ইতিহাসের সর্বোচ্চ দীর্ঘস্থায়ী ঝড় দেখলো দেশবাসী। যার স্থায়ীকাল ছিলো ৪৮ ঘণ্টা। রেমাল উপকূলে আঘাত হানে গত ২৫ মে। যার স্থায়ীত্বকাল ছিলো ২৭ মে সন্ধ্যা পর্যন্ত।
ঝড়ের আঘাতে উপকূলসহ বিভিন্ন এলাকা লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। এর আগে এতো দীর্ঘস্থায়ী ঝড়ের রেকর্ড আবহাওয়া দপ্তরের ফাইলে নেই। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন খুলনা আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র আবহাওয়াবিদ মো. আমিরুল আজাদ।
এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন এবং ধীরগতির কারণেই মূলত ঘূর্ণিঝড় রেমাল দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে।
আবহাওয়া অফিসের রেকর্ড অনুযায়ী, ২৫ মে সন্ধ্যা ৬টা থেকে ২৭ মে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত টানা ৪৮ ঘণ্টা স্থায়ী হয় রেমাল। এর মধ্যে ২৫ মে সন্ধ্যা ৬টা থেকে ঝড়ের অগ্রভাগ আঘাত হানে। এরপর ২৬ মে ঝড়ের মূল অংশ (আই/চোখ/সেন্টার) আঘাত হানে। সর্বশেষ ২৭ মে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ঝড়ের শেষাংশ (টেল/লেজ) আঘাত হানে। এই তিন অংশ মিলিয়ে স্থায়ী হয় দীর্ঘক্ষণ। যে কারণে ক্ষতির পরিমাণও হয়েছে ব্যাপক।
ইতিহাসের সর্বোচ্চ দীর্ঘস্থায়ী ঝড় দেখলো দেশবাসী। ছবি: রাইজিংবিডি
দীর্ঘস্থায়ী রেমালের ধীর তাণ্ডব আবহাওয়াবিদ আমিরুল আজাদ দপ্তরের রেকর্ড ঘেটে রেমালকে দেশের ইতিহাসে সর্বস্থায়ী বলে উল্লেখ করেছেন। রাইজিংবিডি ডটকমকে তিনি বলেন, এর আগে সিডর, আইলা, মহাসেন, মোরা, বুলবুল ও আম্ফানসহ ভয়াল অনেক ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। তবে কোনটিই এতো স্থায়ী হয়নি। শুধুমাত্র রেমাল ছিলো ব্যতিক্রম।
এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেমন মৌসুমে অধিক ঠান্ডা, অধিক গরম পড়ছে। ঠিক একই কারণে এই ঝড়ের গতি প্রথমদিকে বেশি থাকলেও শেষের দিকে এসে স্লো-মোশনে ল্যান্ডে ওঠে। একই সঙ্গে মুভমেন্ট ম্লো হয়ে যায়। যে কারণে স্থায়িত্বকাল অধিক হয়।
জলবায়ু পরিবর্তন আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ২০০০ সাল থেকে ২০২৩ পর্যন্ত বাংলাদেশ উপকূলে যে ঘূর্ণিঝড়গুলো আঘাত হানে, সাধারণত ২ থেকে ৬ ঘণ্টার মধ্যে তা স্থল নিম্নচাপ থেকে দুর্বল হয়ে বাংলাদেশ ভূখণ্ড অতিক্রম করে যায়। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় রেমাল আঘাত হানার পর যে স্থল নিম্নচাপটি তৈরি হয়েছে, তা গত মঙ্গলবার পর্যন্ত বাংলাদেশ ভূখণ্ডে অবস্থান করে। এটি দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার যেসব কারণের কথা বলছেন বিশ্লেষক ও গবেষকরা তার মধ্যে অন্যতম জলবায়ু পরিবর্তন।
খুলনায় রেমালের তাণ্ডব। ছবি: রাইজিংবিডি
জিআইএস বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণগুলোকে বাইরে রেখে ঝড়ের প্রকৃতি বিশ্লেষণের সুযোগ নেই। বৈশ্বিক সিস্টেমে পরিবর্তনের কারণে আবহাওয়ায় এক ধরনের তারতম্য তৈরি হচ্ছে।
রেমালে ক্ষতি আবহাওয়া দপ্তরের সূত্র অনুযায়ী, খুলনার ও সাতক্ষীরা উপকূলীয় এলাকায় ২০০৯ সালের ২৫ মে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় আইলা। আইলার সেই ক্ষত কাটিয়ে ওঠার আগেই ২০১৩ সালের ১৬ মে মহাসেন, ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই কোমেন, ২০১৬ সালের ২১ মে রোয়ানু, ২০১৭ সালের ৩০ মে মোরা, ২০১৯ সালের ৪ মে ফণী, একই বছরের ১০ নভেম্বর বুলবুল আঘাত হানে। ২০২০ সালের ২০ মে আম্পান, ২০২১ সালের ২৬ মে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস। ২০২২ সালের ১২ মে আসনি, এরপর একই বছরের ২৫ অক্টোবর সিত্রাং এবং সর্বশেষ ‘মোখা’ আঘাত হানে। এসব ঘূর্ণিঝড়ের সময় বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় কয়রা, দাকোপ, আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়ন। যার ক্ষত এখনো শুকায়নি।
জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, এবারের ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে খুলনার ৯টি উপজেলার কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপ, বটিয়াঘাটা, ডুমুরিয়া ও রূপসা এই ছয়টি উপজেলার ৩৮টি ইউনিয়নের মৎস্য সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে কয়রা, পাইকগাছা ও দাকোপে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ঝড়ের তাণ্ডবে জেলায় ওই ৬টি উপজেলার ৩৫৫ দশমিক ৩০ হেক্টর জমির ৩ হাজার ৬০০টি পুকুর এবং ১০ হাজার ২২৩ দশমিক ৭৫ হেক্টর জমির ৯ হাজার ১১৫টি ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে ১ হাজার ৫৯০ হেক্টর জমির ১ হাজার ৩৫৬টি কাকড়া ও কুচিয়া খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সূত্র জানায়, এবারের ঝড়ে মোট ক্ষতি হয়েছে ২৪৫ কোটি ৯৫ লাখ ৫০ হাজার টাকার মৎস্য সম্পদ। যার মধ্যে ৬৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা মূল্যের ৩ হাজার ৭৮ মেট্রিক টন মাছ, ১১৪ কোটি ৬৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা মূল্যের ২ হাজার ৫৬৪ মেট্রিক টন চিংড়ি, ২০ কোটি ৫৭ হাজার টাকা মূল্যের ৬৩৬ মেট্রিক টন পোনা, ১৮ কোটি ৬৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা মূল্যের ১০২ দশমিক ২০ মেট্রিক টন কাকড়া/কুচিয়া, ৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা মূল্যের ২৭০ মেট্রিক টন পিএল, ২০ লাখ টাকা মূল্যের ২০টি নৌকা/ট্রলার/জলযান এবং ১৬ কোটি ১১ লাখ টাকার অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে।
রেমালে ক্ষতিগ্রস্ত একটি বাড়ি। ছবি: রাইজিংবিডি
খুলনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়দেব পাল বলেন, ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে খুলনায় মৎস্য চাষীদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করেছি। এতে ২৪৫ কোটি ৯৫ লাখ ৫০ হাজার টাকার সাদা মাছ, চিংড়ি, পোনা, কাকড়া ও অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে।
অপরদিকে, ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে খুলনার দাকোপ, কয়রা ও পাইকগাছা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। ভাঙা বাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানিতে তলিয়ে তলিয়ে অসংখ্য গ্রাম। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন হাজার হাজার মানুষ।
জেলা প্রশাসনের তথ্য জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের তথ্য বলছে, ঘূর্ণিঝড়ে জেলার ৭৬ হাজার ৯০৪টি ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। বিভিন্ন ইউনিয়নের ৫২টি ওয়ার্ড সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিভিন্ন উপজেলার সঙ্গে খুলনা মহানগরীতেও অসংখ্য গাছপালা উপড়ে পড়েছে। ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৪ লাখ ৫২ হাজার ২০০ মানুষ।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সূত্র জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড় রেমালে খুলনা বাগেরহাট-সাতক্ষীরা জোনের ৬টি স্থানে ৬১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে লবণ পানি লোকালয়ে প্রবেশ করছে। এসব এলাকার চিংড়ি ঘের, ফসল ঘরবাড়ি তলিয়ে গেছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী বিদ্যুৎ কুমার সাহা।
ভাঙন স্থানগুলো হলো খুলনার দাকোপ উপজেলার তিলডাঙ্গা-বটবুনিয়া ঢাকী নদীর ডান তীর প্রায় বিশ মিটার বেড়িবাধঁ ভেঙে লোকালয়ে লবন পানি ঢুকছে। একই উপজেলার পানখালী–খলসি এলাকায় পশুর নদীর ভাঙন, বাগেরহাট জেলার মোড়লগঞ্জের বলাইবুনিয়া ইউনিয়নে শ্রেনীখালী দৈবজ্ঞকাঠি পানগাছী নদীর ভাঙন। বাগেরহাট জেলার সদর ইউনিয়নের দড়াটানা নদীর ভাঙন। খুলনা জেলায় (সার্কেল সাতক্ষীরা) উত্তরবেদকাশী হরিহরপুর শাকবাড়ী নদীর ভাঙন এবং খুলনা জেলার পাইকগাছা ইউনিয়নের দেলুটি ইউনিয়নের ভদ্রা নদীর ভাঙন।
বাধ নির্মাণকাজ শুরু সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, পানি উন্নয়ন বোর্ড, স্থানীয় প্রশাসন ও স্থানীয় বাসিন্দারা স্বেচ্ছ্বাশ্রমের ভিত্তিতে বাধ নির্মাণকাজ শুরু করেছেন।