প্রথম দফা উপজেলা নির্বাচনে পর দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায়ও আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব বিস্তারের রেশ ছড়িয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ দলের নীতি-নির্ধারকরা। এমনকি প্রভাবের ‘লাগাম টেনে ধরতে’ চাইলেও ফসকে যাচ্ছে। এজন্য দলীয় কৌশল নিয়েছে দলটি। প্রথম দফায় ভোটার উপস্থিতিতে ‘মোটামুটি সন্তুষ্ট’ আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় দফায় যেন ‘সন্তোষজনক’ ও ‘স্বস্তিদায়ক’ উপস্থিতি হয়, সেজন্য তৃণমূলে দলীয় নির্দেশনা পাঠাচ্ছে।
৬ষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপে ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ ভোট পড়েছে। বিচ্ছিন্নভাবে কোথাও কোথাও সংঘর্ষ, গোলাগুলি, ভোটগ্রহণ স্থগিত করা, প্রিজাইডিং কর্মকর্তা আটকসহ নানা ঘটনা ঘটেছে। কোনও প্রাণহানির ঘটনা না ঘটায় বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। তবে, এসব ছাপিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল জনপ্রতিনিধিদের প্রভাব বিস্তারের বিষয়টি। বিশেষ করে দলীয় নির্দেশ অমান্য করার হিড়িক লক্ষ্য করা গেছে।
উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদের স্বজনদের প্রার্থী হওয়া ঠেকাতে পারছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদের ১৬ জন নিকটাত্মীয় প্রার্থী হয়েছিলেন। দ্বিতীয় ধাপে এই সংখ্যা আরও বেড়ে হয় ১৮। তৃতীয় ধাপেও সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদের ১৮ স্বজন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন মাত্র তিন জন। আর একজনের প্রার্থিতা বাতিল হয়।
আওয়ামী লীগ নেতাদের কেউ কেউ মনে করছেন, সংসদ সদস্যদের অনেকে ‘নিজ বলয়ে ক্ষমতা রাখতে’ সন্তান বা নিকটাত্মীয়দের ভোটের মাঠে নামিয়েছেন। ২১ মে হতে যাওয়া দ্বিতীয় দফার নির্বাচনেও আছে মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনদের আধিক্য। এ ছাড়াও, নিজের পছন্দের প্রার্থীদের পক্ষে মাঠে নেমেছেন স্থানীয় এমপিরা। লক্ষ্য, এলাকায় প্রভাব ধরে রাখা। কারণ, উপজেলা চেয়ারম্যানদের ‘হুমকি’ মনে করছেন এমপিরা।
দলীয় সূত্র বলছে, বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী চিন্তা করছে দল। যারা নির্দেশ মানেননি, তাদের ক্ষেত্রে তড়িৎ কোনও সিদ্ধান্ত না নিয়ে ভবিষ্যতে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। প্রথম দফার নির্বাচনে ভোটার ‘টার্ন-আউট’ কম হওয়ার বিভিন্ন কারণ উঠে আসলেও মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব বিস্তার ‘ভোটারদের মধ্যে আগ্রহ হারানোর’ অন্যতম বড় কারণ হিসেবে মনে করছে দল। এজন্য দ্বিতীয় দফায় যেন এর পুনরাবৃত্তি না ঘটে এবং অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়— এজন্য দলীয় কোন্দল মেটাতে কাজ করছে আ.লীগ। নির্বাচনে দলীয় এমপিদের প্রভাবে লাগাম টেনে ধরতে পুরনো দলীয় নির্দেশনার সঙ্গে কঠোর বার্তাও যোগ করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে এর প্রভাব পড়তে পারে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, দলীয় নির্দেশ অমান্য করলে তাদের শাস্তি পেতেই হবে। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে ৭৩ জন এমপি মনোনয়ন পাননি, ২৫ জন ক্যাবিনেটে বাদ পড়েছেন— শাস্তিটা অনেকভাবেই আসতে পারে।
দলীয় নির্দেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেবে আ.লীগ?— এ বিষয়ে কিছুটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন দলের সাংগঠনিক সম্পাদক সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন। রাইজিংবিডিকে তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক শাস্তিটা দুভাবে হতে পারে। একটি প্রকাশ্যে, অন্যটি অপ্রকাশ্য। একটা হচ্ছে শোকজ বা বহিষ্কার। আরেকটি যোগ্যতা আর সম্ভাবনা থাকা স্বত্বেও তিনি তার প্রাপ্যটা থেকে বঞ্চিত হন।’
‘একজন মানুষ যখন রাজনীতি করেন, তিনি সম্মানটাকে খুব ভয় পান। দল যদি শোকজ করে, বহিষ্কার করে; এটা যদি সংবাদমাধ্যমে আসে, তিনি হেয়-প্রতিপন্ন হন। এটাও কিন্তু এক ধরনের শাস্তি। আর অপ্রকাশ্য শাস্তি হয় যেটা, তাতে তিনি অনেকটা অস্বস্তিতে থাকেন। তার ডেডিকেশন অনুযায়ী দলীয় পদ বা জনপ্রতিনিধি বা মন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা থাকা স্বত্বেও তিনি তা পান না। অতীতেও কিন্তু এমন উদাহরণ আছে’— যোগ করেন তিনি।
আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করছেন, প্রথম দফায় ভোটার উপস্থিতি যা হয়েছে, তা একেবারে ‘খারাপ নয়’। এ ছাড়া, এখন ধান কাটার মৌসুম। বিশেষত হাওরাঞ্চলে বোরো ধান কাটায় সবাই ব্যস্ত। একটি বড় রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ না করা, বিভিন্ন স্থানে ঝড়-বৃষ্টিসহ নানা কারণে ভোটার উপস্থিতি কম হয়েছে। গাজীপুরের অধিকাংশ ভোটার কারখানাশ্রমিক হওয়ায় ভোট কম পড়েছে। শহর এলাকায় ছুটি থাকলে শ্রমিকরা বাড়ি চলে যায়। বৈরী আবহাওয়া ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার নেপথ্যে কাজ করেছেন বলে মনে করেন তারা। তবে দলীয় মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব বিস্তারেও ভোটারদের আগ্রহ কমতে পারে বলে মনে করছেন নেতারা।
দলের শীর্ষ পর্যায়ের দুজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা মনে করছেন, ভোটার উপস্থিতির এই হারকে বড় করে দেখাতে চাইছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। তারা দেখাতে চাইছে, নির্বাচনে বিএনপি না আসার কারণে ভোটারদের আগ্রহ কমেছে। তবে বিষয়টি যে সঠিক নয়, ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার কারণ যে অন্য— সেটা পরের ধাপের নির্বাচনগুলোতে প্রমাণ করতে চায় আওয়ামী লীগ। এজন্য দলীয় সংসদ সদস্যদের প্রভাব কমাবে দলটি। একইসঙ্গে নির্বাচনে সংঘাত কমিয়ে এনে উৎসবমুখর করতে প্রচার কার্যক্রমে জোর দিচ্ছে দলটি। উপজেলা ভোটের সামনের ধাপগুলোতে এই প্রচার কার্যক্রম জোরদার করার কথা বলছেন দলের নেতারা। তারা মনে করছেন, বিষয়গুলো চিহ্নিত করে কাজ করতে পারলে নির্বাচন আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে। যার প্রভাব পড়বে ভোটার উপস্থিতিতে।
উপজেলা নির্বাচন ঘিরে ষড়যন্ত্র আছে উল্লেখ করে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ধান কাটার মৌসুম চলছে, সেদিন (উপজেলা ভোটের দিন) অনেক জেলায় ঝড়-বৃষ্টি হয়েছে। কোথাও কোথাও ভোট কম হতে পারে, কিন্তু নেত্রীর নির্বাচনি এলাকা গোপালগঞ্জে ভোট পড়ে ৬৮ শতাংশ।
তিনি বলেন, কিন্তু কোথাও কোথাও একেবারেই স্বাভাবিক না, একটু কমই পড়েছে। চলমান পরিস্থিতিতে বিএনপি ও কিছু সাম্প্রদায়িক দলের ভোট বর্জনের মধ্যে যে ভোট পড়েছে, সেখানে আমি একটা কথা বলতে চাই, বিএনপির সরকারের সময়ে হওয়া কোন স্থানীয় নির্বাচন এত শান্তিপূর্ণ হয়েছে?
এ সম্পর্কে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমাদের নির্দেশনা ছিল যাতে এমপি-মন্ত্রীদের স্বজনরা নির্বাচন না করেন। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজের পরিবারের সংজ্ঞা দিয়েছেন। তবে সেই নির্দেশনা মেনে অনেকেই নির্বাচন থেকে বিরত রয়েছেন। তারা মনোনয়নপত্রই দাখিল করেননি। আমাদের মূল টার্গেট হচ্ছে, দলের চেয়ে দেশ বড়। আর দেশের যেহেতু নির্বাচন, এটি অবাধ ও উৎসবমুখর হবে।’
প্রথম দফার নির্বাচনের অভিজ্ঞতার আলোকে ভোটার অংশগ্রহণ বাড়াতে কাজ করছেন জানিয়ে আবু সাঈদ আল মাহমুদ বলেন, ‘গত নির্বাচনে যে টার্ন-ওভার ছিল, পরবর্তীতে আমাদের টার্গেট, এটি যেন বাড়ে। ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর বিষয়টিকেই গুরুত্ব দিচ্ছি আমরা। সেভাবেই তৃণমূলে নির্দেশনা পাঠাচ্ছি।’