কোরবানির ঈদের আর মাত্র ৪দিন বাকি। আগামী ১৭ জুন মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা। পশু কোরবানির মধ্য দিয়ে এই উৎসব পালন করেন মুসলমানরা। ফলে কোরবানির জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় দা, ছুরি, চাপাতি ও গাছের গুঁড়ি কেটে বানানো ‘খাইট্টা’র। প্রয়োজনীয় এসব জিনিসের জোগান দিতে ঈদের আগে ব্যস্ত সময় পার করছেন কামারশালার কর্মীরা।
কামারশালায় সারা বছর দা-ছুরি তৈরি হলেও ঈদুল আজহার সময় ব্যস্ততা অনেক বেড়ে যায়। সাথে বাড়ে দা-ছুরি-চাপাতির দাম। সিজনাল পণ্য হিসেবে চাহিদা বাড়ে গাছের গুঁড়ি কেটে বানানো ‘খাইট্টা’র।
ক্রেতারা বলছেন, কোরবানির ঈদ যতো ঘনিয়ে আসছে, ততই বাজারে দাম বাড়েছে পশু কোরবানিতে অতি প্রয়োজনীয় বিভিন্ন হাতিয়ারের। দাম বাড়লেও এসব পণ্যের মান নিয়ে তেমন সন্তুষ্ট নেন তারা।
অন্যদিকে বিক্রতাদের দাবি, কোরবানির ঈদ ঘনিয়ে এলেও দা-ছুরি-চাপাতি-খাইট্টার ব্যবসা আগের মতো। বাজারে তেমন ক্রেতা নেই। সঙ্গত কারণে বিক্রিও তেমন একটা নেই। বিদেশি এসব পণ্যের কাছে মার খাচ্ছে দেশীয় পণ্য। তাদের দাবি, চাইনিজ এসব পণ্যের তুলনায় দেশি পণ্যের মান অনেক ভালো হওয়ার পরও, চাকচিক্যের কারণে ক্রেতারা বিদেশি পণ্য বেশি কিনছে।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের টিসিবি ভবনের পাশের মার্কেটের পাশ দিয়ে বাজারে ঢুকতেই ওয়াসার পাম্প। পাম্পের আশে-পাশেই চলছে লোহা কাটা ও হাতুড়ির বাড়ির শব্দ। এখানে রয়েছে ৮-১০টি দোকান। এসব দোকানে ঝুলছে দেশি ও চাইনিজ কুড়াল, পশু জবাইয়ের বড় ছুরি। থরে থরে সাজানো আছে দা, বটি, নানা সাইজের ছুরি।
বুধবার (১২ জুন) কারওয়ান বাজারেরর এসব দোকানে গিয়ে দেখা যায়, কিছু দোকানের সামনে কয়েকজন ক্রেতা থাকলেও বেশিরভাগ দোকানেই ক্রেতা নেই। এসব দোকানের পেছন দিকে রয়েছে ছোট ছোট কামারশালা। কামারশালায় বানানো হচ্ছে দা-বটি ও নানা সাইজের ছুরি। কেউ কেউ পুরোনো হাতিয়ারগুলোতে শাণ দিয়ে সেগুলো সাজিয়ে রাখছেন দোকানে।
এই এলাকার দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৫৫-৬০ বছর অর্থাৎ পাকিস্তান আমল থেকে এখানে তারা বা তাদের পূর্ব-পুরুষরা এখানে দা-ছুরি-চাপাতি এসবের ব্যবসা করে আসছেন। এখানকার প্রায় সবাই পুরোনো ব্যবসায়ী। বছরের অন্য সময় টুকটাক চললেও কোরবানির ঈদের আগে দা-ছুরি-চাপাতি-কুড়ালের চাহিদা অনেক বাড়ে। তবে এ বছর এখন পর্যন্ত কেমন ক্রেতারা আসেননি। আগামী দু-এক দিনের মধ্যে ক্রেতারা আসবেন এবং চাহিদা মতো দা-ছুরি-চাপাতি এসব কিনে নেবেন বলে আশা করছেন প্রায় সত্তর বছরেরও বেশি বয়সী এখনার প্রবীণ ব্যবসায়ী খলিল মিয়া।
নোয়াখালির বাসিন্দা খলিল মিয়া জানান, তার বাবা মতিন মিয়াও এই ব্যবসা করতেন। বংশ পরম্পরায় তিনিও সেটা করছেন। তার দোকানের বড় ছুরির দাম, মানভেদে প্রতিটি ৭০০-১৫০০ টাকা। ছোট-মাঝারি ছুরি প্রতিটি ১৫০-৬০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। লোহার তৈরি চাপাতির কেজি ৭০০-৮০০ টাকা, দেশি কুড়াল প্রতিটি ৯০০-১০০০ টাকা, চাইনিজ কুড়াল প্রতিটি ৭০০-৮০০ টাকা এবং গাছের গুঁড়ি কেটে বানানো ‘খাইট্টা’ প্রতি পিসের দাম ৪০০-১০০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে বটি-দা-চাপাতির কেজি হিসেবে ৭০০-৮০০ টাকা, আর প্রতিটির দাম ৬০০- ৮০০ টাকার মধ্যে।
কাঁঠাল বাগান থেকে আসা ক্রেতা মাহমুদ বলেন, কয়েকটি দোকান ঘুরে দেখলাম-গতবারের তুলনায় এবার সবকিছুর দাম বেশি। একটা বড় ছুরির দাম চাচ্ছে ১৩০০-১৪০০ টাকা, এর কমে কেউ দিতে চাইছে না। অথচ এগুলোই গত ঈদের সময়ই ৮০০ থেকে ১০০০ টাকার মধ্যেই ছিল। ২০২২ সালে আরও কম টাকায় কিনেছিলাম। ২০০-২৫০ টাকার গাছের খাইট্টা এবার ৪০০-৫০০ টাকার নিচে কেউ দিচ্ছে না।
আরেক ক্রেতা শিরিন শারমিন বলেন, এটা বড় মার্কেট, ভেবেছিলাম এখানে একটু কম মূল্যে পাবো। একটা বড় বটি খোঁজ করছিলাম। বাজারে কয়েক ধরনের লোহার বটি আছে। মানভেদে একেকটার একেক রকম দাম। যেসব পছন্দ হয়, সেগুলোর দাম ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। একই মানের বটিগুলো আগে কিনছি ৪০০ থেকে ৫০০টাকার। দিন দিন সবকিছুরই দাম বাড়ছে।
মায়ের দোয়া নোয়াখালী হার্ডওয়্যারের আবদুল করিম জানান, লোহার দাম আগের তুলনায় অনেক বেড়ে যাওয়ার কারণে পাকা লোহার তৈরি ভালো জিনিসের দাম একটু বেশি। আগে আমরাও কম দামে বিক্রি করেছি। এখন আমরা বেশি দাম দিয়ে পাত কিনে আনি, খরচ বেশি পড়ে-তাই বাধ্য হয়ে বেশি দামে দা-ছুরি-বটি এসব বিক্রি করতে হচ্ছে। দেশিগুলোর চেয়ে চাইনিজ হাতিয়ারের দাম একটু কম। তবে ক্রেতাদের কাছে দেশি ও চাইনিজ দুই ধরনের হাতিয়ারেরই চাহিদা আছে বলেও জানান এই ব্যবসায়ী।
তিনি আরও বলেন, এখন ক্রেতারা আসছেন, দেখছেন, পছন্দ করছেন। কেউ কেউ কিনছেন। আগে দূর থেকে মানুষ আসতো এখানে। এখন আর আগের মতো বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষ আসে না। এখন শহরের বিভিন্ন এলাকার লোকজনই বেশি আসে। এখনও তেমন বিক্রি শুরু হয়নি। আশা করছি, কাল পরশু ক্রেতারা আসবেন, আর বেচা বিক্রিও বাড়বে।
মা জননী কামারশালার জাফর কর্মকার বলেন, আমাদের হাতিয়ারের পুরোনো ব্যবসা। সারা বছরের পাশাপাশি ঈদে চা-ছুরি-বটি এসবের চাহিদা বাড়ে। আমরাও সেভাবে প্রচুর পরিমানে বানিয়ে রেখেছি। আমাদের দোকান সারা বছরই খোলা থাকে, পর্যাপ্ত মালামালও আছে। তবে, দিনদিন এসব পণ্যের দাম বাড়ছে বলেও জানান এই পুরোনো ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, একসময় যেসব চাপাতি বা কুড়াল আমরা ২০০ থেকে ৩০০ টাকায় বিক্রি করেছি, এখন সেসব ১০০০ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি। সব জিনিসের দাম বেড়েছে, বাধ্য হয়ে আমরাও দাম বাড়িয়েছি। বয়স তো কম হলো না, কতকিছু নিজের চোখে দেখেছি।
জাফর কর্মকার আরও বলেন, আগে পাকা লোহার দা-চাপাতি পাওয়া যেত, যেগুলো মানে অত্যন্ত ভালো ছিল। এখন পাকা এবং মিক্সড লোহা দিয়ে বানানো সব ধরনের দা-চাপাতি পাওয়া যায়। মানভেদে একেক হাতিয়ারের একেক দাম। ক্রেতারা তাদের চাহিদা অনুযায়ী কিনেন। দেশীয় তৈরি পাকা লোহার দা-চাপাতি-কুড়ালগুলো এখনও মানে ভালো। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে আমদানি করা চাইনিজ হাতিয়ার। এগুলোর দাম দেশি হাতিয়ারের চেয়ে অনেক কম এবং দেখতে আকর্ষণীয়। তবে বিদেশি এসব হাতিয়ারের মান দেশিগুলোর মানের সমান নয় বলেও জানান তিনি।