ঢাকা জেলা যুব মহিলা লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মেহনাজ তাবাসসুম মিশু। ১৫ বছরের এক কিশোরীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগ উঠেছে মিশু ও তার কথিত স্বামী আতিকুর রহমান আতিকের বিরুদ্ধে। এ অভিযোগে ১৯ আগস্ট তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া ওই কিশোরীর মা। মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, মিশু ও আতিক সাভারের বাসায় স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে বাস করেন। মিশুর বাসায় অনেকের যাতায়াত আছে। তিনি অন্যদের সহযোগিতায় সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোকজনকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে বাসায় ডেকে আনেন। পরে তাদের নগ্ন ছবি তুলে ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ হাতিয়ে নিতেন মিশু ও তার সহযোগীরা।
মামলা দায়েরের পর ১৯ আগস্ট দুপুরে সাভার উপজেলা পরিষদ সংলগ্ন নিজ বাড়ি থেকে মিশুকে গ্রেপ্তার করা হয়। বিকেলে তাকে আদালতে হাজির করে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করা হয়। আদালত মিশুকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। তাকে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ২০ আগস্ট মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সাভার মডেল থানার উপ-পরিদর্শক (নিরস্ত্র) জহুরুল ইসলাম মিশুর সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন। ঢাকার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রাবেয়া বেগম বুধবার (২৩ আগস্ট) আসামির উপস্থিতিতে রিমান্ড শুনানির তারিখ ধার্য করেন। রিমান্ড শুনানিতে তাকে আদালতে হাজির করতে প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট জারি করা হয়েছে। আজ মিশুর রিমান্ড শুনানির দিন ধার্য রয়েছে।
উল্লেখ্য, মিশুকে আটকের পর শৃঙ্খলা পরিপন্থী কাজে যুক্ত থাকার অভিযোগে যুব মহিলা লীগ থেকে তাকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে।
তদন্ত কর্মকর্তা জহুরুল ইসলাম বলেছেন, মামলা দায়ের হওয়ার পর আমরা মিশুকে গ্রেপ্তার করেছি। বর্তমানে তিনি কারাগারে আছেন। তার রিমান্ড চেয়ে আবেদন করা হয়েছে। বুধবার রিমান্ড শুনানি হবে। রিমান্ড মঞ্জুর হলে আমরা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করব। এসব অপকর্মে কারা কারা জড়িত, তা তদন্তে বেরিয়ে আসবে। মামলার এজাহারনামীয় অপর আসামি আতিকুর রহমান আতিককে গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত আছে। আমরা তাকে গ্রেপ্তার করতে তার বাসা পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়া যাই। কিন্তু, তাকে পাওয়া যায়নি। অভিযান অব্যাহত আছে।
এদিকে, ভুক্তভোগী কিশোরী এখনও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তার মা বলেছেন, মেয়ের অবস্থা ভালো না। রাতে ঘুমোতে পারে না। ঘুমের ঘোরে চিল্লায়। কান্না করে। বলে, আম্মু আমি আর বাঁচব না। আমার মেয়ের সাথে যারা এমন করেছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা চাই।
তিনি বলেন, মেয়েটা ১৪ দিন হাসপাতালে ছিল। ৪ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। প্রতিদিন ৪০০-৫০০ টাকার ওষুধ লাগে। ও দাঁড়াতে পারে না। পায়ে ভর দিতে পারে না। লাশের মতো করে মেয়েটাকে অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে এসেছি। ১৫ বছরের মেয়েকে এভাবে বিছানায় পড়ে থাকতে দেখে কোনো মা কি ঠিক থাকতে পারে? মেয়েটার আশা ছিল— আর্মি, পুলিশে বড় অফিসার পদে চাকরি করবে। এখন ও বাঁচে কি না, আল্লাহ জানেন। আমি আমার মেয়ের নির্যাতনকারীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা চাই। সবার সহযোগিতা চাই।
সাত মাস আগে থেকে ওই কিশোরীর সঙ্গে মিশু এমন আচরণ করে আসছিলেন বলে জানা গেছে। নির্যাতনের বিষয়ে আগে জানতেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে ওই শিক্ষার্থীর মা বলেন, আমরা জানতাম না। জানলে কি আর এমন অবস্থা হতো। এই ঘটনা ঘটার পর মেয়ে আমাদের বলেছে। মিশু আমার মেয়েটাকে বোবা বানিয়ে রেখেছিল। আমাদের সাথে ফোনে কথা বলতে দিতো না। মিশু ওর মা-বাবাকেও মানত না। প্রতিবাদ করলে বাবা-মাকেও মারধর করত। ও আসলে কাউকেই মানত না। ওর বিরুদ্ধে অনেক খারাপ রেকর্ড আছে। আমার মেয়ে বলেছে, ও একের পর এক বিয়ে করে। আতিক ওর চার নম্বর হাজবেন্ড। তাহলে বোঝেন, ও কত বড় খারাপ।
শিশুটির বাবা বলেন, মেয়েটাকে পাঁচ তলা থেকে ফেলে দিয়েছে। আল্লাহ সহায় হওয়ায় জীবনটা ফিরে পেয়েছে। ওর অবস্থা খুব খারাপ। ওর যে কী হবে, আল্লাহ জানেন। আদৌ সুস্থ হবে কি না, সেটা নিয়ে সন্দিহান আমরা। মেয়েটার সঙ্গে কি জঘন্য কাজ করেছে। একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের সাথে এ ধরনের জঘন্য কাজ করতে পারে? আমি আমার মেয়ের হত্যার চেষ্টাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা চাই। যেন আর কোনো মেয়ের সঙ্গে এমন ঘটনা না ঘটে।
ওই কিশোরীকে বিবস্ত্র করে ছবি তুলে অনৈতিক কাজে বাধ্য করাসহ নির্যাতনের মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, ১৭ বছর আগে বাদীর প্রথম বিয়ে হয়। তারা সাভার এলাকায় চাকরি করাকালে তাদের ঘরে ওই কিশোরীর জন্ম হয়। ২০১৩ সালে প্রথম স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে। ওই কিশোরী তার বাবার বোনের সঙ্গে মিশুদের বাসায় ভাড়া থাকত। পরে তার বাবা প্রবাসে গেলে সে ফুফুর বাসায় থাকে। তিন বছর আগে ফুফু গ্রামের বাড়ি চলে গেলে ফুফাতো বোনের সাথে থাকে ওই কিশোরী। ৭-৮ মাস আগে চাকরির প্রয়োজনে তার ফুফাতো বোনও অন্যত্র চলে যায়। স্কুল কাছাকাছি হওয়ায় ও পূর্বপরিচয়ের সুবাদে মিশুর বাবা ওই কিশোরীকে তার বাসায় নিয়ে যায়।
এদিকে, মিশু ও আতিক ওই বাসায় স্বামী-স্ত্রীর পরিচয়ে বসবাস করে। মিশুর আরও কথিত ২-৩ জন স্বামী ও বহিরাগত লোক ওই বাসায় যাতায়াত করে। মিশু অন্যান্য আসামিদের সহযোগিতায় সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোকজনকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে বাসায় ডেকে এনে তাদের নগ্ন ছবি তুলে অর্থ হাতিয়ে নিতো। আসামিরা অসৎ উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সময়ে ওই কিশোরীকে প্রাণনাশের ভয় দেখিয়ে তার নগ্ন ছবি তুলতে চায়। মেয়েটি রাজি না হলে মিশু অন্য আসামিদের সহযোগিতায় বাসায় উচ্চ স্বরে মিউজিক বাজিয়ে ওই কিশোরীকে মারপিট করে। এমনকি মিশু সিগারেটের আগুন দিয়ে তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় পুড়িয়ে দেয়। এসব ঘটনা কারো সাথে শেয়ার করলে অথবা বাসা থেকে পালিয়ে গেলে তাকেসহ পরিবারের বিরুদ্ধে মামলা ও খুন হুমকি দেওয়া হয়। এ কারণে মেয়েটি এসব ঘটনা কাউকে বলার সাহস পায়নি। মেয়েটির সঙ্গে এমন আচরণের বিষয়ে মিশুর বৃদ্ধ বাবা-মা প্রতিবাদ করলে আসামিরা তাদেরও মারপিট করতে উদ্যত হয়।
গত ২৪ জুলাই রাত ১০টায় মিশু-আতিকসহ অজ্ঞাত ৫-৭ জন ওই কিশোরীর নগ্ন ভিডিও ধারণ করার চেষ্টা করে। একপর্যায়ে আতিক মেয়েটিকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। মেয়েটি চিৎকার করলে আসামিরা রাতভর দফায় দফায় তাকে মারপিট করে। একপর্যায়ে তারা ভোর সাড়ে ৫টার দিকে বাসার পঞ্চম তলার বেলকনি থেকে ওই কিশোরীকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। মেয়েটি নিচের টিনসেড বাসার টিনের চালায় পড়ে গুরুতর আহত হয়।