ঘূর্ণিঝড় রেমাল চলে গেছে। রেখে গেছে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কান্না, ধ্বংসস্তূপ, হাহাকার। প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকা উপকূলীয় জীবনে যোগ হলো আরও কঠিন লড়াই। ঘরহীন মানুষের জন্য ঘরের সংস্থান, খাদ্য হারানোর মানুষটির খাবারের যোগান, সম্পদ হারানো মানুষটির সম্পদ যোগাড়ে আবার লড়তে হবে, বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে ভেসে যাওয়া মৎস খামারিদের নতুন করে পড়তে হবে সংকটে।
দীর্ঘ সময়ের তাণ্ডবে রেমাল নদ-নদীর পানির উচ্চতা বাড়িয়ে বিপুল ক্ষতির চিহ্ন রেখে গেছে। বাতাসের গতি বাড়িয়ে প্রকৃতিকে করে গেছে তছনছ। এসব কারণে উপকূলের মানুষের জীবন ও জীবিকার লড়াই আরও কঠিন করে তুলবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উপকূলের মানুষজন আগের চেয়ে আরও বেশি বিপদের মুখোমুখি। ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় এবং নানান ধরণের প্রাকৃতিক বিপদ তাদের গা সওয়া। কিন্তু এসব তারা কতটুকু সামাল দিতে পারেন। ঘন ঘন দুর্যোগের কবলে পড়ে তাদের সর্বস্ব হারাতে হয়, জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যায়। হতে হয় ঋণী।
দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মধ্যে অনেকেই সারা জীবনেও ঋণের বোঝা সরাতে পারেন না। দুর্যোগগুলো জীবন ও জীবিকার সব পথ বন্ধ করে দেয়। মানুষজন কর্মসংস্থান হারায়। অনেক পরিবারকে বাস্তুহারা হতে হয়, তারা গ্রাম ছেড়ে চিরদিনের জন্য শহরে পাড়ি জমান। ঘূর্ণিঝড় রেমালও অনেকর জীবন জীবিকার পথ বন্ধ করে দিয়ে গেছে। ঘূর্ণিঝড় চলে যাওয়ার পর এখন শুরু হয়েছে তাদের নতুন লড়াই।
ঘূর্ণিঝড়ের ফলে নদী উত্তাল হয়ে উঠেছে। এক শিশু সেটি দেখতে ছুটে এসেছে
আচরণগতভাবে রেমাল ছিল অন্যান্য ঘূর্ণিঝড় থেকে কিছুটা ভিন্ন প্রকৃতির। ১. এটি দীর্ঘ সময় নিয়ে বাংলাদেশ অতিক্রম করেছে। ২. এটি ওয়েদার মানচিত্রের রুট অনুযায়ী আঘাত করেনি। ৩. এটি সমগ্র উপকূল এলাকাকেই জলোচ্ছ্বাসের মুখামুখি করেছে। ৪. ভূমিতে আসার পরেও রেমালের শক্তি কমেনি।
উপকূলের বয়সী ব্যক্তিরা, এমনকি আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা এত দীর্ঘ সময় নিয়ে ঘূর্ণিঝড় অতিক্রম করতে দেখেনি। দীর্ঘ সময় ধরে তাণ্ডব চালানোর ফলে উপকূলসহ সারা দেশই কমবেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে।
ঘূর্ণিঝড় রেমালে সারা দেশে ১৬ জনের মৃত্যু এবং পৌনে দুই লাখ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে বলে সরকারি তরফ থেকে জানানো হয়েছে। জলোচ্ছ্বাসের কারণে ধারণার চেয়েও বেশি ক্ষতি হয়েছে উপকূলজুড়ে।
ঘূর্ণিঝড়ের সাধারণত তিনটি ধাপ— লঘুচাপ, নিম্নচাপ এবং ঘূর্ণিঝড়। রেমালের ক্ষেত্রে সমুদ্রে লঘুচাপ সৃষ্টি হওয়ার অনেক আগেই মানুষ জানতে পারেন, প্রবল শক্তি নিয়ে একটি ঘূর্ণিঝড় আসছে এবং এটি ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হলে আঘাত করবে বাংলাদেশের মধ্য-উপকূলে। যদিও আঘাতের রুট পরে বদলে যায়।
খোলপেটুয়া নদীর পাড়ে মানুষজন
তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে আগে থেকেই ঘূর্ণিঝড়ের খবর জানতে পারলে প্রস্তুতি গ্রহণে সময় পাওয়া যায়। কিন্তু এর নেতিবাচক দিক হলো, অযথা আতঙ্ক ছড়ানো।
ঘূর্ণিঝড়ের দুইদিন আগে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর যাই। যেখানে অবস্থান করিলাম, সেখান থেকে মাত্র ১০০ ফুট দূরে খোলপেটুয়া নদী। উত্তাল নদীর চেহারাটা দেখা যায় এত দূরে বসেই। ঘূর্ণিঝড়ের একদিন আগে জুমআর্থ মানচিত্রে দেখতে পাই, ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম কর্নার থেকে অর্থাৎ শ্যামনগর উপজেলার দক্ষিণের বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করবে। কিন্তু একদিন পরে রুট কিছুটা পরিবর্তন হয়ে ঘূর্ণিঝড় রেমাল ভারতের সীমানায় ল্যান্ডফল করে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। সমুদ্র থেকে ভূমিতে আসার পরে সাধারণত ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি কমে যায়। অন্যান্য ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষেত্রে সেটাই দেখা গেছে। কিন্তু রেমাল এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রমী আচরণ করেছে।
রেমালের ওলটপালট গতিপ্রকৃতির কারণেই হোক, আর অন্য কোন কারণেই হোক— ঘূর্ণিঝড়টি চলে যাওয়ার পরে আমরা আবারও উপকূলের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারি, উপকূল সুরক্ষার তাগিদ অনুভব করি। রেমাল আবারও আমাদেরকে উপকূল সুরক্ষার গুরুত্ব মনে করিয়ে দেয়। ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি আরও জোরদার করার কথা মনে করিয়ে দেয়।
ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের কাছে মডেল। পৃথিবীর অনেক দেশ ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অনুসরণ করে। পেছনের দিকে তাকালে ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় অগ্রগতিও লক্ষ্য করা যায়। ১৯৭০, ১৯৮৮ ও ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় থেকে মৃত্যুর সংখ্যা অনেকটাই কমিয়ে আনা গেছে। তবে ক্ষয়ক্ষতি কমাতে এখনো অনেক কাজ বাকি।
১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত ঘোষণার পর রেডক্রিসেন্ট স্বেচ্ছাসেবকেরা প্রচারণা চালাচ্ছেন
আমাদের একটি ভালো ‘এসওডি’ বা ‘স্ট্যান্ডিং অর্ডারস অন ডিজাস্টার’ রয়েছে। এতে দুর্যোগকালে প্রত্যেকের দায়িত্ব-কর্তব্য উল্লেখ করা আছে। জাতীয় পর্যায় থেকে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত কমিটি রয়েছে। কমিটিতে কারা থাকবেন, কে কী কাজ করবেন, সবই উল্লেখ রয়েছে এসওডিতে।
প্রশ্ন হলো, এই এসওডি মাঠ পর্যায়ে কতটা বাস্তবায়ন হচ্ছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এত ভালো গাইডলাইন খুব কম দেশেই আছে। বাংলাদেশ এটা করতে পেরেছে। কিন্তু এটি সঠিকভাবে বাস্তবায়নের বিষয়টি আরও নজরদারিতে রাখতে হবে।
ঘূর্ণিঝড়ের আগে স্বেচ্ছাসেবকদের উদ্যোগ বেশ চোখে পড়ে। যেমনটা এবার রেমালের আগেও চোখে পড়েছে। শুধুমাত্র রেডক্রিসেন্টের সাইক্লোন প্রিপারডনেস প্রোগ্রাম বা সিপিপি’র স্বেচ্ছাসেবক নয়, বিভিন্ন বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানেরও রয়েছে স্বেচ্ছাসেবক দল।
রেমাল আঘাতের আগের দিন যেখানে অবস্থান করেছিলাম, সেখানে স্বেচ্ছাসেবকদের জরুরি বার্তা ঘোষণা করতে দেখেছি। কিন্তু এক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতা চোখে পড়েছে। প্রতিটি এলাকার সব সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবকেরা ঘূর্ণিঝড় আসার আগে সমন্বয় বৈঠক করে দায়িত্ব ঠিক করে নিলে আরও ভালো হয়। শুধুমাত্র মাইকিংয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে স্বেচ্ছাসেবকদের কাজগুলো আরও বিস্তৃত করা উচিত।
রেমাল বিপন্ন নদী তীরের একটি এলাকা
ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলো আধুনিকায়ন করা হয়েছে। কিন্তু ব্যবস্থাপনায় এখনো বিশেষ কোনো পরিবর্তন এসেছে বলে মনে হয় না। রেমালের তাণ্ডব যখন চলছিল (২৬ মে) তখন বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের কয়েকটি এলাকায় মানুষের সাথে কথা বলে জেনেছি, তারা ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে আগ্রহী নন। এমনকি ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত শুনেও নয়। অথচ তারা বেড়িবাঁধের বাইরে নদীর ধারে বসবাস করছেন।
আশ্রয়কেন্দ্রের পরিবেশকে দায়ী করেছেন তারা। বলেছেন, আশ্রয়কেন্দ্রে গেলে খাবার পাওয়া যায় না, বসার জায়গা পাওয়া যায় না। নারীদের জন্য এই সমস্যাটি আরও মারাত্মক। অন্যদিকে উপকূলে এখনো অনেক এলাকা রয়েছে, যেখানে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা কম। ৪-৫ কিলোমিটারের মধ্যে আশ্রয়কেন্দ্র নেই, তারা কীভাবে নিরাপদ আশ্রয়ে যাবে! এবার ঘূর্ণিঝড়ের রুট অনুযায়ী ঝুঁকিতে ছিল শ্যামনগরের কৈখালী, রমজাননগর, কালিঞ্চি, ভেটখালী, হরিনগর ইত্যাদি এলাকা। কিন্তু ওইসব এলাকায় আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা খুব কম।
ঘূর্ণিঝড়ের আগে এবং পরে বেড়িবাঁধের প্রসঙ্গটি ঘুরেফিরে আসে। কিছু এলাকায় যুগ যুগ ধরে নাজুক বেড়িবাঁধ রয়েছে। নাজুক বেড়িবাঁধগুলো জোয়ারের চাপে ভেঙে যাবে এটা সবাই জানে। ঘূর্ণিঝড়ের পরে এর প্রমাণও মিলে। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড সেটা দেখে কিনা জানা নেই।
দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় দেখতে পাই, স্বেচ্ছাশ্রমে এলাকাবাসী বেড়িবাঁধ মেরামত করে। রেমালের পরেও ওই অঞ্চলে সেই দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। শক্ত এবং টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় প্রবণ এলাকার মানুষজন।
রেমালের খবরে দুশ্চিন্তায় সুন্দরবন লাগোয়া নদীর তীরের মানুষ
বেড়িবাঁধের ক্ষেত্রে আরেকটি প্রবণতা দেখা যায়, এলাকাবাসীর দাবির প্রেক্ষিতে বেড়িবাঁধের জন্য বরাদ্দ হয় কিন্তু কাজ শুরু হতে বিলম্ব ঘটে। অনেক স্থানে বেড়িবাঁধ নির্মাণে দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগও উঠে। ২০০৭ সালে সিডর বিধ্বস্ত এলাকা বাগেরহাটের শরণখোলায় বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বেড়িবাঁধ হয়েছে। কিন্তু সেই বেড়িবাঁধ কয়েকটি স্থান বেশ কয়েকবার ধ্বসে গিয়েছিল। এবার ঘূর্ণিঝড় রেমালের পরে দেখা গেছে শরণখোলা সদরের ব্লক ফেলা স্থানে ফাটল দেখা গেছে। একইভাবে ঘূর্ণিঝড় আইলার পরে খুলনার দাকোপের বেড়িবাঁধেও ভাঙন দেখা গেছে। ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতির ক্ষেত্রে বেড়িবাঁধ নির্মাণে আরও বেশি গুরুত্বের দাবি রাখে।
ঘূর্ণিঝড়ের পরে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের কাছে ত্রাণ পৌঁছানো বড় চ্যালেঞ্জ। শেষ প্রান্তের সঠিক ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিটির কাছে ত্রাণ পৌঁছানো খুব জরুরি। সঠিক ব্যক্তিদের কাছে ত্রাণ পৌঁছানোর জন্য দরকার সঠিক তালিকা। কিন্তু এই তালিকা প্রণয়নে স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণের অভিযোগ বরাবরের। সবার কাছে ত্রাণ পৌঁছানো সম্ভব হলে মানুষগুলো তাদের সংকট কিছুটা কাটিয়ে উঠতে পারেন। জরুরি ত্রাণের পরে আসে পুনর্বাসন সহায়তার কথা। মানুষগুলোর ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য দরকার হয় সহায়তা। কিন্তু এক্ষেত্রেও একই অভিযোগ পাওয়া যায়। সঠিক ব্যক্তিদের কাছে পুনর্বাসন সহায়তা পৌঁছায় না। প্রকৃতপক্ষে, জরুরি ত্রাণ সহায়তা শেষ হয়ে যাওয়ার পরেই ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের মূল লড়াইটা শুরু হয়। তখন তাদের পাশে কেউ থাকে না। এক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সহায়তা দিলে তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারে।
ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতির ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব একটি বড় ইস্যু। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নীরবে অনেক কিছুই ঘটছে। ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতির ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনকে বিবেচনায় রাখতে হবে। অভিযোজনের বিষয়টি এখন বিশ্বব্যাপী জলবায়ু আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে। আমরা লক্ষ্য করেছি, যেকোনো ঘূর্ণিঝড় সংকেতের আগেই বিদ্যুৎবিহীন অন্ধকারে ডুবে যায় গোটা উপকূল। বিদ্যুতের সঙ্গে ইন্টারনেটেরও সংযোগ রয়েছে। বিদ্যুৎ এবং ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় বিপন্ন এলাকার মানুষদের সংকট যেন কয়েকগুণ বেড়ে যায়। বিকল্প কী পদ্ধতিতে ঘূর্ণিঝড় চলাকালে যোগাযোগ চালু রাখা যায়, সেদিকে নজর দিতে হবে। সর্বোপরি, মানুষের কথা বিবেচনায় রেখে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতিকে আরও শক্তিশালী করতে হবে।