রাইজিংবিডি স্পেশাল

প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় ‘ভয়ংকর’ কিশোর গ্যাং

২ মে, রংপুর নগরীর বকুললতা এলাকার একটি রেস্তোরাঁয় ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এরপর মেরাজ নামের এক কিশোরের নেতৃত্বে ১৫ জনের একটি দল ধারালো অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে রেস্তোরাঁর ভেতরে হামলা করে এবং মালিককে কুপিয়ে জখম করে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কিশোর দলটি ইউটিউব দেখে ককটেল বানিয়ে এলাকায় মাদক, চুরি, ছিনতাইসহ আতঙ্ক তৈরি করে। হামলাকারীদের গ্রেপ্তারে ইতোমধ্যে ওই এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। শুধু এই দলই নয়, সারা দেশে অপরাধমূলক নানা কর্মকাণ্ডে দিন দিন জড়িয়ে পড়ছে তরুণ বা কিশোররা। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় এলাকায় তাণ্ডব চালায় তারা। আর প্রভাবশালী মহলটি নেপথ্যে থেকে এলাকার চাঁদাবাজি, টেন্ডার আর ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে। 

পুলিশের তথ্য বলছে, সম্প্রতি দেড় হাজারের বেশি কিশোর-তরুণকে সারা দেশ থেকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তারা আবার মাদকাসক্তও। জানা গেছে, নেশার খরচ জোগাতেই তারা নানারকম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। গত এক বছরে ছিনতাই-ডাকাতির সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এমন তথ্য বেড়িয়ে এসেছে। ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অভিযান চালিয়ে ছিনতাই-ডাকাতির ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এসব কিশোরদের। তাদের মধ্যে ২৫টির বেশি ডাকাত দলের সন্ধান পাওয়াও গেছে। ওই দলগুলোতে প্রবীণ অপরাধীদের সঙ্গে জড়িত রয়েছে তরুণ ও কিশোররা। 

এ ছাড়াও, অপরাধে জড়িত তরুণ ও কিশোরদের হাতে রয়েছে নানা ধরনের আধুনিক সরঞ্জাম। এর সাহায্যে দ্রুত সময়ের মধ্যে তারা যে কোনও তালা খুলতে পারে। যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের কাছে থেকে দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি আগ্নেয়াস্ত্র, গুলি এবং অন্যান্য অস্ত্রও উদ্ধার করা হয়। 

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, গ্রেপ্তার এসব কিশোর এতই বেপরোয়া, মানুষ হত্যা করতেও তারা দ্বিধা করছে না। তাদের হামলায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্নস্থানে অপর গ্রুপের সদস্য ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ মারা গেছেন। এসব কিশোর গ্যাং গ্রুপে আবার রয়েছে এলাকাভিত্তিক প্রভাবশালী বা ‘বড় ভাই’। যাদের বেশিরভাগ রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত। তারা নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার জন্যই মূলত এসব তরুণ বা কিশোরদের ব্যবহার করছেন। তাদের দিয়ে প্রভাবশালীরা এলাকাভিত্তিক গড়ে তুলেছেন অপরাধের স্বর্গরাজ্য। 

সম্প্রতি এরকম বেশ কিছু ঘটনা ঘটলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টনক নড়ে। তারই অংশ হিসেবে রাজধানীর বেশ কিছু কাউন্সিলরের নাম বেড়িয়ে আসে। এরকম ২০ থেকে ২৫ জন কাউন্সিলরের নাম এখন গোয়েন্দাদের হাতে। তাদের নজরদারি করা হচ্ছে বলে পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা গণমাধ্যমকর্মীদের বিভিন্ন সময় বলে আসছেন। এর মধ্যে মিরপুর, পুরান ঢাকা, মোহাম্মদপুর, উত্তরা, খিলগাঁও, বাসাবো, মুগদা, মানিকনগর, কামরাঙ্গীরচর, সেগুনবাগিচাসহ আরও বেশ কিছু এলাকায় তাদের দৌরাত্ম্য এমনভাবে বেড়েছে যে, সাধারণ মানুষ ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পায় না। এসব এলাকায় বিভিন্ন নামে ১ থেকে ১০-এর অধিক গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। যাদের বেশিরভাগ বয়সে কিশোর। 

পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশে সব ধরনের অপরাধের মধ্যে এখন কিশোর-তরুণদের উপস্থিতি বেশি পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছে। তবে শুধুমাত্র পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন। এক্ষেত্রে তাদের পরিবার এবং সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের অংশগ্রহণ খুবই জরুরি। তাহলেই অপরাধ ও অপরাধীদের সংখ্যা কমে আসবে।

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক আরাফাত ইসলাম রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনাগুলোতে জড়িতদের গ্রেপ্তার করতে র‌্যাবের গোয়েন্দা নজরদারি রয়েছে। পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে জোরালো অভিযান অব্যাহত রয়েছে। যেখানে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বেশি হচ্ছে, সেখানে র‌্যাবের বাড়তি নজরদারি চালানো হচ্ছে।’

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘সম্প্রতি ছিনতাই-ডাকাতিতে জড়িত এক হাজারের বেশি ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগ অপরাধী তরুণ ও কিশোর। তাদের সঙ্গে আবার কিশোরও গ্যাংয়ের সদস্যরাও আছে। কারাগার থেকে তারা জামিনে ছাড়া পেয়েই পুনরায় আবার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াচ্ছে। এজন্য নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।’