দেশের এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় দুই দিন আগে (২২ এপ্রিল)। উৎপাদন বাড়লেও তীব্র তাপদাহের কারণে উৎপাদন ও ব্যবহারের মধ্যে ফারাক থেকে যাচ্ছে। যে কারণে সারাদেশে বেড়েছে লোডশেডিং। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে তীব্র লোডশেডিং দেখা দিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুই বছর ধরে গ্রীষ্ম মৌসুমে লোডশেডিংয়ে ভুগছে মানুষ। এবার পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। এরই মধ্যে এপ্রিলের শুরুতে দেশের বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলের কোথাও কোথাও ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) সূত্র বলছে, দেশে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ২৬ হাজার মেগাওয়াট। গত মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল) দিনের বেলায় সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১৫ হাজার মেগাওয়াট এবং সন্ধ্যায় সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১৬৮০০ মেগাওয়াট। আগের দিনের প্রকৃত উৎপাদন ছিল দিনে ১৩৯৭১ এবং সন্ধ্যায় ১৫৯৪৭ মেগাওয়াট। সে হিসেবে গতকাল সারাদিনে গড় সরবরাহ ঘাটতি ছিল এক হাজার মেগাওয়াটের মতো, যা লোডশেডিং দিয়ে পূরণ করা হয়েছে। এর পুরোটাই করা হয়েছে মূলত ঢাকার বাইরে, দেশের বিভিন্ন গ্রাম এলাকায়।
অধিকাংশ বিতরণ কোম্পানিতেই বিদ্যুতের ঘাটতি জানা গেছে, তীব্র দাবদাহের মধ্যে ক্রমবর্ধমান চাহিদার বিপরীতে বিদ্যুৎ সরবরাহে মঙ্গলবার দেশে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ ১ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে এবারই প্রথম বিদ্যুতের ঘাটতি এত বেশি দেখা দিয়েছে। তার আগেরদিন (সোমবার) সর্বোচ্চ ৯৬৬ মেগাওয়াট লোডশেডিং রেকর্ড করা হয়। অথচ এদিন ১৬ হাজার ২৩৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে নতুন রেকর্ড গড়েছিল বিদ্যুৎ বিভাগ।
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) ন্যাশনাল লোড ডিসপ্যাচ সেন্টারের (এনএলডিসি) তথ্য অনুযায়ী, মঙ্গলবার বিকেল ৩টায় দেশে চাহিদা ছিল ১৫ হাজার ২০০ মেগাওয়াট, তখন লোডশেডিং ছিল ১ হাজার ৪৯ মেগাওয়াট।
অন্যদিকে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় চাহিদার পূর্বাভাস ছিল ১৬ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট এবং সরবরাহের পূর্বাভাস ছিল ১৬ হাজার ৫৩০ মেগাওয়াট।
সরকারি সূত্রে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকা ও অন্যান্য বড় শহরে বিদ্যুৎ বিভ্রাট এড়াতে গিয়ে গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ বেড়েছে। বিভিন্ন এলাকা থেকে পাওয়া সংবাদে জানা যায়, এই গ্রীষ্মে প্রচণ্ড গরমের মধ্যে লোডশেডিংয়ের মাত্রা গ্রামীণ মানুষের দুর্দশা আরও বাড়িয়ে তুলছে।
তবে বিতরণ সংস্থাগুলো বলছে, ঢাকাসহ অধিকাংশ শহর এলাকা লোডশেডিংয়ের বাইরে রাখা হয়েছে। বাকি গ্রাম এলাকায় সমহারে বিদ্যুৎ বিতরণ করা হচ্ছে না। এতে কোনো কোনো গ্রামে ৬ থেকে ৭ ঘণ্টাও লোডশেডিং করতে হচ্ছে। যেসব অঞ্চলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা বেশি, সেখানে সরবরাহ বেশি। এ কারণে বরিশাল অঞ্চলের গ্রাম এলাকায় লোডশেডিং কম। কিন্তু লোডশেডিং বেশি হচ্ছে অন্যান্য বিভাগের গ্রামাঞ্চলে।
লোডশেডিংয়ের শিকার গ্রামের মানুষ দেশের ৮০ শতাংশের বেশি গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে দেশের সবচেয়ে বড় বিতরণ কোম্পানি পল্লি বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। আরইবির জোনভিত্তিক বিদ্যুতের চাহিদা ও সরবরাহের তথ্যে দেখা গেছে, গতকাল মঙ্গলবার বিকেল ৩টার দিকে এই বিতরণ কোম্পানিকে এক হাজার ৭৪৪ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হয়েছে। এই সময় সারাদেশে কোম্পানির বিদ্যুৎ চাহিদা ছিল ৮ হাজার ৮৯৬ মেগাওয়াট, সরবরাহ করেছে ৭ হাজার ১৫২ মেগাওয়াট। গতকাল আরইবির বিতরণ এলাকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং হয়েছে ময়মনসিংহ অঞ্চলে। অঞ্চলটিতে লোডশেডিং হয়েছে ৫১৭ মেগাওয়াট, যা ছিল ৪২ শতাংশ লোডশেডিং। এছাড়াও চট্টগ্রামে ১৪৯ মেগাওয়াট, ঢাকাতে ৫৬৩ মেগাওয়াট, কুমিল্লায় ২৩০ মেগাওয়াট, রাজশাহীতে ২০৭ মেগাওয়াট ও রংপুরে ৭৮ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়েছে। তবে বরিশাল, সিলেট ও খুলনায় এলাকায় চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পেরেছে প্রতিষ্ঠানটি।
এ সংস্থার দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, চাহিদামতো বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। যার কারণে এই গরমের মধ্যেও বাধ্য হয়ে আমাদেরকে লোডশেডিং করতে হচ্ছে।
রেকর্ড বিদ্যুৎ উৎপাদন, তবুও হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে লোডশেডিং
এদিকে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পেট্রোবাংলার সরকারি তথ্যে দেখা যায়, ৩ হাজার ৭৬০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে দেশে গ্যাস উৎপাদন হয়েছে দৈনিক ৩ হাজার ৫৬ মিলিয়ন ঘনফুট। এতে দেখা যায়, বেশকিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র, বিশেষ করে যেগুলো প্রাথমিক জ্বালানি হিসেবে গ্যাস ব্যবহার করে, গ্যাস সংকটের কারণে সেগুলোতে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ২ হাজার ৩১৬ দশমিক ৯ এমএমসিএফডি চাহিদার বিপরীতে ১ হাজার ৩৪৯ দশমিক ৯ এমএমসিএফডি গ্যাস সরবরাহ পেয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের এক হিসাবে দেখা যায়, সারা দেশে এক ঘণ্টা লোডশেডিং করা হলে ৯৭৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় হয়। এ হিসাবে ২ হাজার মেগাওয়াট ঘাটতির জন্য দুই ঘণ্টার বেশি লোডশেডিং করতে হয়।
বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)। প্রতিষ্ঠানটির তথ্যে দেখা যায়, মঙ্গলবার বিকেল ৩টায় সারাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৫ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট। সেই সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় ১৪ হাজার ২০২ মেগাওয়াট। তখন লোডশেডিং হয় ১০৪৯ মেগাওয়াট।
ঢাকার চিত্র কিছুটা আশাব্যঞ্জক এদিকে রাজধানীতে বিদ্যুৎ সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই বলে জানিয়েছে ঢাকার বিদ্যুৎ সরবরাহকারী দুই প্রতিষ্ঠান ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) এবং ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো)। লোডশেডিং না হলেও কারিগরি ত্রুটির কারণে কিছু কিছু এলাকায় স্বল্প সময়ের জন্য বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে বলেও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে জানা যায়।
বাড়ানো যাচ্ছে না বিদ্যুৎ উৎপাদন বিদ্যুৎ খাতে দিনে গ্যাসের চাহিদা ২৩২ কোটি ঘনফুট। এবার গ্রীষ্মে পিডিবি অন্তত ১৫০ কোটি ঘনফুট সরবরাহের দাবি জানিয়েছে। এখন সরবরাহ করা হচ্ছে প্রায় ১০০ কোটি ঘনফুট। এতে সাড়ে ১১ হাজার মেগাওয়াট গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার অর্ধেকের বেশি বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। মঙ্গলবার দিনের বেলায় গ্যাস থেকে সর্বোচ্চ উৎপাদন করা হয়েছে সাড়ে ৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। কক্সবাজারের মহেশখালীতে একটি এলএনজি টার্মিনাল বন্ধ থাকায় এতদিন পরিকল্পনা অনুযায়ী গ্যাস আমদানি করা যাচ্ছিল না বলে জানিয়েছে পেট্রোবাংলা। এটি এরই মধ্যে চালু হয়েছে। তবে গ্যাস সরবরাহ আশানুরূপ বাড়েনি।
কয়লা থেকে উৎপাদন সক্ষমতা সাড়ে চার হাজার মেগাওয়াট। সক্ষমতার প্রায় পুরোটা ব্যবহৃত হচ্ছে। যদিও কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল বকেয়া থাকায় নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিয়ে শঙ্কা আছে। বেসরকারি খাতের তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের বকেয়া জটিলতাও কাটেনি। জ্বালানি তেল আমদানির জন্য নিয়মিত ডলার পাচ্ছে না তারা। তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা আছে প্রায় ৭ হাজার মেগাওয়াট। দিনের বেলায় এক হাজার মেগাওয়াটের কম উৎপাদন করা হচ্ছে। রাতে উৎপাদন হচ্ছে সর্বোচ্চ তিন হাজার মেগাওয়াট।
সম্প্রতি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এক অনুষ্ঠানে বলেন, পাওয়ার প্ল্যান্টগুলোকে আমরা ফুললোডে চালাতে বলছি। কিন্তু এখানে বড় বিষয় হলো ফাইন্যান্স। আমাকে নিয়মিত গ্যাস দিতে হবে। আমি তো পাওয়ার প্ল্যান্ট নিয়ে বসে আছি। আমার মেইন চ্যালেঞ্জ পাওয়ার প্ল্যান্টগুলো চালু রাখা। তাদের ফাইন্যান্স সাপোর্ট দেওয়া।
পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, গত বছরের তুলনায় এ বছর নতুন করে ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে। তাই গতবছরের তুলনায় লোডশেডিং কমছে-এমন নিশ্চয়তা দিতে পারছি না। সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৫০০ থেকে ১৫০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং হওয়ার আশঙ্কা থাকছে।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বাড়লেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। এজন্য পরিকল্পিত পদক্ষেপের কোনো বিকল্প নেই।