সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, দেশে-বিদেশে শহিদ মিনার নির্মাণের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের আদল অনুসরণ করা হচ্ছে না। যে যার মতো করে মিনার নির্মাণ করে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। অথচ, আমাদের জাতীয় শহিদ মিনার একটি নির্দিষ্ট ভাবনা থেকে নির্মিত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রথিতযশা শিল্পীরা ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্যকে ধারণ করে এ শহিদ মিনার নির্মাণ করেছেন। মায়ের সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক। মা ও ভাষাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে শহিদ মিনারের স্থাপনার মাধ্যমে। কিন্তু, ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর পার হলেও এটি আকৃতিতে একই আদল পায়নি।
মহান ভাষা আন্দোলনের শহিদদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহিদ মিনার নির্মাণের আদেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। একই নির্দেশনা দিয়েছিল মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। তবে, যেসব প্রতিষ্ঠানে শহিদ মিনার আছে, সেগুলো সঠিক আদলে নেই। সারা দেশে একেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শহিদ মিনার একেক আদলে তৈরি করা হয়েছে।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, শহিদ মিনার নির্মাণ করা হয় আমাদের ভাষাশহিদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের উদ্দেশ্যে। সারা দেশে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একই আদলে শহিদ মিনার নির্মাণ করা জরুরি।
একই আদলের শহিদ মিনার নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছে দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো। তাদের দাবি, শহিদ মিনারের আদল হবে এরকম: মা তার সন্তানদের আগলে রাখছে। মা মাঝখানে পিঠে হাত দিয়ে ধরে রাখছে। একটু বাঁকানো হবে মিনারগুলো। দুই পাশে দুটো স্তম্ভ থাকবে। গোল লাল বৃত্ত থাকবে পেছনে।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, সারা দেশে শহিদ মিনারের আকার ও অবয়ব যেন একই রকম থাকে, রাষ্ট্রীয়ভাবে এ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এখন থেকে যেসব শহিদ মিনার হবে তা ঢাকা কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের আদলে তৈরি করা আবশ্যক করতে হবে।
কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের কাঠামো অনুসরণ করে দেশে–বিদেশে সর্বত্র একই ধরনের শহিদ মিনার নির্মাণে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে গত বছরের ২২ জুলাই রুল দিয়েছেন হাইকোর্ট।
একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের কাঠামো অনুসরণ করে দেশে–বিদেশে সর্বত্র একই ধরনের শহিদ মিনার নির্মাণে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়নে নিষ্ক্রিয়তা কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা–ও জানতে চাওয়া হয়েছে রুলে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, শহিদ মিনার নির্মাণের সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য আছে৷ সেটা হচ্ছে—আমাদের ভাষাশহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা। শহিদ মিনারে সুনির্দিষ্ট ডিজাইন থাকা জরুরি।
তিনি বলেন, এটা হতে পারে যে, সব প্রতিষ্ঠানে শহিদ মিনার নির্মাণের অবারিত জায়গা নাও থাকতে পারে। তবে, যদি একটি সুনির্দিষ্ট ডিজাইন থাকে, সেটি মেইনটেইন করে জায়গার অনুপাত ছোট-বড় হতে পারে। কিন্তু, একই আদলে হতে হবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই আমাদের আজকের স্বাধীনতা, স্বাধীন দেশ। ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতির সৃষ্টি। স্কুলের আঙিনায় শহিদ মিনারের মতো একটি স্মৃতিফলক থাকলে শিশুমনে চেতনার ভিত্তি শক্তিশালী হবে। এক্ষেত্রে এটি নির্মাণেও সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা ও সঠিক অবয়ব থাকা জরুরি।
শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন আমাদের দেশের দামাল ছেলেরা। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে শহিদদের আত্মত্যাগের ইতিহাস অবশ্যই শিক্ষার্থীদের জানা উচিত। আকারের চেয়ে এটি সব জায়গায় সঠিক আদলে করা হয়েছে কি না, সেটি তদারকি করা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। এটি সরকারিভাবে সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করে দেওয়াটাই বেশি ভালো হয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি৷
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে প্রাণ দেওয়া মানুষদের স্মরণে প্রথম শহিদ মিনার নির্মাণ করেছিলেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা। ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে এর নির্মাণকাজ শুরু হয়। শেষ হয় ২৪ তারিখ ভোরে। কাগজের ওপর ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’ লিখে এতে গেঁথে দেওয়া হয়। শহিদ শফিউরের বাবা আনুষ্ঠানিকভাবে শহিদ মিনারের উদ্বোধন করেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশ ও পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকা মেডিক্যালের ছাত্রদের আবাসিক হোস্টেল ঘিরে ফেলে এবং প্রথম শহিদ মিনার ভেঙে ফেলে। ১৯৫৭ সালে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার পর সরকারিভাবে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের কাজ শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাহামুদ হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির তত্ত্বাবধানে ১৯৬৩ সালে শহিদ মিনারের নির্মাণকাজ শেষ হয়।