নির্বাচনে ভরাডুবি, দলীয় ও নির্বাচনি ফান্ড কুক্ষিগত করে রাখা, শেরিফা কাদেরের আসনের বিনিময়ে সিনিয়র নেতাদের বাদ দেওয়া, নির্বাচনে অসহযোগিতার অভিযোগ এনে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর বিরুদ্ধে কয়েকদিন ধরে ক্ষোভ-বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছেন নির্বাচনে অংশ নেওয়া দলের প্রার্থীরা। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন দলের সিনিয়র নেতাসহ তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। তারা নির্বাচনি ভরাডুবির জন্য কাদের ও চুন্নুকে দায়ী করে তাদের কাছে জবাবদিহিতা চান।
নির্বাচনি ফান্ড কোথায় গেলো এবং দলীয় ফান্ড কেন দেওয়া হলো না-সেই প্রশ্ন তুলে ন্যায্য পাওনা বুঝে নিতে চান বিক্ষুব্ধরা। শুধু তাই নয়, সিনিয়র দুই নেতার বহিষ্কারের মুখেও দাবি আদায়ে অনঢ় তারা। সংরক্ষিত আসনে আবারও শেরিফাকে মনোনয়ন দেওয়া হলে দলে বড় ধরনের বিদ্রোহ দেখা দিবে বলেও জানিয়েছেন বিক্ষুব্ধরা।
নির্বাচনে অংশ নেওয়া দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রার্থীদের টাকা পয়সা তো দেয়নি, খোঁজখবরও নেননি কেউ।
তিনি বলেন, পার্টির চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ, আবু হোসেন বাবলা ও লিয়াকত হোসেন খোকার মতো সিনিয়র নেতাদের বাদ দিয়ে স্ত্রীকে সমঝোতার আসন দেওয়াটা ঠিক হয়নি। নির্বাচনে তিনি আশানুরুপ ভোট পাননি। এখন সংরক্ষিত কোটায় ওনাকে আবার এমপি করা হলে নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ হবেন এটাই স্বাভাবিক।
জানা গেছে, নির্বাচন করে প্রায় প্রার্থী নিঃস্ব হয়ে গেছেন। নির্বাচনকালে তাদের কোনো আর্থিক সহযোগিতা দেওয়া হয়নি। চেয়ারম্যান ও মহাসচিব প্রার্থীদের ফোনই ধরেননি। অসহায় হয়ে সবকিছু শেষ করে অনেকেই নির্বাচন করেছেন, আবার কেউ সরে দাঁড়িয়েছেন। নির্বাচনের পর এখন তাদের প্রশ্ন, নির্বাচনের জন্য যে বিশাল ফান্ড এসেছে এবং মনোনয়ন ফরম বিক্রি বাবদ যে চার কোটি টাকা জমা হয়েছে সেটা কোথায়। তার হিসাব চান। ন্যায্য পাওনা বুঝে নিতে চান। এজন্য একাট্টা হয়ে তারা দলের চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছেন।
গত বুধবার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত বনানী অফিসে মিছিল-শ্লোগানে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তারা। প্রায় প্রতিদিন দলের কাকরাইল অফিসে বিক্ষুদ্ধরা মিলিত হচ্ছেন। আনাগোনা ও মিটিং করে অফিস দখলে রেখেছেন তারা। শনিবার রাতেও দলের কো-চেয়াম্যান ও ঢাকা মহানগর সভাপতি সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, দলের অতিরিক্ত মহাসচিব ও স্বেচ্ছাসেবক পার্টির সভাপতি লিয়াকত হোসেন খোকা এবং প্রেসিডিয়াম সদস্য ও মহানগর উত্তর আহ্বায়ক শফিকুল ইসলাম সেন্টুর নেতৃত্বে নেতাকর্মীরা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দফায় দফায় মিটিং করেছেন। উপস্থিত ছিলেন প্রেসিডিয়াম সদস্য সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন, লিয়াকত হোসেন চাকলাদার, আব্দুল হামিদ ভাসানি, খোরশেদ আলম খুশু, হাসান ইফতেখার, মিজানুর রহমান মিরু, আব্দুস সোবহান, সুজন দে, সেন্টুসহ বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ডের নেতাকর্মীরা।
জানা গেছে, কাদের ও চুন্নুর ব্যর্থতা এবং স্বেচ্ছাচারিতার কারণে নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ভরাডুবির পর সারাদেশে দলীয় বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন বিক্ষুব্ধ নেতারা। দলীয় বিপর্যয় ঠেকাতে নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থীসহ তৃণমূল কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছেন তারা। রোববার কাকরাইলের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে বিশেষ সভা ডেকেছেন। সেখানে দলের সব প্রার্থীদের আসতে বলা হয়েছে। তাছাড়া একইদিন সকালে জাতীয় পার্টিকে রক্ষায় আল্লাহর সাহায্য কামনা করে কাকরাইল অফিসে লিয়াকত হোসেন খোকার উদ্যোগে কোরআন খতম ও দোয়া মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে।
রোববারের বিশেষ সভা সম্পর্কে দলের কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা বলেন, নির্বাচন নিয়ে দলের প্রার্থীদের অনেক ক্ষোভ রয়েছে। তারা আমাদের ফোন করছেন। আমরা তাদের ঐক্যবদ্ধ রাখতে এই বিশেষ সভার আয়োজন করেছি। তারা তাদের মান অভিমান ও ক্ষোভের কথা বলবেন। আমরা শুনবো। পরে দলীয় ফোরামে তাদের কথা তুলে ধরবো।
তবে এই সভা সম্পর্কে দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু সাংবাদিকদের বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। এটা জাপার কোনো সভা নয়। ব্যক্তিগতভাবে কেউ কেউ ডাকতে পারেন। নিজেরা কথা বলতে পারেন। নির্বাচন নিয়ে অনেকের ক্ষোভ রয়েছে। আশা করি সব ঠিক হয়ে যাবে।
বিশেষ সভার অন্যতম আয়োজক দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও স্বেচ্ছাসেবক পার্টির সভাপতি লিয়াকত হোসেন খোকা বলেন, নির্বাচনি বিপর্যয় হলেও দলের বিপর্যয় যাতে না ঘটে, নেতাকর্মীরা যাতে হতাশায় এলাকা ছাড়া না হয় বরং তাদের ধরে রাখতেই আমরা বিশেষ সভা ডেকেছি। নির্বাচনি বিপর্যয়ের মুখে নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ রাখতে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। যাতে নেতাকর্মীরা ভেঙে না পড়েন, দল সুসংগঠিত ও শক্তিশালী হয়।
এদিকে নেতাকর্মীদের বিক্ষোভ দমন করে জাতীয় পার্টিতে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে দলের কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ ও প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভ রায়কে বহিষ্কার করেন জিএম কাদের। তাছাড়া পরিস্থিতি সামাল দিতে শনিবার জিএম কাদের এর পক্ষে বনানী অফিসে পাল্টা সভা করেন তার স্ত্রী শেরিফা কাদের। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বুধবার বনানী অফিসে বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারী দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য জহিরুল ইসলাম জহির, যুগ্ম মহাসচিব গোলাম মোহাম্মদ রাজু, বেলাল হোসেন, হুমায়ুন খান, মাহমুদ আলম, সমরেশ মন্ডল মানিক, দ্বীন ইসলাম শেখ, আলমগীর হোসেন এবং উত্তরের কিছুসংখ্যক নেতাকর্মী। একদিনের মধ্যে অবস্থান পরিবর্তন করে ইউটার্ন নেওয়ায় কর্মীদের সমালোচনার মুখে পড়েছেন তারা।
জানা গেছে, মহানগর উত্তরের নেতাকর্মীদের ফোন দিয়েও শেরিফা কাদের তার এই সভায় নিতে পারেননি। বরং উত্তরের অধিকাংশ থানা ও মহানগরীর নেতাকর্মীরা সংগঠনটির আহ্বায়ক শফিকুল ইসলাম সেন্টুর নেতৃত্বে ওইদিন সভা করেছেন। তারা বিক্ষুব্ধ তৃণমূল নেতাকর্মীদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে তাদের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেন।
অন্যদিকে, রোববারের বিশেষ সভা ঠেকাতে জিএম কাদের এর পক্ষ থেকে জরুরি বিজ্ঞপ্তি জারি করে প্রার্থিদের আসতে বারণ করা হয়েছে। এমনকি প্রত্যেক প্রার্থীকে চিঠি দিয়ে, ফোন করে এই সভায় আসতে নিষেধ করা হলেও তারা ওই সভায় আসবেন, ক্ষোভ প্রকাশ করবেন বলে একাধিক প্রার্থী জানিয়েছেন।
তারা বলেন, আমাদের ক্ষোভ আছে। নির্বাচনে পাঠিয়ে আমাদের নিঃস্ব করে দেওয়া হয়েছে। সেটা কি আমরা বলতে পারবো না। যিনি (জিএম কাদের) এতদিন বাক স্বাধীনতার জন্য সরকারের সমালোচনা করেছেন, তিনি আমাদের বাক স্বাধীনতা কেড়ে নিবেন? আমরা অবশ্যই মিটিংয়ে আসবো, আমাদের কথা বলবো।
জানা গেছে, দুই নেতাকে বহিষ্কার করলেও নির্বাচনি ফান্ডের হিসাব ও নারী কোটায় শেরিফার মনোনয়ন ঠেকাতে বিক্ষোভ চালিয়ে যেতে অনঢ় দলটির তৃণমূল নেতাকর্মীরা। তারা রোববারের বিশেষ সভায় প্রার্থীদের অভিযোগ শুনে ঐক্যবদ্ধভাবে পরবর্তী কর্মসূচি ঠিক করবেন বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতীয় পার্টির একজন সিনিয়র নেতা জানান, বহিষ্কার করে, চিঠি দিয়ে তৃণমূলের ক্ষোভ-বিক্ষোভ দমাতে পারবে না। কেন নির্বাচনে ভরাডুবি হলো, নির্বাচনি ফান্ড কোথায় গেল? তার হিসাব পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাসচিবকে দিতে হবে। আমাদের টাকা বুঝিয়ে দিতে হবে।
প্রার্থীদের অভিযোগ, শেরিফা কাদের এর জামানত বাজেয়াপ্ত হবে জানার পরও চেয়ারম্যান এবং মহাসচিব তাদের একক ক্ষমতাবলে দলের তিনজন রানিং এমপি যথাক্রমে কাজী ফিরোজ, বাবলা ও খোকার আসন কোরবানি দিয়েছেন। ব্রাক্ষণবাড়িয়া-২ আসনে স্থানীয় প্রার্থী ভাসানিকে বাদ দিয়ে অন্য আসন থেকে রেজাউল এবং নীলফামারীতে সিদ্দিকুল আলমকে না দিয়ে ভাগিনা আহসান আদিলুরকে সমঝোতার আসন দেওয়া হয়েছে। এভাবে যোগ্য অনেক নেতাকে বাদ দিয়েছেন তারা। প্রত্যেক এমপির জন্য নির্বাচনি ফান্ড আসার পরও চেয়ারম্যান পুরো ফান্ড কুক্ষিগত করেন। সেখান থেকে মুখ চেনা, যাদের এমপি হওয়ার চান্স নেই তাদের টাকা দিয়েছেন।
এমনকি তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডাক্তার আকাশকে বড় অংকের টাকা দেওয়া হয়েছে। অথচ তিনি দলীয় সিদ্ধান্ত ছাড়াই অন্য এক প্রার্থীকে সমর্থন জানিয়ে নির্বাচন থেকে সরে পড়েছেন। দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য রেজাউল ইসলাম, জহিরুল ইসলাম রুবেলসহ মুখ চেনা কিছু প্রার্থীকে টাকা দেওয়া হয়েছে। যারা নির্বাচনে সমঝোতার আসন পেয়েও জামানত হারিয়েছেন। আর সমঝোতার আসন না পাওয়ার পরও যাদের নির্বাচনে জেতার সম্ভাবনা ছিল তাদের টাকা দেওয়া হয়নি। ঢাকা-৪ আসনে আবু হোসেন বাবলা, ঢাকা-৭ আসনে সাইফুদ্দিন মিলন, নারায়ণগঞ্জে লিয়াকত হোসেন খোকা, সীতাকুন্ডে দিদারুল কবিরসহ দলের অধিকাংশ প্রার্থীকে কোনো টাকা দেওয়া হয়নি। প্রার্থীরা নিজেদের উপার্জিত টাকা পয়সা খরচ করে নিঃস্ব হয়ে নির্বাচন করেছেন। তাদের আর্থিক সহযোগিতা দূরে থাক, তাদের কোনো খোঁজখবর নেওয়া হয়নি। নির্বাচনের আগেপরে টানা ফোন দিলেও দলের চেয়ারম্যান ও মহাসচিব ফোন ধরেননি।
মাঠ পর্যায়ের নেতাদের অভিযোগ, সমঝোতার নির্বাচনে অংশ নিয়ে এমপি নির্বাচিত হয়ে দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদের ‘সমঝোতা করেননি’ দাবি করে মিথ্যা কথা বলেছেন। একইভাবে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি দাবি করে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে সরকার বিরোধীদের সমর্থন পেতে চেয়েছেন।
শুধু তাই নয়, বিরোধীদলের নেতা হতে শপথ গ্রহণ নিয়ে দ্বিমুখী ভূমিকা এবং সর্বশেষ আবারও স্ত্রী শেরিফাকে সংরক্ষিত আসনে এমপি করতে চান জিএম কাদের। এসব কারণে দলের প্রার্থী ও তৃণমূল নেতাকর্মীরা ক্ষুদ্ধ হয়ে কাদের ও চুন্নুর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছেন।
তৃণমূলের একজন নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রিয় নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টিকে জিএম কাদের নিজের একক সম্পত্তি মনে করে যা ইচ্ছা তাই করছেন। দলে তার কোনো অবদান নাই। পল্লীবন্ধু এরশাদ ও দলের দুঃসময়ে তাকে মিছিল মিটিংয়ে কোনোদিন পাওয়া যায়নি।
তিনি বলেন, নেতাকর্মীর আত্মদান ও আমাদের ঘাম রক্তে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জাতীয় পার্টি। চেয়ারম্যান হয়ে নিজের জেদ দেখাতে গিয়ে তিনি সেই পার্টিকে এখন ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে গেছেন। বাকি যেটুকু আছে সেটা তার স্ত্রী করছেন। মাঠ পর্যায়ের নেত্রীদের বাদ দিয়ে শেরিফা কাদেরকে নারী কোটায় এমপি করা হলে আমরা মেনে নেবো না।