সমঝোতার নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ভরাডুবির জন্য দলটির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে দায়ী করছেন নেতাকর্মীরা। দল পরিচালনায় জিএম কাদের ও চুন্নুর স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম, যোগ্যদের বাদ দিয়ে স্ত্রীকে মনোনয়ন শর্তে সমঝোতা, অযোগ্যদের মনোনয়ন, তৃণমূল নেতাকর্মীদের অবমূল্যায়ন ও নির্বাচনে অসহযোগিতার কারণে ভরাডুবি ঘটেছে বলে মনে করছেন তারা। এ অবস্থার জন্য চেয়ারম্যান ও মহাসচিবকে দায়ী করে দুজনের বিরুদ্ধে সংগঠিত হচ্ছেন দলটির নেতাকর্মীরা। ঢাকায় ফেরা মাত্র দুজনকে মুখোমুখি করবেন তারা। সবকিছুর হিসাবও চাইবেন।
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য সাহিদুর রহমান টেপা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, জাতীয় পার্টি কারো বাবার সম্পদ না। নির্বাচনে দলকে যারা বিক্রি করেছেন তাদের কড়া গন্ডায় হিসাব দিতে হবে।
তিনি বলেন, জিএম কাদের, চুন্নু ও আনিসদের বয়কট করে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের দলকে রক্ষা করতে হবে। জাতীয় পার্টিকে যারা কোরবানি দিয়েছেন তাদের ধরার জন্য বনানী অফিসে যাবেন বলেও জানান তিনি।
দলটির ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনে দলের চরম ভরাডুবির পর জিএম কাদের ও চুন্নুর বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন নেতাকর্মীরা। তারা যেকোনো সময় দলের বনানী ও কাকরাইল অফিস ঘেরাও করতে পারেন। জবাবদিহির মুখে পড়তে পারেন চেয়ারম্যান ও মহাসচিব চুন্নু। এতে ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীদের ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে সার্বিক পরিস্থিতি, এমনটাই ইঙ্গিত দিয়েছেন দলটির নেতারা।
নির্বাচনে অংশ নেওয়া জাতীয় পার্টির একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন ফরম বিক্রির নামে চার কোটি টাকা পকেটে ভরেছেন। আবার দলের নির্বাচনি ফান্ডও তার পকেটে। সেই টাকা নিজের স্ত্রী ও পছন্দের দু-একজনকে ছাড়া কাউকে দেননি। নির্বাচনকালে চরম অর্থ সংকটে পড়লেও প্রার্থীদের কোনো ধরনের সহযোগিতা করা হয়নি। নির্বাচনে ভরাডুবির জন্য দলের চেয়ারম্যান ও মহাসচিব দায়ী। তাই তাদেরকে কোনো প্রকার ছাড় দেওয়া হবে না। দুজনকে জবাবদিহি করতে হবে।
তৃণমূল নেতাকর্মীদের অভিযোগ, জিএম কাদের এর কারণে দলের অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। এতকিছুর পর দলীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে নিজেই বিরোধীদলের নেতা এবং ত্যাগী নেত্রীদের বঞ্চিত করে স্ত্রী শেরিফা কাদেরকে সংরক্ষিত নারী আসনে এমপি করার মিশনে নেমেছিলেন জিএম কাদের।
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য, ঢাকা-৭ আসনের মনোনীত প্রার্থী সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন বলেন, প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের দল জাতীয় পার্টি আজ ব্যক্তি স্বার্থের জন্য তার ছোট ভাই জিএম কাদের এর কারণে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। তিনি স্ত্রীর আসনের জন্য দলের পোড় খাওয়া নেতা কাজী ফিরোজ রশীদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলাসহ নেতাদের কোরবানি দিয়েছেন। তাদের আসন দেওয়া হলে পাস করতেন। অথচ তার স্ত্রী জামানত হারিয়েছেন। ওনার স্ত্রীকে এমপি বানাতে হবে কেন? দলে ওনার কি অবদান? নির্বাচনে একটা বিষয় প্রমাণিত- দল, নেতাকর্মীর চেয়েও তার কাছে ব্যক্তিস্বার্থ বড়। তিনি এই ব্যক্তির স্বার্থের জন্য জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন।
জানা গেছে, বিক্ষুদ্ধ নেতাকর্মীরা দল বাঁচাতে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। জিএম কাদের ও চুন্নুর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। মঙ্গলবার রাতে তারা দলের এক জ্যেষ্ঠ নেতার বাসভবনে জরুরি বৈঠক করেছেন। বৈঠকে দলের দুই প্রভাবশালী কো-চেয়ারম্যান, ৬ জন প্রেসিডিয়ামসহ ২১ জন সিনিয়র নেতা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে উপস্থিত একজন নেতা বলেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জিএম কাদের ও চুন্নুর বিরুদ্ধে আমরা সবাই একাট্টা। দলের ভরাডুবির জন্য তারাই দায়ী। বৈঠকে সবাই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে সব অনিয়ম অপকর্মের প্রতিবাদ, প্রয়োজনে দুজনের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
তিনি বলেন, জাতীয় পার্টিতে নেতৃত্ব সংস্কারের প্রস্তাব করেছেন নেতাকর্মীরা। যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেরা ঐক্যবদ্ধ থাকার অঙ্গীকার করেছেন। বুধবার বেলা ১১টায় বনানী অফিস ঘেরাও এবং বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করবেন বলেও জানান ওই নেতা।
প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর দলীয় চেয়ারম্যান হিসেবে এই প্রথম গোলাম মোহাম্মদ কাদের এর নেতৃত্বে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে জাতীয় পার্টি। যোগ্য নেতাদের বাদ দিয়ে তৃণমূলের মতামত ছাড়া নিজ স্ত্রীর আসন নিশ্চিত শর্তে ২৬ আসনে সমঝোতা করে দেশের মোট ২৮৩ আসনে প্রার্থী দেয় দলটি। কিন্তু সেই নির্বাচনে চরম ভরাডুবি ঘটে। ২৮৩ আসন ঠেকে ১১ আসনে গিয়ে।
অর্থ সংকটে পড়ে দলীয় সহযোগিতা না পেয়ে অনেক প্রার্থী নির্বাচনের আগে সরে যান। অধিকাংশ প্রার্থী নির্বাচনের দিন প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রার্থীর সঙ্গে না পেরে মাঠ ছেড়ে দেন। এসব প্রার্থী দলের পক্ষ থেকে কোনো সহযোগিতা পাননি। দলের চেয়ারম্যান ও মহাসচিব প্রার্থীদের খোঁজখবর পর্যন্ত নেননি বলে অভিযোগ রয়েছে।