শিক্ষার মান উন্নয়নে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বই কেনা হচ্ছে। প্রকাশকদের একটি অংশের অভিযোগ, প্রায় ২০০ কোটি টাকার হরিলুট করা হচ্ছে এ প্রকল্পে। তবে, প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ খাতে চলতি অর্থবছরে সর্বোচ্চ ২৫ কোটি টাকা ব্যয় হবে। এর চেয়েও কম হতে পারে, বেশি হবে না। ২০০ কোটি টাকার বই কেনার অভিযোগ ভিত্তিহীন। এ প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রকাশকরাও একই মত দিয়েছেন।
দেশের ১৫ হাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ‘সেকেন্ডারি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (এসইডিপি)’ এর আওতায় ‘স্ট্রেনদেনিং রিডিং হ্যাবিট অ্যান্ড রিডিং স্কিলস অ্যামং সেকেন্ডারি স্টুডেন্টস’ শীর্ষক স্কিম ডকুমেন্ট অনুসারে বই কেনা কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে। এ কর্মসূচির আওতায় বই কিনতে ইতোমধ্যে বেশকিছু নীতিমালাও প্রণয়ন করা হয়েছে।
প্রকাশকদের একটি অংশের অভিযোগ, চলমান অর্থবছরেই প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করা টাকা খরচ করতে হবে বলেই এটি নিয়ে চলছে তোরজোড়। বইয়ের তালিকা তৈরিতে অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। মানহীন বই সরবরাহ করে প্রকল্পের টাকা আত্মসাতের পরিকল্পনা করা হয়েছে, মর্মে শতাধিক প্রকাশক স্বাক্ষরিত একটি চিঠি দুর্নীতি দমন কমিশনে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে উচ্চ আদালতেও রিট করেছেন তারা।
প্রকল্পের আওতায় বই কিনতে ২০২০ সালের ২৪ ডিসেম্বর পুস্তক সংগ্রহের নীতিমালা ঠিক করে দেয় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর। ২০২১ সালের ২৭ মে প্রকাশকদের কাছ থেকে নমুনা আহ্বান করা হয়। প্রকাশকদের দেওয়া নমুনার মধ্যে থেকে ৯৬টি বইয়ের একটি তালিকা চূড়ান্ত করে বই বাছাই কমিটি।
ওই তালিকায় লেখক মো. নাসির আলীর দুটি বই আছে। বাংলা একাডেমির চরিতাভিধানের তথ্য অনুযায়ী, মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অখণ্ড পাকিস্তান রাখার পক্ষে বিবৃতি দিয়েছিলেন এ লেখক। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বই সংগ্রহের নীতিমালা ১৭ নম্বর নির্দেশনায়ও বলা আছে, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতাবিরোধী কোনো লেখকের বই নির্বাচন বা কেনা যাবে না।
এ প্রকল্পের আওতায় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে চূড়ান্ত হওয়া ৯৬টি বইয়ের মধ্যে ষষ্ঠ শ্রেণির জন্য ২০টি, সপ্তম শ্রেণির জন্য ২০টি, অষ্টম শ্রেণির জন্য ২০টি, নবম শ্রেণির জন্য ২০টি এবং দশম শ্রেণির জন্য ১৬টি বই আছে। এসব বইয়ের মধ্যে আগামী প্রকাশনী থেকে চারটি, সময় প্রকাশনী থেকে চারটি, অধুনা প্রকাশনী থেকে একটি, অনিন্দ্য থেকে দুটি, আদিত্য থেকে দুটি, কাকলি থেকে দুটি, প্রচালন থেকে একটি, আলোর ভুবন থেকে একটি, দীব্য প্রকাশনী ও তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান থেকে তিনটি, তাম্রলিপি থেকে দুটি, সিদ্দিকীয়া প্রকাশনী থেকে দুটি, নওরোজ কিতাবিস্তান থেকে দুটি এবং জাগৃতি প্রকাশনী থেকে দুটি বই কেনার কথা রয়েছে।
ভাষাচিত্র প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী খন্দকার সোহেল বলেন, করোনাকালে পুস্তক সমিতির মিটিং, মন্ত্রণালয়ের মিটিং, শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে মিটিংয়ে বারবার বলা হয়েছিল, যত বেশি বই কেনা যাবে, তত ইন্ডাস্ট্রিটা বেঁচে যাবে। যাতে একজন প্রকাশকের একটি বইয়ের ৫ হাজার কপির বেশি ক্রয় করা না হয়। এতে অনেক প্রকাশকের বই কেনা যাবে। কিন্তু, কিছু প্রকাশক মন্ত্রণালয়ের যোগসাজশে তাদের বই বিক্রি করছে। বাকিদের কথা চিন্তা করছেন না।
তিনি বলেন, একটি প্রকাশনী তাদের নিজেদের নামের পাশাপাশি ছদ্মনামেও বই বিক্রি করছে। বাজারে বই আছে এক নামে, তারা এখানে সাপ্লাই দিচ্ছে অন্য নামে। যেটা সম্পূর্ণ বেআইনি। এগুলো প্রকাশ্য দুর্নীতি। এগুলো কেন বই কেনা কমিটি দেখবে না? এটাতে চূড়ান্ত লুটপাট হয়েছে। আমরা মনে করি, এসব বন্ধ হওয়া উচিত।
আগামী প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ওসমান গনি বলেন, এ প্রজেক্টে সর্বোচ্চ ২১ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। যারা ২০০ কোটি টাকার কথা বলছে, তারা মিথ্যাচার করছে। তারা বিএনপি-জামায়াতের এজেন্ট। তারা সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চায়। এজন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এমন সুন্দর একটি প্রজেক্টেও তারা বাধা সৃষ্টি করছে।
তিনি বলেন, এ প্রজেক্টে যেসব বই যুক্ত করা হচ্ছে, সবগুলোই মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য যুগোপযোগী বলে আমি মনে করি। যদি সরকারের এই প্রজেক্টে কোনো মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বই যুক্ত হয়, তাহলে অবশ্যই আমি সেটির বিরোধিতা করব।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্পের উপ-পরিচালক ড. আসিউল আহসান কবির বলেন, এ প্রজেক্টটি চার বছরের। ২০০ কোটি নয়, প্রায় ৩০০ কোটি টাকার বাজেট। কাজ শুধু বই কেনা নয়। যারা শুধু বই কেনার নামে ২০০ কোটি টাকা লুটপাটের কথা বলছেন তারা না জেনেই বলছেন।
তিনি বলেন, এই বাজেটের আওতায় চলতি অর্থবছরে সর্বোচ্চ ২৫ কোটি টাকার বই কেনা হবে। এর থেকে কিছু বেশি বা কম হতে পারে। তবে, আমরা এখনো কোনো অর্থ হাতে পাইনি। যেহেতু এটি নিয়ে কোর্টে রিট করা আছে, সেটার শুনানি দেখতে হবে। আদালত আমাদের যেভাবে নির্দেশনা দেবেন, আমরা সেভাবেই পরবর্তী পদক্ষেপ নেব।