দেশের অন্যান্য বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো কেজি (কিন্ডারগার্টেন) স্কুল পরিচালনায় নতুন বিধিমালা প্রয়োগ করতে যাচ্ছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
এর মাধ্যমে মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরের অনুমতি ছাড়া কেজি স্কুলসহ কোনো ধরনের বেসরকারি বিদ্যালয় পরিচালনা করা যাবে না। শিশুদের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া যাবে না বইয়ের বোঝা। চাইলেই মনগড়া ফি নির্ধারণ করতে পারবে না প্রতিষ্ঠানের পরিচালকরা। শিক্ষকদেরও থাকতে হবে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সমমানের শিক্ষাগত যোগ্যতা।
সারাদেশে চলমান প্রায় ৫৮ হাজার প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেকটিকে নিবন্ধন নিতে হবে। ভবিষ্যতে কোনো প্রতিষ্ঠান পূর্ব অনুমোদন ছাড়া পরিচালনা করা যাবে না। এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় থাকতে হবে ব্যবস্থাপনা কমিটি। এসব বিধিমালা না মানলে আইনগত ব্যবস্থারও বিধান রাখা হচ্ছে বিধিমালায়।
জানা গেছে, প্রস্তাবিত বিধিমালার আওতায় পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদানকারী নার্সারি, কেজি ও প্রিপারেটরি স্কুল এবং অন্যান্য বেসরকারি বিদ্যালয় পরিচালনা করতে হবে। উপজেলা/থানা শিক্ষা কর্মকর্তার (টিইও) মাধ্যমে নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে আবেদন করতে হবে। তিনি যাচাই শেষে আবেদন পাঠাবেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার (ডিপিইও) কাছে। তিনিই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন। তবে আবেদনের ৬০ দিনের মধ্যে সব প্রক্রিয়া শেষ করে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিতে হবে। প্রাথমিক অনুমতির মেয়াদ হবে সনদ দেওয়ার পর থেকে এক বছর। এই মেয়াদ শেষ হলে নবায়নের আবেদন ৩০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে। আর পূর্ব তদন্ত ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান নবায়ন করা যাবে না।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, প্রত্যেক স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটিতে প্রধান শিক্ষক, একজন শিক্ষক প্রতিনিধি, একজন অভিভাবক প্রতিনিধি, উদ্যোক্তা বা প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে দুজন থাকবেন। প্রতিষ্ঠাতা পাওয়া না গেলে ইউএনও বা ডিসির দুজন প্রতিনিধি থাকবেন। এছাড়া থাকবেন নিকটতম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন প্রধান শিক্ষক। ব্যবস্থাপনা কমিটির মেয়াদ হবে ৩ বছর। তারাই প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করবেন।
প্রত্যেক বিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাত হবে ৩০:১। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান করা যাবে। তবে কমপক্ষে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান থাকতেই হবে। একাধিক ক্যাম্পাস খোলা যাবে না। ইচ্ছেমতো টিউশন ফি নির্ধারণ করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে উপজেলা/থানা/মহানগর শিক্ষা কমিটির সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। পুনঃভর্তি বা নবায়নের নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অনুদান আদায় করা যাবে না। পঞ্চম শ্রেণির বিদ্যালয়ে কমপক্ষে ৬ জন শিক্ষক থাকতে হবে। শিক্ষকের বেতন-ভাতা বহন করবে বিদ্যালয়, সরকার নয়।
মন্ত্রণালয় বলছে, প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক অনুমোদনের পর নিতে হবে নিবন্ধন। শহরাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত স্কুল নিবন্ধন ফি ১৫ হাজার টাকা। জেলায় ১০ হাজার এবং উপজেলায় ৮ হাজার টাকা। নিবন্ধন দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ভর্তি, উপস্থিতি এবং শিক্ষা সমাপনের হার বিবেচনায় নেওয়া হবে। অনুমোদন বা অনুমতি কর্তৃপক্ষ ডিপিইও হলেও নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ হবেন বিভাগীয় উপপরিচালক (ডিডি)। নিবন্ধনের মেয়াদ হবে ৫ বছর। নিবন্ধন সনদে নানা শর্ত উল্লেখ থাকবে। পাঠদান অনুমতি পাওয়ার এক বছরের মধ্যে নিবন্ধন না নিলে অনুমতি বাতিল হয়ে যাবে। নিবন্ধন সনদ প্রতিষ্ঠানকে সংরক্ষন করতে হবে।
ফাইল ছবি/সংগৃহীত
মেয়াদ শেষে নবায়ন করতে হবে। মেয়াদ শেষ হওয়ার ৬০দিন আগেই আবেদন দাখিল করতে হবে। নবায়নের মেয়াদ ৫ বছর। আর এজন্য নতুন নিবন্ধনের জন্য নির্ধারিত ফির ৫০ শতাংশ দিতে হবে। কোনো কারণে নিবন্ধন বাতিল হলে ফের আবেদন করা যাবে। এ বিধিমালার আগে কোনো প্রতিষ্ঠান নিবন্ধনের আবেদন করে থাকলে তা এই বিধির আলোকেই নিষ্পন্ন হবে। ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়ও এই বিধিমালার অধীনে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসাবে গণ্য হবে। আগে নিবন্ধিতগুলো এই বিধিমালার আলোকে নবায়ন করতে হবে। আর আগে নিবন্ধিত কিন্তু পাঠদান শুরু করেনি, সেসব বিদ্যালয়কেও এই বিধিমালার অধীনে কাজ করতে হবে।
বিধিমালায় অবকাঠামোগত দিকটিও তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বিদ্যালয় ভাড়া কিংবা স্থায়ী বাড়িতে হোক, মেট্রোপলিটন এলাকায় দশমিক ৮ একর, পৌরসভায় দশমিক ১২ এবং অন্য এলাকায় দশমিক ৩০ একর ভূমিতে হতে হবে। ভবন ও ভূমি ভাড়া নেওয়া যাবে। তবে এ বিধিমালার আগে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ের ভূমির পরিমাণ কম হলে সে ক্ষেত্রে কার্যকর হবে না। বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ, প্রধান শিক্ষকের কক্ষ এবং শিক্ষকদের কক্ষ থাকতে হবে।
বিদ্যালয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) পাঠ্যবই অবশ্যই পড়াতে হবে। সহশিক্ষা কার্যক্রম থাকতে হবে। ১৯৮৯ সালের জাতিসংঘ শিশু সনদের আলোকে শিশুর অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানে গ্রন্থাগার, বিশুদ্ধ পানি ও টয়লেট থাকতে হবে। শিক্ষা সফর, চিকিৎসা, খেলার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
সার্বিক বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন প্রাথমিক শিক্ষকরা। ফেনী জেলা সদরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বলেন, অবশ্যই এটি সরকারের ভালো উদ্যোগ। এর মাধ্যমে সব প্রতিষ্ঠান সরকারের নজরে আসবে।
কক্সবাজারের আরেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক জাহানারা শারমিন বলেন, বর্তমানে অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারের বাইরে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়। নিবন্ধনের মাধ্যমে সরকারের নজরদারিতে আসলে প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষায়ও গুণগত মান বাড়বে।
জানতে চাইলে প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক ১০ম গ্রেড বাস্তবায়ন সমন্বয় পরিষদের সমন্বয়ক মু. মাহবুবুর রহমান বলেন, স্বচ্ছ্বতা ও জবাবদিহিতার জন্য কিন্ডার গার্ডেন স্কুলগুলো আইনের আওতায় আসবে। কোমলমতি শিক্ষার্থীরা অতিরিক্ত বইয়ের বোঝা থেকে মুক্তি মিলবে। অনেকেক্ষেত্রে অভিভাবকদের অসম প্রতিযোগিতা থেকেও শিক্ষার্থীদের মুক্তি মিলবে। সরকারের এ উদ্যোগকে শিক্ষক হিসেবে স্বাগত জানাই।
এ বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান তুহিন বলেন, সবগুলো প্রতিষ্ঠানকে একটি নির্দিষ্ট নিয়মের আওতায় আনতে সরকারের এ উদ্যোগ। বর্তমানে এ সংক্রান্ত বিধিমালার কার্যক্রম চলমান। সারাদেশে প্রায় ৫৮ হাজার কেজি স্কুল নিবন্ধনের আওতায় আসবে। প্রাথমিকে শিক্ষার মান সুনিশ্চিত করতেই মূলত এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ জানান, কিন্ডারগার্টেনসহ (কেজি) বেসরকারি বিভিন্ন স্কুল তত্ত্বাবধানের জন্য থাকা ২০১১ সালের বিধিমালাটি যুগোপযোগিতা হারিয়েছে। ফলে অধিভুক্তি আর রেজিস্ট্রেশন সহজ করতে এবার বিধিমালা তৈরি করা হচ্ছে। এই বিধিমালা মানা না হলে আইনের আওতায় আনা হবে।