এক সময় বেপরোয়া গতিতে শুধু ঢাকার অলিগলি দাপিয়ে বেড়ানো ব্যাটারিচালিত অটো রিকশার দৌরাত্ম্য রাজধানীর প্রধান সড়কেও বেড়েছে। এতে যেমন বেড়েছে দুর্ঘটনা, তেমনই বিপজ্জনক এই বাহনে আহত হচ্ছেন যাত্রীরা। একইসঙ্গে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠা এসব অটো রিকশা তৈরি করছে ভয়াবহ যানজট, যা ছড়িয়ে পড়ছে গলি থেকে প্রধান সড়ক অবধি। অনুমোদনহীন এই বাহনের বিষয়ে এতদিন দায়িত্বশীলরা নীরব ভূমিকা পালন করলেও অবশেষে টনক নড়েছে। এই যান রাজধানীতে চলাচলের নিষেধাজ্ঞা এসেছে।
তবে, রাজধানীর থেকে অটো রিকশা উঠিয়ে দেওয়া কতটুকু সম্ভব হবে, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে রাজধানীবাসী। তারা বলছেন, যেখানে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী এই অটো রিকশাকে ‘বাংলার টেসলা’ উপাধি দিয়ে উৎসাহিত করেছেন, সেখানে রাজধানী থেকে এই যান উঠিয়ে দেওয়া কঠিন হতে পারে।
রাজধানী ঢাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা যেন চলতে না পারে সে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বুধবার বিআরটিএর সদর কার্যালয়ে আয়োজিত সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদের সভায় তিনি এ নির্দেশ দেন।
ওবায়দুল কাদের বলেন, ব্যাটারিচালিত কোনও গাড়ি (তিন চাকার) যেন ঢাকা সিটিতে না চলে। আমরা ২২টি মহাসড়কে নিষিদ্ধ করেছি। শুধু নিষেধাজ্ঞা নয়, চলতে যেন না পারে সে ব্যবস্থা নিতে হবে। এর আগে, দুই সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ঢাকার মধ্যে অটো রিকশা বন্ধে সম্মতি জানান।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ব্যাটারিচালিত অটো রিকশাসহ এ-সম্পর্কিত যানবাহনের আধিক্যে প্যাডেলচালিত রিকশার ত্রাহি অবস্থা। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত অবধি চলে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে। নিয়ম ভেঙে যত্রতত্র করে পার্কিং, সৃষ্টি হয় অসহনীয় যানজট। তাদের বেপরোয়া গতিতে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। গলিতেও এই যানটির ভয়াবহ গতির কারণে ভয়ে মানুষ রাস্তা পার হতে পারে না। সম্প্রতি রাজধানীর দক্ষিণ বনশ্রীতে রাস্তা পার হতে গিয়ে অটো রিকশার আঘাতে দূরে গিয়ে ছিটকে পড়েন আদনান হোসেন নামের একজন। একমাস তিনি হাত নাড়াতে পারেননি। আদনান বলেন, রাস্তা পার হতে গিয়ে হাত উঠালেও তারা থামে না। প্রচণ্ড গতিতে এলাকার ভেতরেও রিকশা চালান তারা।
ঢাকার মতিঝিলে একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন আকরাম মোল্লা। থাকেন রাজধানীর দক্ষিণ বনশ্রী এলাকায়। তিনি মতিঝিল থেকে বনশ্রী যাওয়ার পথে প্রায়ই এই ব্যাটারিচালিত অটো রিকশায় যাতায়াত করেন। অনীহা থাকলেও অন্য যানবাহনের অভাবে তাকে এই বাহনে উঠতে হয়। কিন্তু যতক্ষণ থাকেন, চালকের প্রচণ্ড গতিতে ভীত থাকেন সব সময়। আস্তে চালাতে বললেও শোনেন না। অনেক সময় উল্টো ভর্ৎসনা করেন তারা। একইসঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই খিলগাঁও থেকে বনশ্রী যাওয়ার পথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যামে বসে থাকেন। তার মতে, নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে চালানোর কারণে এই জ্যামের সৃষ্টি হয়।
ব্যাটারিচালিত অটো রিকশাচালকদের সঙ্গে কথা জানা গেছে, কিছুদিন আগেও এসব অটো রিকশা অলিগলি থেকে মূল সড়কে এলেই পুলিশ তাড়া করতো। সেই অটো রিকশা এখন মহাসড়কেও চলছে। অনেকে আবার টোকেন দিয়ে মহাসড়কে চালাচ্ছে এসব অবৈধ অটো রিকশা। মূলত তারা নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে থানা থেকে ‘টোকেন কার্ড’ নেন। সেই টোকেন কার্ডেরও আবার মেয়াদ থাকে। মেয়াদ শেষে করতে হয় নবায়ন। এ ছাড়া, এলাকার নেতা থেকে শুরু করে মালিক-শ্রমিক বিভিন্ন স্তরে দিতে হয় টাকা। আর যদি এসব নিয়ম না মেনে রিকশা রাস্তায় নামায় তাহলে পড়তে হয় বিপদে। পুলিশ ধরলে ১২০০ টাকা ডাম্পিং। কোনও রশিদ দেয় না, টাকা নিয়ে ছেড়ে দেয় বলেও তাদের ভাষ্য। অথচ ব্যাটারিচালিত রিকশার কোনও অনুমোদন নেই। চালকদেরও নেই কোনও প্রশিক্ষণ। দুই সিটি কর্পোরেশনের নিয়মনীতিকে বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে কীভাবে রাজধানীতে চলছে বেপরোয়া গতির এই পরিবহন— সেই প্রশ্ন নগরবাসীর।
ঢাকার দুই মেয়রও অটো রিকশা বন্ধ করার পক্ষে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ভয়াবহ ব্যাপার যখন রিকশাচালকরা দুই পা ওপরে উঠিয়ে বেপরোয়া গতিতে চালায়। অনেক প্রতিবন্ধী আছেন যারা চোখে কিছুটা কম দেখেন, তারাও এই রিকশা নিয়ে নেমে পড়েন।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, সিদ্ধান্তে আসা দরকার যে ঢাকায় ইজি বা অটোরিকশা চলবে না। এটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
দুই মেয়রের এবং সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ব্যাটারিচালিত অটো রিকশা বন্ধের কথা বললেও এর পক্ষে কথা বলেছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
সম্প্রতি সংসদে দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি ব্যাটারিচালিত অটো রিকশাকে ‘বাংলার টেসলা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন তিনি। প্রতিমন্ত্রী বলেন, ব্যাটারিচালিত এই যানবাহন সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব। রাষ্ট্রীয়ভাবে এই তিন চাকার যানকে উৎসাহিত করা হবে। আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের সম্পূরক প্রশ্নের উত্তরে নসরুল হামিদ এ কথা বলেন। শামীম ওসমান ব্যাটারিচালিত অটো রিকশা বন্ধের দাবি জানালে প্রতিমন্ত্রী এগুলোকে উৎসাহিত করার কথা বলেন।
শামীম ওসমান বলেন, ব্যাটারিচালিত অটো রিকশা চলছে। রিকশার সঙ্গেও ব্যাটারি লাগানো হচ্ছে। এগুলো খুবই বিপজ্জনক। ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ চুরি করে অটো রিকশাগুলো চার্জ করা হয়। এতে ৭০০-৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে। এগুলো বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া হবে কি না?
জবাবে নসরুল হামিদ বলেন, সারা বিশ্বে এখন বৈদ্যুতিক গাড়ির বিপ্লব চলছে। তেলচালিত গাড়ির ইঞ্জিনের দক্ষতার মাত্রা হলো ২০ শতাংশ। অন্যদিকে, ইলেকট্রিক যন্ত্রের দক্ষতা ৮০ শতাংশ। বাজারে যত দ্রুত সম্ভব ইলেকট্রিক গাড়ি আনতে আমরা উৎসাহ দিচ্ছি।
তিনি জানান, তেলচালিত বাহনে কোনো দূরত্ব যেতে যদি ১০০ টাকা লাগে, বিদ্যুৎচালিত যানে সেটা যেতে লাগবে ২০ টাকা। বাংলাদেশে ৪০ লাখের ওপর যানবাহন আছে যেগুলো লেড-অ্যাসিড ব্যাটারি ব্যবহার করে। এগুলো চার্জ করতে সাত-আট ঘণ্টা সময় লাগে। এগুলো যদি লিথিয়াম ব্যাটারির হয়, তাহলে লাগবে মাত্র আধা ঘণ্টা।
নসরুল হামিদ বলেন, এই ৪০ লাখ থ্রি-হুইলারকে আমি বলি ‘বাংলার টেসলা’। উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে তারা নিজ হাতে এই যানবাহন তৈরি করছেন। আমরা তাদের কোনও বাধা দিচ্ছি না।
রাজধানীবাসী বলছেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে যখন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তার সরকার স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নে কাজ করছে, তখন অনুমোদনহীন এই যান ঢাকার সৌন্দর্য নষ্ট করছে। এই ধরনের পরিবহন পরিকল্পিত নগরায়নের প্রধান অন্তরায় বলছে শহর পরিকল্পনাবিদরা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আদৌ কি বন্ধ হবে ‘বাংলার টেসলা’?