প্রত্যাশা-প্রাপ্তির গড়মিলে যে অভিমান জমেছিলো ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের মাঝে, তা ভেঙেছে। জোটের প্রধান আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিত্রদের ডেকে তাদের কথা শুনেছেন। মন খুলে কথা বলেছেন শরিকরাও। দীর্ঘদিনের ক্ষোভ আর আক্ষেপও প্রকাশ পেয়েছে তাদের বক্তব্যে। ভোটের হিসাব নয়, জোটের হিসাব করতে জোটের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন তারা।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এই প্রথম বৃহস্পতিবার (২৩ মে) রাতে জোট প্রধান, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে বসেন ১৪ দলীয় জোট নেতারা। এর আগে আসনবন্টন নিয়ে সর্বশেষ গত বছরের ৪ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠকে বসেছিলেন তারা।
বৈঠকে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু, বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী, সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) এর আহ্বায়ক রেজাউর রশিদ খান উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৪ দলীয় জাটের নেতাদের আরও সুসংগঠিত হওয়ার আহ্বান জানান। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ছাড়া দেশের মানুষের কল্যাণ হবে না জানিয়ে এ সময় স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তিকে আরও সুসংগঠিত হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। ১৪ দল নেতাদের তিনি বলেন, আপনারা এসেছেন, ভালো হয়েছে। আমি খুশি হয়েছি। সবার কথা শুনবো। কীভাবে কি করা যায়।
পরে ১৪ দলীয় জোটের নেতারা বক্তব্য রাখেন। তারা জোট গঠনের সময়ে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যর কথা স্মরণ করিয়ে দেন। জোট গঠনের সময়ে একসঙ্গে আন্দোলন, একসঙ্গে নির্বাচন, একসঙ্গে সরকার গঠনের বিষয়টি তোলেন তারা। এ সময় সম্প্রতি আওয়ামী লীগের নেতাদের বক্তব্য টানেন শরিক নেতারা। তারা বলেন, ‘এটা ভোটের জোট নয়, আদর্শিক জোট। প্রতিষ্ঠার সময়ে সেরকম কথাই ছিলো।’ এ সময় বিভিন্ন সময়ে বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলন এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে তাদের পৃথক দলীয় কর্মসূচি ও পদক্ষেপের বিষয়টিও তোলেন। তারা বলেন, ১৪ দলকে আরও এগিয়ে নিতে সারাদেশে জাগরন তৈরি করতে হবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী রাইজিংবিডিকে বলেন, আমরা মূল্যায়ন চেয়েছি। ছোট হোক, বড় হোক সবারই মূল্যায়ন দরকার। আমরা বলেছি, এখন শরিকদের ভোটের হিসাব করা হচ্ছে। কিন্তু যখন জোট হয়েছিলো তখন ভোটের হিসাব করা হয়নি। এটা একটা আদর্শিক জোট হবে সেটিই বলা হয়েছিলো। আর যদি ভোটের হিসাব ধরা হয়, তাহলে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম সাংসদ হয় কীভাবে?
তিনি বলেন, জেলা-উপজেলা পর্যায়ে ১৪ দলের কোনো কর্মকাণ্ড নেই। আমরা সেই বিষয়টিও তুলে ধরেছি। জেলা-উপজেলায় ১৪ দলের কমিটি করে জোটের কর্মকাণ্ড এগিয়ে নিতে হবে।
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, ১৪ দল সংগ্রাম নির্বাচন একসাথে আছি। রাজনৈতিকভাবে সরকারের বিরুদ্ধে যখন আক্রমণ বা আমেরিকার ভূমিকায় আমরা পাশে ছিলাম। অতীতেও ছিলাম। একটা গোষ্ঠী অর্থনীতি খাতে নৈরাজ্য লুটতরাজ করছে। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আমরা সংগ্রাম অব্যাহত রাখবো। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আমরা। ১৪ দলকে স্পেস দিতে হবে। আমরা কথা বলতে চাই। এগোতে চাই। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা ১৪ দলের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। ইনু সাহেবকে, মাইজভান্ডারি বাদশা সাহেবের বিরুদ্ধে হয়েছে। আমরা এটা চাই না। নেত্রী ঐক্যবদ্ধ থাকতে বলেছেন। পার্টিতে আলোচনা করে পরবর্তী সংগ্রাম কর্মসূচি ঠিক করবো।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, দীর্ঘদিন পর বৈঠক হলো। অনেক দূরত্ব ছিল। এসব নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সরকার উৎখাতের বিষয়ে ষড়যন্ত্র নিয়ে কথা হয়েছে। দেশি বিদেশি চক্রান্ত মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ থাকতে বলেছেন জোট নেত্রী শেখ হাসিনা। মনোমালিন্য ত্রুটি বিচ্যুতি সমাধান করার কথা বলেছি আমরা।
বৈঠক সম্পর্কে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সাড়ে তিন ঘণ্টা ১৪ দলের বক্তব্য শুনেছেন। যার যা বলার সবাই বিস্তারিত বলেছেন। এতে ১৪ দলের যে দূরত্বের কথাটা বলা হয়, সেটি আর থাকবে না।
তিনি বলেন, ১৪ দল নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার প্রারম্ভিক বক্তব্যে সমসাময়িক বিষয়ক এবং অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ব্যাপারে সবাই ঐক্যমত হয়েছেন। ১৪ দলের সবাই গাইডলাইন চেয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ১৪ দলীয় জোটের নেতারা। ফাইল ছবি
‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৪ দলকে নিজেদের দলগুলোকে আরও সংগঠিত করা এবং নিজেদের দলগুলোকে জনগণের কাছে আরও জনপ্রিয় করে তোলা.. এই ব্যাপারে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।’
তিনি জানান, ১৪ দলকে এই মুহূর্তে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক মানবতাবোধকে এগয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ১৪ দলের নেতারা সমন্বিতভাবে আরও সুশৃঙ্খল ও সংগঠিত ঐক্য গড়ে তুলবেন, এই ব্যাপারে সবাই অঙ্গীকার করেছেন।
গত নির্বাচনে ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের সঙ্গে ছয়টি আসনে সমঝোতা করে আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) কেন্দ্রীয় নেতা এ কে এম রেজাউল করিম জয়ী হয়েছেন। ওই নির্বাচনে শরিকরা তাদের ছেড়ে দেওয়া ছয়টি আসনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বসিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করেছিল। কিন্তু তা আমলে নেয়নি আওয়ামী লীগ। এ নিয়ে জোটের মধ্যে এক ধরনের তিক্ততা তৈরি হয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনে শরিকদের ১৩টি আসনে ছাড় দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে সাতটিতে জয়ী হন তারা। পরে উপনির্বাচনে আরেকটি আসন পায় ১৪ দলের শরিকেরা। গত সংসদে ১৪ দলের শরিকদের দুজন নারী সংসদ সদস্যও ছিলেন। এবার সংরক্ষিত নারী সদস্য একজন।