপরীত লিঙ্গের অন্য একটি পথশিশুর প্রতি ওরা সহজেই দুর্বল হয়ে পড়ে। উন্মুক্ত বসবাসের কারণে ১০-১২ বছর বয়সের মধ্যেই প্রথম যৌনমিলনের সুযোগ পায় পথশিশুরা। 

এছাড়াও ঋতুস্রাবজনিত কারণে সৃষ্ট রোগঝুঁকির প্রথম সারিতে আছে পথ-কন্যাশিশুরা। স্বাস্থ্যবিজ্ঞান সূত্রে জানা যায়, পিরিয়ডের সময়ে অপরিচ্ছন্ন থাকলে নানা রকম রোগ হতে পারে। অনেকের প্রস্রাবে ইনফেকশন, প্রস্রাবের রাস্তার চুলকানি হতে পারে। ব্যাকটেরিয়া থেকে ত্বকে ফুসকুড়ি ও টিএসএস (টক্সিক শক সিনড্রোম) ছড়াতে পারে। শুধু মাসিক চলাকালে অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের জন্য নারীদের জরায়ু মুখে ক্যানসারে আশঙ্কাও থাকে। আর পথ-কন্যাশিশুদের জীবনে এসব রোগ শরীরে জন্ম নিয়ে, শরীরেই মরে যায়। ওরা রোগের খবর জানেও না, আক্রান্ত হলেও চিন্তিত হয় না।

ঋতুস্রাব প্রসঙ্গে প্রশ্নের ভিত্তিতে একাধিক পথ-কন্যাশিশু জানায়, ঋতুস্রাব চলাকালে ওরা কারো সাহায্য-সহায়তা নিতে পারে না। মানসিক কোনো সমর্থন পায় না। এ সময় শারীরিক সমস্যা হলেও কোনো চিকিৎসাও মেলে না। এমনকি সেই দিনগুলোতেও ওরা প্রতিদিন গোসল করতে পারে না। কোনো ন্যাপকিন, টিস্যুপ্যাড তো দূরের কথা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, জীবাণুমুক্ত এক টুকরো কাপড়ও জোটে না।

এসবের চেয়ে আরো ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় অনেক পথ-কন্যাশিশু। উন্মুক্ত যৌনমিলনের ফলে গর্ভবতী হয় অনেকেই। মাত্র ১৩-১৪ বছর বয়সের একাধিক মেয়ের সন্তানসম্ভবা হওয়ার উদাহরণ রয়েছে। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে ভ্রাম্যমাণ পরিচিত হিজড়া, ভাসমান যৌনকর্মী, নেশাদ্রব্য বিক্রেতা ও পথশিশুদের নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কারো কাছে দ্বারস্থ হয় তারা। পাশাপাশি সেই সন্তান নষ্ট করতে ফার্মেসির সাহায্য নেয় ওরা। 

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, পথ-কন্যাশিশুরা অনেকেই উদ্বাস্তু কোনো পুরুষের ঘরণী হয় খুব অল্প বয়সে। দুজন মিলে নতুন করে উদ্বাস্তু সংসার বাঁধে পথেই। শিশু বয়সেই ওরা পরিণত হয় নারীতে। এরপর অল্প বয়সেই সন্তানসম্ভবা হয়। অতঃপর স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ে মা ও শিশু উভয়েই। সুন্দর জীবনের স্বপ্ন, ভালোভাবে জীবন কাটানোর ইচ্ছে, একটু নির্ভরতার জন্য, নিরাপত্তার কারণে তারা না বুঝেই বিয়ে করে। কিন্তু নিজেকে ভালো রাখতে চাইলেও সম্ভব হয় না। বিপদ ও খারাপ নজর তাদের পিছু ছাড়ে না।

স্টেশনে মেঝেতে বিছানাহীন ঘুমিয়ে পড়ে মেয়ে পথশিশুরা

বিষয়টি নিয়ে কথা হলে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সোস্যাল ডেভলভমেন্ট ওয়ারকার ফোরামের নির্বাহী পরিচালক শায়লা শাম্মি বলেন, কন্যা-পথশিশুরা নানা রোগের শিকার হচ্ছে। খোলা রাস্তায় নোংরা পরিবেশের কারণে ছেলেদের থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মেয়েরাই। ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের বেশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও নিরাপদ জায়গা দরকার হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। পথশিশুদের দুনিয়ায় ছেলে-মেয়ে সবই সমান, সবাই পথিক, সবাই অনিরাপদ।

তিনি আরো বলেন, একজন পথশিশু যতক্ষণ পর্যন্ত না নিজে বুঝবে সে সক্ষম, যতক্ষণ না সে তার অধিকার সম্পর্কে জানবে, ততদিন এমন কঠিন বাস্তবতা থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারবে না। তাই আগে দরকার শিশুদেরকে নিজের সম্পর্কে জানানো। ওদেরকে নিজের অধিকার, শরীর ও রোগ প্রসঙ্গে সচেতন করে তোলা। 

এ বিষয়ে কথা বলেন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আপন ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ আফতাবুজ্জামান। তিনি বলেন, ঢাকায় কন্যা-পথশিশুরা ছেলেদের থেকেও অধিক ঝুঁকিতে রয়েছে। দরিদ্র্য, মা-বাবার বিচ্ছেদ, হারিয়ে যাওয়াসহ নানা কারণেই দিন দিন পথশিশু বাড়ছে। এছাড়াও অনেক অভাবী পরিবার তাদের মেয়েকে গৃহকর্মীর কাজে পাঠায়, কিন্তু সেসব কাজের কষ্ট ও মানসিক চাপের কারণে ওরা পালিয়ে আসে। পরে পথশিশুতে পরিণত হয়। আবার দেখা যায়, অনেক পরিবার রোজগার-ভিক্ষাসহ নানা কারণে শিশুদের পথে নামায়। পরে এরা অন্য পথশিশুদের সঙ্গে মিশে পুরোপুরি পথশিশুতে পরিণত হয়। 

আফতাবুজ্জামান বলেন, দীর্ঘদিন পথে থাকতে থাকতে একটি মেয়েশিশুও সঙ্গদোষে নেশা দ্রব্যের সংস্পর্শে আসে। মেয়েদের দিয়ে মাদক পরিবহনে ঝুঁকি কম থাকায়, মাদক কারবারিরা মেয়েদেরকে নানা প্রলোভনের মাধ্যমে নিজের দলে টানে। পরে এই মেয়েরা মাদক পরিবহক  হিসেবেও কাজ করে। পাশাপাশি তারা বাজে চক্রের নজরে পড়ে, পতিতা মেয়েরাও তাদেরকে দলে ভেড়ায়, এভাবে একটি মেয়ে পথশিশু অন্ধকার গন্তব্যে মিলিয়ে যায়। মেয়ে পথশিশুদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি, তারা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। ফলে বাড়ছে অবৈধ গর্ভধারণ ও গর্ভপাত।

(ব্যক্তিগত মর্যাদা ও নিরাপত্তার স্বার্থে শিশুদের প্রকৃত নাম-পরিচয় ব্যবহার করা হয়নি)

পড়ুন তৃতীয় পর্ব: জুতার কষে বশ মেনেছে অবুঝ-জীবন