ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) লিমিটেডের মিটারিং বিভাগ ছাড়া ‘কাজে মন বসে না’ এই বিভাগের দক্ষিণের দায়িত্বে থাকা সাব-ডিভিশনাল প্রকৌশলী পলাশ কৃষ্ণ চৌধুরীর। চাকরিজীবনের ৯ বছরের মধ্যে ৮ বছরই তিনি কাজ করছেন এখানে। ডিপিডিসি সূত্র জানিয়েছে, মূলত, মিটারিং বিভাগ থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে থেকে বিপুল পরিমাণ সম্পদ ও কালো টাকার মালিক হওয়া পলাশ যে কোনও মূল্যে এখানে থাকেন। এই ‘মধুর লোভে’ বদলির শঙ্কা দেখা দিলেই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে তা বাতিল করে দেন তিনি। অভিযোগ রয়েছে, দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে ডিপিডিসির মিটারিং বিভাগে অনিয়মকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে গড়ে তুলেছেন একচ্ছত্র আধিপত্য।
প্রতিষ্ঠানটির বেশ কয়েকটি সূত্র বলছে, পলাশের অনিয়ম ও দুর্নীতির খতিয়ান এবং বেশ কয়েকবার গ্রাহকদের লিখিত অভিযোগের পরও রহস্যজনক কারণে ডিপিডিসির মানবসম্পদ বিভাগ (এইচআর) তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি, এইচআরকেও ম্যানেজ করেন পলাশ।
গ্রাহকদের অভিযোগ এবং অনুসন্ধানে জানা গেছে, গ্রাহকদের সঙ্গে স্বেচ্ছাচারিতাই শুধু নয়, ঘুষ না দিলে গ্রাহকদের অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার দেখিয়ে টাকা আদায় করেন পলাশ কৃষ্ণ চৌধুরী। গ্রাহকদের নয়-ছয় বুঝিয়ে বাড়তি টাকা নেওয়া, সঙ্গে দুর্ব্যবহার তার নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। প্রকৌশলী আবদুল্লাহ নোমান ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব নেওয়ার পর দুর্নীতিমুক্ত ও স্মার্ট ডিপিডিসি গঠনের প্রতিশ্রুতিকে একপ্রকার বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছেন এই পলাশ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে ২০১৫ সালের ১৭ ডিসেম্বর চাকরিজীবনে প্রবেশ করেন পলাশ কৃষ্ণ চৌধুরী। এর এক বছর পরেই তিনি মিটারিং বিভাগে (দক্ষিণ) যোগ দেন ২০১৬ সালের ৭ জুন। ৬ বছর একই জায়গায় থাকার পর ২০২২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি এইচআর বিভাগে তাকে বদলি করা হয়। খুব বেশি দিন তার এইচআর বিভাগ ভালো লাগেনি। কারণ, এখানে কোনও ‘মধু নেই’। তাই, তিনি আবারও পুরনো জায়গায় ফিরে আসেন। মাত্র ১৬ দিনের মাথায় মার্চের ১৫ তারিখে তিনি ফিরে আসেন তার রাজত্বে, যেখানে অনিয়মের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। দীর্ঘদিন এই বিভাগে থাকতে সংশ্লিষ্টকে সবাইকে ম্যানেজ করেন পলাশ। এই তালিকায় আছেন ডিপিডিসির দুজন কর্মকর্তা। এ ছাড়া, এইচআর বিভাগের দুজন কর্মকর্তা তার আস্থাভাজন বলে জানিয়েছে সূত্র।
জানতে চাইলে পলাশ কৃষ্ণ চৌধুরী রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমি কতদিন কোথায় থাকলাম, এটা এইচআর বিভাগের এখতিয়ার। এখানে বিশেষায়িত লোক দরকার’।
তবে, ডিপিডিসির মিটারিং বিভাগের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির অনেক জায়গাতেই বিশেষায়িত লোক আছেন। কিন্তু, একজনকে দীর্ঘদিন একই জায়গায় রাখতে হবে, এমন কোনও লোকবল সঙ্কট বা বিশেষায়িত লোকের সঙ্কট ডিপিডিসিতে নেই। দীর্ঘদিন একজন একই স্থানে থাকা বা থাকতে চাওয়া মানে, সেখানে তার স্বার্থ আছে।
সূত্র জানিয়েছে, ডিপিডিসির মতো স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের স্পর্শকাতর এই বিভাগে থেকে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন সাব-ডিভিশনাল প্রকৌশলী পলাশ। ঢাকায় একাধিক ফ্ল্যাট, প্লট, গাড়িসহ বিপুল পরিমাণ কালো টাকার মালিক তিনি। নিত্যনতুন অনিয়ম আর দুর্নীতির পথ তৈরি করেন পলাশ। ডিপিডিসির ৩৬টি ডিভিশন থেকে বিদ্যুৎ চুরির ঘটনায় জব্দকৃত গ্রাহকদের মিটার ট্যাম্পারিং, বাইপাস করে বিদ্যুৎ চুরির মিটার জব্দ করে মিটারিং ডিভিশনে পাঠানো হয় পরীক্ষা করার জন্য। অর্থাৎ, জব্দকৃত ওই মিটারে গ্রাহক কী পরিমাণ বিদ্যুৎ চুরি করেছেন, তার রিপোর্ট নেওয়ার জন্য। এই রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে গ্রাহকের কাছ থেকে জরিমানার বিল আদায় করা হয়। এ-জাতীয় বেশিরভাগ কাজের জন্য পলাশ ওই শ্রেণির গ্রাহকদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে নয়-ছয় রিপোর্ট দেন। তাতে করে ডিপিডিসি প্রতিনিয়ত রাজস্ব হারাচ্ছে।
মিটারিং বিভাগ সূত্রে আরও জানা গেছে, ৩৬টি ডিভিশনে উচ্চচাপ বিদ্যুৎ সংযোগের ক্ষেত্রে গ্রাহকদের বাধ্য করা হয় পলাশের কাছ থেকে এইচটি ও এলিটিসিটি মিটার কেনার জন্য। গড়ে তুলেছেন মিটার সিন্ডিকেট। না হলে ওই গ্রাহককে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার সময় নানারকম ত্রুটি ধরে সংযোগ চালু করতে অপারগতা প্রকাশ করা হয়। গ্রাহক যদি তার কাছ থেকে মিটার কিনতে সম্মতও হন, তাহলে ওই গ্রাহককে এলটিসিটি মিটারের জন্য ৬০ হাজার টাকা এবং এইচটি মিটারের জন্য ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা গুনতে হয়। শুধু এখানেই থেমে নেই পলাশ, উচ্চচাপ বিদ্যুৎ সংযোগ চালু করার সময় প্রতিটি গ্রাহকের কাছ থেকে সে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা ঘুষ নেন। কোনও গ্রাহক যদি ঘুষের টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানান, তাহলে সে গ্রাহককে লাইনের ত্রুটি আছে বলে আর ওই সংযোগ চালু করেন না। গ্রাহক উপায়ন্তর না দেখে একটা সময় বাধ্য হন পলাশকে ঘুষ টাকা দেওয়ার জন্য।
এ বিষয়ে মিটারিং বিভাগের (দক্ষিণ) সাব-ডিভিশনাল প্রকৌশলী পলাশ কৃষ্ণ চৌধুরী রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে এসব তথ্য সঠিক নয়, বানোয়াট কথা’।
মিটারিং বিভাগের পলাশ কৃষ্ণ চৌধুরীর অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে ডিপিডিসির জেনারেল ম্যানেজার (আইসিটি অ্যান্ড মিটারিং) মো. রবিউল হাসান রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘এসব অনিয়ম-দুর্নীতির কথা শুনেছি। এই বিষয়ে আমরা খোঁজ-খবর অবশ্যই নেব। প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে’।
পড়ুন
পর্ব-১: ডিপিডিসি: গ্রাহক বাধ্য হচ্ছেন ৯ গুণ বেশি দামে মিটার কিনতে
পর্ব-২: মিটারের কমিশন বাণিজ্যে সর্বস্বান্ত গ্রাহক, নেপথ্যে কারা
পর্ব-৩: অপ্রতিরোধ্য মিটার সিন্ডিকেট, অসহায় গ্রাহক
পর্ব-৪: ডিপিডিসি-তে তোলপাড়, শেষ হচ্ছে মিটার বাণিজ্য ও বৈষম্য