দ্বাদশ সংসদের নবনির্বাচিত এমপিরা শপথ গ্রহণ করেছেন। পরে সংসদ ভবনেই আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সদস্যদের বৈঠকে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনাকে সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত করেছেন। স্বতন্ত্র, জাতীয় পার্টি, কল্যাণ পার্টি, ওয়ার্কাস পার্টি ও জাসদের সংসদ সদস্যরাও শপথ নিয়েছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগ দ্বাদশ সংসদে সরকারি দল হিসেবে স্থান করে নিলেও প্রধান বিরোধী দল কে হবে, এটা এখনও নিশ্চিত করে কিছুই জানা যায়নি। দ্বাদশ সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি, নাকি স্বতন্ত্রদের নিয়ে মোর্চা গঠন করে করা হবে— এ নিয়ে ধুম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। কম আসনে জেতা জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান গোলাম মোহম্মদ কাদের আবারও বিরোধী দলে থাকার ইচ্ছা পোষণ করলেও স্বতন্ত্ররা মোর্চা গঠন করে বিরোধী দল গঠন করতে পারেন। ইতোমধ্যে তারা তৎপরতাও শুরু করে দিয়েছেন। আবার স্বতন্ত্র, জাতীয় পার্টি, কল্যাণ পার্টিসহ ছোট ছোট দলগুলোকে নিয়েও বিরোধী দল হতে পারে।
মূলত সবকিছুই নির্ভর করছে সরকারপ্রধান কিংবা স্পিকারের ওপর— এমনটাই জানিয়েছেন দলটির বিজয়ী এমপি, স্বতন্ত্র এমপি ও রাজনীতিক বিশ্লেষকরা।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সংসদে বিরোধী দল কে হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধানমন্ত্রী। যদিও এর কিছুক্ষণ পরেই একটি সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিরোধী দলকে তাদের নিজেদের সংগঠিত করতে হবে। আপনি আমাকে বিরোধী দল পছন্দ করতে বলতে পারেন না। অবশ্য, আপনি চাইলে আমরা সেটা করতে পারি। কিন্তু সেটা আসলে বিরোধী দল হবে না।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এককভাবে ২২২টি আসনে জয় পেয়েছে। জাতীয় পার্টি পেয়েছে ১১টি আসন। আওয়ামী লীগের পর সর্বোচ্চ ৬২টি আসন পেয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। আর তিনটি আসন অন্যান্য দলগুলো পেয়েছে। ২৯৯ আসনের মধ্যে সরকারি দল আওয়ামী লীগের পরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসন পাওয়া স্বতন্ত্ররা জাতীয় পার্টির চেয়ে ছয় গুণ বেশি। মাত্র ১১ আসন পেলেও বাকি অধিকাংশ আসনে লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থীদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে।
সংসদের বিরোধী দল কে হবে— এমন আলোচনার মধ্যে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বতন্ত্ররা জোট করে বিরোধী দলীয় নেতা নির্বাচন করলে তাতে বাংলাদেশের আইনে কোনও বাধা নেই। আর সেরকম হলে গত দুই সংসদে প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসা জাতীয় পার্টি সেই তকমা হারাতে পারে।
শপথ নিয়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহম্মদ কাদের সাংবাদিকদের বলেছেন, আমি ঠিক জানি না নিয়মটা কী। তবে, আমরা বিরোধী দলে ছিলাম এবং বিরোধী দলে থাকতে চাই। আমরা জনকল্যাণমুখী, যেটা জনগণের ভালো হয় সেটিই আমরা করতে চাই।
এ বিষয়ে দলটির প্রভাবশালী কো-চেয়ারম্যান ও সাবেক মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, বিরোধী দল গঠনের বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। তবে এই মুহূর্তে নিশ্চিত করে কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি।
দলের আরেক প্রভাবশালী প্রেসিডিয়াম সদস্য একেএম সেলিম ওসমান জানান, মাত্র শপথ নিয়েছি, এখনই এ বিষয়ে আলোচনা হয়নি। আরেকটু সময় যাক, সবকিছুই পরিষ্কার হয়ে যাবে।
এদিকে, জাতীয় পার্টি এককভাবে খুব বেশি আসন না পাওয়ার কারণে এই সংসদ বিরোধী দল শূন্য হয়ে পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এমন অবস্থায় স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বিরোধী দল গঠন করবে কি না— এমন প্রশ্ন সামনে আসছে। জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে বিরোধী দল হলে সেখানে স্বতন্ত্রদের অনেকেই থাকতে নারাজ।
নির্বাচিত স্বতন্ত্র এমপিরা বলেছেন, সরকার যে সিদ্ধান্ত নেবে, সেটিই মেনে নেবেন তারা। এ বিষয়ে ব্যক্তিগত নয় বরং দলীয় সিদ্ধান্তের প্রতিই নজর রয়েছে তাদের।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় এবং তারা আওয়ামী লীগের নেতা হওয়ায় শেষ পর্যন্ত কী করবেন, বিরোধী দল কারা হবে— সেসব সিদ্ধান্ত আওয়ামী লীগের শীর্ষ মহল থেকেই আসবে।
ফরিদপুর-৩ আসন থেকে বিজয়ী স্বতন্ত্র এমপি ব্যবসায়ী নেতা এ কে আজাদ সাংবাদিকদের বলেছেন, স্বতন্ত্র কয়েক জন প্রার্থীর সাথে তার কথা হয়েছে। তবে, এদের কেউই এখনও কোন ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি।
বিরোধী দল গঠন করার প্রস্তাব আসলে কী করবেন— এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, অবশ্যই তারা এই প্রস্তাব মেনে নেবেন। আমরা সরকারকে সাহায্য করবো, সরকারের ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দেব। যেহেতু আমি নৌকা প্রতীকে হইনি, স্বতন্ত্র হয়েছি, আমি যেটা সরকারের করণীয় এবং সরকার যেটা ভুল করছে; দুটো বিষয়ই তুলে ধরবো। তবে, জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে বিরোধী দল গঠনে আপত্তি রয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
আজাদ বলেন, সবকিছু নির্ভর করবে সরকার কীভাবে চাচ্ছে। সরকার যদি মনে করে যেহেতু মেজরিটি স্বতন্ত্র হয়ে আসছে। এরা সবাই কিন্তু আওয়ামী লীগের লোক। তাই, সিদ্ধান্তও আওয়ামী লীগের মধ্য থেকেই আসবে যে আমাদের অবস্থানটা কী হবে, জাতীয় পার্টির অবস্থানটা কী হবে। এজন্য আমাদের এককভাবে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্কোপ আছে বলে আমি মনে করি না।
গাজীপুর-৫ আসন থেকে নির্বাচিত আরেক স্বতন্ত্র এমপি আখতারুজ্জামান বলেছেন, বিরোধী দলের পারপাসের জন্য যদি দল আমাদের নির্দেশনা দেয়, যে তোমরা একটা অপজিশন গ্রুপ গঠন করো, তাহলে স্বতন্ত্র মিলে আমরা একত্রিত হয়ে টাইম টু টাইম বক্তব্য রাখা, পারফর্ম করা— সেটা হতে পারে।
স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিরোধী দল হওয়ার সুযোগ আছে কি না— এ বিষয়ে রাজনীতি ও আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাদের বিরোধী দল হতে কোনও বাধা নেই। কারণ, সরকারি দলের বাইরে যারা নির্বাচিত হন তারা স্বাভাবিক নিয়মেই বিরোধী দল হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকেন। সেটি কোনও রাজনৈতিক দলের সদস্য বা স্বতন্ত্র প্রার্থী—যেই হোন না কেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষক শারমিন মুরশিদ বলেছেন, বিজয়ী দল চাইলে ঘোষণা করে দিতে পারে এই ৬২ জন আমার বিরোধী দল। আবার তারা উল্টো পথেও হাঁটতে পারে। জাতীয় পার্টি বিরোধী দল হবে বলে যে কথা শোনা যাচ্ছিল, সেটিও হতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেছেন, নির্বাচন কমিশনের কাছে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা আওয়ামী লীগের নন। তারা স্বতন্ত্র। স্ট্র্যাটেজিক কারণে যদি আওয়ামী লীগ চায় যে, একটা তথাকথিত অপজিশন থাকুক, তাহলে তারা স্বতন্ত্রদের বলবে যে তোমরা অপজিশন বেঞ্চেই থাকো। এই বিরোধী দল সরকারের বিরোধিতা করবে, সেটা নয়। বরং তারা সরকারের ‘গঠনমূলক সমালোচনা’ করবে।
তিনি বলেন, এর আগে জাতীয় পার্টি সরকারের পার্টনার হিসেবে বিরোধী দল ছিল। এবারও তাই হবে, সরকারের পার্টনার থাকবে তারা।
আইন বিশেষজ্ঞ তানজিবুল আলম বলেন, সংসদীয় প্রক্রিয়ায় বলা আছে যে, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা মিলে একটি জোট গঠন করতে পারে। একে বলা হয় ককাস। এই ককাসের মাধ্যমে একটি জোট গঠন করে তারা একজন নেতা নির্বাচন করে স্পিকারের কাছে বিরোধী জোট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার কথা জানাতে পারেন। এক্ষেত্রে তারা দ্বিতীয় বৃহত্তম পার্টি হিসেবে তাদের মর্যাদা দিতে পারবেন। তাদের নেতাকে বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে নিতে পারবেন।
এর আগে, ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী ১৬ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী মিলে হাজী সেলিমের নেতৃত্বে একটি জোট তৈরি করতে দেখা গিয়েছিল। সেই জোটকে আনুপাতিক হারে তিন জন সংরক্ষিত নারী সদস্যের কোটাও দেওয়া হয়েছিল। সাড়ে তিন বছর পরে অবশ্য সেই জোটের নেতা হাজী সেলিমসহ বেশিরভাগ স্বতন্ত্র প্রার্থী আবার আওয়ামী লীগে ফিরে যান।
এর আগে, ১৯৮৮ সালে বিতর্কিত চতুর্থ জাতীয় নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ক্ষমতা গ্রহণ করে। ফ্রিডম পার্টি ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের সমর্থন নিয়ে আ স ম আব্দুর রব সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন। যদিও, তাকে গৃহপালিত বিরোধী দল বলা হয়েছিল।