কর্ণফুলী নদীর তীরে ঘনবসতিপূর্ণ কলোনীতে নিজের ঘরের সামনে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসেছিলেন নূরজাহান বেগম (৬০)। চেয়ারটি অর্ধেকের বেশি ডুবে আছে পানির নিচে। নূর জাহানের ক্লান্ত মুখে পড়েছিল দিনের শেষ সূর্য রশ্মি। তার চোখ জোয়ারের পানির দিকে। ঘরের সামনে দিনের শেষ বেলা অবধি জোয়ারের পানি। নূরজাহানসহ কলোনীর সহস্রাধিক পরিবার প্রায় পাঁচ ঘণ্টা জোয়ারের পানিতে অবরুদ্ধ ছিলেন।
কলোনীর ঘরের সামনে জোয়ারের পানির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে নূরজাহান সেইদিনের কথা স্মরণ করছিলেন, যেদিন তার নিজের বাড়ি ৫ মিটার উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে নিয়েছিল। বাংলাদেশের উপকূলের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বড় ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে একটি ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়। তখন বাংলাদেশের উপকূলের দ্বীপ জেলা ভোলার দৌলতখান উপজেলায় মেঘনা নদীর তীরে ছিল নূরজাহানের বাড়ি। তিনি সেখানে জীবনের একটি বড় সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করেছেন। স্বামী মারা যাওয়ার পর তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে তার জীবনের লড়াই আরো কঠিন হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাবে এক জীবনে নূরজাহান বেগম বাড়ি স্থানান্তর করেছেন ২২ বার। সব সম্পত্তি হারানোর পরে দশ বছর আগে নূরজাহান নিজের হারিয়ে যাওয়া বাড়ি থেকে ১০৪ কিলোমিটার দূরের চট্টগ্রাম শহরের এই ভেরা মার্কেট কলোনীতে আশ্রয় নেন। কিন্তু এই শহরেও এই নারীকে নিরাপদ বসবাস নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করতে হচ্ছে।
উচ্চ জোয়ারের দিনগুলো নূরজাহানসহ এই কলোনীর সব মানুষের দৈনন্দিন সিডিউল বদলে দেয়। জোয়ারের পানি ঘরে প্রবেশের আগে তাদের সব কাজ শেষ করতে হয়। জোয়ারের সময় (৪-৫ ঘণ্টা) সবাইকে থাকতে হয় ঘরবন্দি। ভেড়া মার্কেট নামের এই কলোনীটি চট্টগ্রাম শহরের ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডে। কলোনীর গা ঘেঁষে বয়ে গেছে কর্ণফূলী। নদীর এই পয়েন্ট থেকে মাত্র ১৬ কিলোমিটার দূরে সমুদ্র। সমুদ্র থেকে আসা জোয়ারের পানি কর্ণফূলী নদী হয়ে শহরের খালে প্রবেশ করে। ফলে প্লাবিত হয় শহরের বিভিন্ন এলাকা। বর্ষা এলেই সংকট বাড়ে এই মানুষগুলোর। যেমনটা বেড়েছে এ বছর।
ময়লা-আবর্জনায় আটকে গেছে চট্টগ্রাম শহরের খালগুলো। তক্তারপুল এলাকার ছবি
শুধু ভেড়া মার্কেট কলোনী নয়, চট্টগ্রাম নগরের অর্ধেকেরও বেশি এলাকা জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হচ্ছে। বাংলাদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠান গণপূর্ত অধিদপ্তরের জরিপ বলছে, চট্টগ্রাম নগরীর প্রায় ৬৯ শতাংশ এলাকা এখন কম-বেশি জোয়ারের পানিতে ডুবছে। অপর আরেকটি গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, জোয়ারের পানির কারণে নগরীর প্রায় ১৮ শতাংশ এলাকার অবস্থা বেশি খারাপ। প্লাবিত এলাকা প্রতি বছর বাড়ছে বলে জানিয়েছেন শহরের জোয়ারে ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দারা।
চট্টগ্রাম শহরের সর্বশেষ এই উচ্চ জোয়ারের এই ছবির সাথে খুব মিলেছে জিওফিজিক্যাল রিসার্চ লেটার্সে প্রকাশিত সমীক্ষার ফল। ওই সমীক্ষা বলছে, বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর চট্টগ্রামে ২০১৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে প্রতি বছর ২.৩৯ সেন্টিমিটার জমি হ্রাস পেয়েছে; যা সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় বৃদ্ধির চেয়ে প্রায় সাত গুণ বেশি দ্রুত বন্যার আশঙ্কা বাড়িয়েছে। বাংলাদেশের চট্টগ্রামসহ এশীয় উপকূলীয় আরো কয়েকটি শহর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির হারের তুলনায় দ্রুত ডুবে যাচ্ছে বলে ওই সমীক্ষা বলছে। দ্রুত ডুবে যাচ্ছে, পৃথিবীর এমন দশটি শহর হচ্ছে- তিয়ানজিন (চায়না), সেমারাং (ইন্দোনেশিয়া), জাকার্তা (ইন্দোনেশিয়া), সাংহাই (চায়না), হো চি মিন সিটি (ভিয়েতনাম), হ্যানয় (ভিয়েতনাম), চট্টগ্রাম (বাংলাদেশ), কোবে (জাপান), কেরালা (ভারত) এবং হিউসটন (ইউএসএ)। অপর একটি সমীক্ষা বলছে, এই তালিকায় মুম্বাই (ভারত) এবং করাচি (পাকিস্তান) শহরও রয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের আন্তঃসরকারি প্যানেল অনুসারে, ১৯৯৩ সাল থেকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি বছর প্রায় তিন মিলিমিটার হারে বাড়ছে।
জলবায়ু অভিবাসীরা নতুন করে ক্লাইমেট ঝুঁকিতে
নূরজাহান বেগমের মতো আরো অনেক জলবায়ু অভিবাসী চট্টগ্রাম শহরে এসে নতুন করে জলবায়ু ঝুঁকির মুখোমুখি। বাংলাদেশের উপকূলের বিভিন্ন এলাকা থেকে গত কয়েক দশকে লাখ লাখ মানুষ জীবন জীবিকার প্রয়োজনে চট্টগ্রাম শহরে এসেছে। এদের অধিকাংশই সাইক্লোন, নদী ভাঙন অথবা জলোচ্ছ্বাসের কারণে বাড়িঘরসহ সব সম্পত্তি হারিয়েছেন। বাণিজ্যিক শহর চট্টগ্রামকে তারা বসবাস এবং উপার্জনের জন্য নিরাপদ স্থান মনে করেছিলেন। কিন্তু এখানেও তাদের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে এই শহরের বহু পরিবার বারবার তাদের বসবাসের স্থান বদল করতে বাধ্য হয়েছে। অনেক পরিবার বেশি বাড়ি ভাড়া দিয়ে মনসুনে শহরের উঁচু এলাকায় বসবাস করছে। মনসুন শেষে তারা আবার শহরের নিচু এলাকায় কম ভাড়ার বাড়িতে চলে আসে।
জোয়ারের পানিতে ডুবে গেছে চট্টগ্রাম শহরের তুলাতলী এলাকা
চট্টগ্রাম শহরে শ্রমিকের কাজ করেন মোহাম্মদ শাহজাহান (৬০)। মাত্র ২০ বছর বয়সে তিনি কাজের সন্ধানে এই শহরে এসেছেন। উপকূলের ভোলা জেলার দক্ষিণ সৈয়দপুর গ্রামে তার বাড়ি ছিল। শাহজাহান শৈশবেই বাবাকে সব সম্পত্তি হারাতে দেখেছেন। মেঘনা নদী ভাঙনের কারণে তাদের বাড়ি সাত বার স্থানান্তর করতে হয়েছে। শাহজাহানের বাবার বাড়ির স্থানটি অনেক আগেই মেঘনা নদীর মাঝখানে চলে গেছে। শাহজাহান এবং তার বাবা উভয়ই চট্টগ্রাম শহরকে জীবিকা নির্বাহের নিরাপদ শহর বলে মনে করেছিলেন। কিন্তু এখন এই শহরে বসবাস করতে পারবেন কিনা, এই নিয়ে চিন্তিত শাহজাহান।
সরেজমিনে দেখা যায়, চট্টগ্রাম শহরের ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের তুলাতলী এলাকার রাস্তা এবং বাড়িঘরে জোয়ারের পানি উঠেছিল। মানুষগুলো ঘরের মধ্যে অথবা উঁচু সড়কে আটকে আছেন। জরুরি প্রয়োজনে অনেকে পানির ভেতর দিয়ে চলাচল করছেন। জোয়ারের পানি বৃদ্ধির কারণে এসব এলাকার সড়ক তিন ফুট উঁচু করা হয়েছিল। কিন্তু এখনো উচ্চ জোয়ারে সড়কের উপরে দুই ফুট পানি থাকে।
জোয়ারের পানির কারণে তুলাতলী এলাকার আজিজ কলোনীর বাসিন্দা রোকসানা বেগম (৫৫) গত দুই বছরে তিন বার বাড়ি বদল করেছেন। দশজন সদস্যের সংসার নিয়ে বারবার বাড়ি বদল করা খুবই কঠিন। রোকসানা বলেন, ‘নিজেদের গ্রাম এলাকায় অনেক সমস্যা। তাই বসবাস এবং উপার্জনের জন্য এই শহরে এসেছিলাম। কিন্তু জোয়ারের পানির কারণে শহরে নতুন সমস্যায় পড়েছি।’
কর্ণফুলী নদীর তীরে ভেড়া মার্কেট চেয়ারম্যান কলোনীর বাসিন্দাদের বর্ষাকালে ভোগান্তির শেষ নেই
দুশ্চিন্তায় বাণিজ্যিক এলাকার ব্যবসায়ীরা
চট্টগ্রাম শহরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসাবে পরিচিত আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় জোয়ারের পানি প্রবেশ করছে। বাণিজ্যিক এলাকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভবন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ভবনের চারপাশ এখন জোয়ারের পানিতে ডুবে যায়।
আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকার খুব নিকটে চট্টগ্রাম সামুদ্রিক বন্দর। বন্দর ঘিরে আগ্রাবাদ এলাকায় বাণিজ্যিক এলাকা প্রসারিত হয়। চট্টগ্রামের বাণিজ্য-নির্ভর বড় ভবনগুলো এই এলাকায় অবস্থিত। আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকার নিকটে গড়ে উঠেছে শহরের সবচেয়ে অভিজাত আবাসিক এলাকা, চট্টগ্রাম ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (সিডিএ) আবাসিক এলাকা। দীর্ঘ কয়েক দশকে এই এলাকায় গড়ে উঠেছে হাসপাতাল, স্কুলসহ অনেক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু জোয়ারের পানি ঢোকার কারণে এই এলাকা এখন চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের পছন্দের তালিকায় সবচেয়ে নিচে।
সিডিএ আবাসিক এলাকার বাসিন্দা আবুল কালাম (৭০) তার বাড়ি নিয়ে এখন দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। তার বাড়ির নিচতলা জোয়ারের পানিতে ডুবে যায়। বাড়ি উঁচু করার জন্য নতুন বিনিয়োগ করেছেন। জোয়ারের পানিতে তার বাড়ির ক্ষতি হচ্ছে অনেক। শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় বসবাস করেও জোয়ারের পানির কারণে গত কয়েক বছরে প্রায় ২০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে, জানালেন আবুল কালাম।
একই এলাকার বাসিন্দা কাজী রেফাত আহমেদ (৫০)। তার বাড়ি প্রত্যেক জোয়ারের পানিতে ডুবে যায়। তিনি বলেন, ‘অনেক আশা করে এই এলাকায় বাড়ি করেছিলাম। জোয়ারের পানিতে ডুবতে হবে, আগে বুঝিনি। এখন দেখছি এলাকাটি দিন দিন বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে।’
উচ্চ জোয়ারের সময় প্রতিদিন ৫-৬ ঘণ্টা জোয়ারের পানিতে ডুবে থাকে সিডিএ আবাসিক এলাকা। জোয়ারের পানিতে ডুবে থাকার সময় ওই এলাকায় সরেজমিনে দেখা গেছে, এলাকার অধিকাংশ বাড়ির নিচতলায় পানি। অনেক বাড়ির নিচতলা পরিত্যক্ত। বহু পরিবার নিজেদের বাড়ি ছেড়ে অন্য এলাকায় চলে গেছেন। অনেকে পুরানো বাড়ি ভেঙে মেঝে উঁচু করে নতুন বাড়ি তৈরি করেছেন। বাড়ির মালিকেরা তাদের বাড়ি ভাড়া নেওয়ার জন্য পরিবার খুঁজে পাচ্ছেন না। জোয়ারের পানির কারণে এলাকার জীবনযাপনের ব্যয় বেড়েছে। জোয়ারের পানির কারণে স্কুলে শিক্ষা কার্যক্রম এবং হাসপাতালে চিকিৎসা কার্যক্রম ব্যাহত হয়। সিডিএ আবাসিক এলাকার নিকটে অবস্থিত মা ও শিশু হাসপাতালটি জোয়ারের পানিতে ডুবে থাকে।
সিডিএ (চট্টগ্রাম ডেভেলপমেন্ট অথরিটি) আবাসিক এলাকায় জোয়ারের সময়ের চিত্র
চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকার পুরানো বাসিন্দা খায়রুল আলম সুজন শহরে বসবাস এবং ব্যবসা নিয়ে চিন্তিত। তিনি বলেন, ‘আমার জন্ম এই শহরে। ছোটবেলায় আমরা শহরে পানি দেখিনি। ১৯৯২-৯৩ সালের পর থেকে শহরে পানি প্রবেশ করতে শুরু করে। চট্টগ্রাম ডেভেলপমেন্ট অথরিটি বা সিডিএ এলাকাটি এক সময় শহরের অভিজাত এলাকা বলে খ্যাত ছিল। বহু মানুষ এই এলাকায় এসে বাড়ি করেছেন। এখন এলাকার বাসিন্দারা অন্যত্র সরে যাচ্ছেন। জোয়ারের সময় গোটা এলাকা ডুবে থাকে। বহু বাড়ির নিচতলা পরিত্যক্ত হয়ে গেছে।
খাতুনগঞ্জ চট্টগ্রামের বড় বাণিজ্যিক এলাকা। বিভিন্ন ধরনের পণ্য এখানে পাইকারি বেচাকেনা হয়। কিন্তু জোয়ারের পানি এই অঞ্চলের ব্যবসা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
খাতুনগঞ্জ এলাকার ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেন বলেন, জোয়ারের পানি উঠছে চট্টগ্রামের চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, শুটকিপট্টি ও আসাদগঞ্জে। রাস্তা, গোডাউন ও দোকানে পানি উঠছে। ক্রেতারা দোকানে আসতে পারছেন না। দোকানের বেচাকেনা কমে গেছে। পানি ওঠায় ব্যবসায়ীদের ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে।
চট্টগ্রাম শহরের পানিবন্দি এলাকাগুলোতে বহু জলবায়ু অভিবাসী বসবাস করেন। এরা বিভিন্ন সময়ে দেশের উপকূলীয় এলাকাগুলো থেকে প্রাকৃতিক বিপদের মুখে পড়ে চট্টগ্রাম শহরে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। জলবায়ু অভিবাসী এই পরিবারগুলো চট্টগ্রাম শহরকে বেছে নিয়েছিল বসবাস এবং জীবিকার অন্যতম ক্ষেত্র হিসাবে। সব হারানো এই মানুষেরা কখনো ভাবেননি এই শহরেও তাদেরকে নতুন করে প্রাকৃতিক বিপদের মুখে পড়তে হবে। কিন্তু বর্ষাকালের এই ভোগান্তি তাদের মধ্যে পুনরায় বাস্তুচ্যুতির শঙ্কা জাগাচ্ছে।
উন্নয়ন প্রকল্পগুলো নগরের আশা
প্রায় ৬ মিলিয়ন মানুষের ঠিকানা চট্টগ্রাম নগরী জোয়ারের পানির উচ্চতা বাড়ার কারণে উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। এই মানুষগুলো বছরের পর বছর জোয়ারের পানির ভোগান্তিতে আছে। প্রতি বছর সংকট বাড়ছে। কিন্তু শহর রক্ষায় উন্নয়ন প্রকল্পগুলো তাদের আশা দেখায়।
চট্টগ্রাম সিডিএ আবাসিক এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দা কাজী রেফাত আহমেদ বলেন, ‘অবস্থার উন্নয়নের জন্য শহরের খালগুলোর মুখে স্লুইজ নির্মাণ করা হচ্ছে। আশাকরি এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে আমাদের সংকট লাঘব হবে। স্লুইজ নির্মাণের পরে এক বছর অপেক্ষা করব। তারপরও পানি উঠলে এলাকা ছেড়ে চলে যাব।’
চট্টগ্রাম শহরের তক্তারপুর এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা আবু তাহের (৭৫) বলেন, ‘এই শহরে বহু বছর ধরে জোয়ারের ভোগান্তিতে আছি। অনেক প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়, রাস্তা উঁচু করা হয়। কিন্তু সমস্যার সমাধান হয় না। খালের মুখে স্লুইজ নির্মাণ হচ্ছে। এর ফলে হয়তো সমস্যার সমাধান হবে।’
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বাসিন্দাদের অনেকে বলেন, ‘বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে জোয়ারের পানির উচ্চতা বাড়ছে। উপকূলবর্তী শহর চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ জোয়ারের পানি। এটাকেও ব্যবস্থাপনায় আনতে হবে। চট্টগ্রামে একসময় ৭৬টি খাল ছিল। এখন আছে ৫৭টি। অনেক খাল ভূমিদস্যুরা দখল করে নিয়েছে। সেগুলো উদ্ধার করা দরকার।’
সিডিএ আবাসিক এলাকায় জোয়ারের সময়ের চিত্র
জিওফিজিক্যাল রিসার্চ লেটার্সে প্রকাশিত সমীক্ষা প্রতিবেদনে গবেষকেরা বলেছেন, ‘২০১৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বিশ্বের ৯৯টি উপকূলীয় শহরে অবনতির হার পরিমাপ করেছি। বেশিরভাগ শহরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির চেয়ে ভূমির অংশ দ্রুত নিমজ্জিত হচ্ছে। যদি বর্তমান হারে হ্রাস অব্যাহত থাকে, তাহলে এই শহরগুলি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির মডেল দ্বারা অনুমান করার চেয়ে অনেক তাড়াতাড়ি বন্যার দ্বারা চ্যালেঞ্জ হবে। মানুষের কার্যকলাপ, প্রাথমিকভাবে ভূগর্ভস্থ জল নিষ্কাশন, সম্ভবত এই হ্রাসের প্রধান কারণ। অবনমনের হার কমাতে এবং তাদের পরিণতি কমিয়ে আনতে বর্ধিত পর্যবেক্ষণ এবং নীতিগত হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।’
সূত্রগুলো বলেছে, চট্টগ্রাম মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে কয়েকটি প্রকল্পের কাজ চলছে। এরমধ্যে ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন প্রকল্প’, ‘কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক কাম বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প উল্লেখযোগ্য। এইসব প্রকল্পের কাজ শেষ হলে চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসন হবে বলে সংশ্লিষ্টদের আশাবাদ।
নগরের এই উন্নয়ন প্রকল্পে আশা দেখেন প্রান্তিকের বাসিন্দা নূরজাহান বেগম। মেঘনা নদীর ভাঙনে যে নারীর বাড়ি ২২ বার স্থানান্তর করতে হয়েছিল। যে নারীর জীবন প্রচণ্ড আঘাতে এলোমেলো করেছিল ঘূর্ণিঝড়। সেই নারী এই শহরে জীবিকা নির্বাহ করতে চান নিরাপদে। তিনি উচ্চ জোয়ারের কারণে ঘরবন্দি থাকতে চান না।
ছবি: প্রতিবেদক