বাংলার মানুষের মুক্তির যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী, দেশের মাটি ও মানুষের দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যাত্রা যে বাড়ি থেকে; সেটি পুরনো ঢাকার টিকাটুলির কেএম দাস লেনের ‘রোজ গার্ডেন’ নামে পরিচিতি। অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল ও তরুণ মুসলিম লীগ নেতাদের উদ্যোগে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ‘বশির সাহেবের রোজ গার্ডেনের’ বাসভবনে একটি রাজনৈতিক কর্মী সম্মেলনের মাধ্যমে পাকিস্তানের প্রথম বিরোধীদল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। ভবনটি এখনো সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। সেই থেকে আওয়ামী লীগের যাত্রা শুরু। শত ঘাত-প্রতিঘাত, ষড়যন্ত্র উৎরিয়ে দলটি এখন কোটি কোটি মানুষের প্রাণের দলে পরিণত হয়েছে, নেতৃত্ব দিচ্ছে জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণের।
মুসলিম লীগের প্রগতিশীল নেতাকর্মীরা সংগঠন থেকে বেরিয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন আওয়ামী মুসলিম লীগ। প্রথম সম্মেলনে সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক। জেলে থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন প্রথম কমিটির যুগ্ম সম্পাদক।
পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘কোথাও হল বা জায়গা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত হুমায়ুন সাহেবের বাড়ি রোজ গার্ডেনের সম্মেলনের সিদ্ধান্ত হয়। সেদিনের সে সম্মেলনে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকসহ তৎকালীন রাজনৈতিক নেতারা রোজ গার্ডেনে উপস্থিত ছিলেন। সকলেই একমত হয়ে নতুন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করলেন, তার নাম দেওয়া হল-পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। আমি মনে করেছিলাম, পাকিস্তান হয়ে গেছে। সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের দরকার নাই। একটা অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হবে, যার একটা সুষ্ঠু ম্যানিফেস্টো থাকবে।
এরপর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ, আওয়ামী লীগের সংগ্রাম আর ত্যাগের হার না মানা ইতিহাস। অবশেষে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দীর্ঘ ৯ মাসের এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ৩০ লাখ শহিদের রক্ত আর ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। আওয়ামী লীগের ইতিহাস, বাঙালি জাতির গৌরবোজ্জ্বল অর্জন ও সংগ্রামের ইতিহাস। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাসহ বাঙালি জাতির যা কিছু শ্রেষ্ঠ অর্জন, তার মূলে রয়েছে জনগণের এই প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব। জন্মলগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের শক্তির উৎস জনগণ, শক্তির উৎস সংগঠনের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা।
বিভিন্ন মাধ্যমে জানা যায়, ব্রিটিশ আমলে ঋষিকেশ দাস নামের একজন ধনী ব্যবসায়ী ছিলেন। তবে, সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসায় ঢাকার খানদানি পরিবারগুলো তেমন পাত্তা দিত না ঋষিকেশ দাসকে। কথিত আছে যে, একবার তিনি জমিদার নারায়ণ রায় চৌধুরীর বাগানবাড়ি বলধা গার্ডেনের এক জলসায় গিয়ে অপমানিত হয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। এরপরই তিনি রোজ গার্ডেন প্যালেস তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৩১ সালে পুরান ঢাকার ঋষিকেশ দাস রোডে একটি বাগানবাড়ি তৈরি করা হয়। বাগানে প্রচুর গোলাপ গাছ থাকায় এর নাম হয় রোজ গার্ডেন।
গার্ডেনের ভবনটি সজ্জিতকরণের কাজ সমাপ্ত হওয়ার আগেই ব্যবসায়ী ঋষিকেশ দাস আর্থিকভাবে দেউলিয়া হয়ে যান। ১৯৩৭ সালে তিনি রোজ গার্ডেন প্যালেসটি খান বাহাদুর আবদুর রশীদের কাছে বিক্রয় করে দিতে বাধ্য হন। প্রাসাদটির নতুন নামকরণ হয় ‘রশীদ মঞ্জিল’। মৌলভী কাজী আবদুর রশীদ মারা যান ১৯৪৪ সালে, তার মৃত্যুর পর রোজ গার্ডেনের মালিকানা পান তার বড় ছেলে কাজী মোহাম্মদ বশীর (হুমায়ূন সাহেব)। ১৯৭১-এ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বে ১৯৭০-এ বেঙ্গল স্টুডিও ও মোশন পিকচার্স লিমিটেড রোজ গার্ডেন প্যালেসের ইজারা নেয়। ‘হারানো দিন’ নামের জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের শুটিং এই বাড়িতে হয়েছিল। এ কারণে সে সময় ভবনটি ‘হুমায়ুন সাহেবের বাড়ি’ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ১৯৮৯ সালে রোজ গার্ডেনকে সংরক্ষিত ভবন হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্তু, আদালতে মামলা করে ১৯৯৩ সালে মালিকানা স্বত্ব ফিরে পান কাজী আবদুর রশীদের মেজ ছেলে কাজী আবদুর রকীব। ১৯৯৫ সালে তার প্রয়াণ হয়।
ইতিহাস ঐত্যিহ্যের সাক্ষী হয়ে থাকা রোজ গার্ডেন বাড়িটি শিগগিরই ঢাকা জাদুঘরের রূপ পাচ্ছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় থাকা এই স্থাপনাটির মালিকের কাছে থেকে কিনে নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। ঐতিহাসিক রোজ গার্ডেন কিনে নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে সম্পত্তির বর্তমান মালিক ও তার সন্তানদের কাছ থেকে এ সম্পত্তি ক্রয়ের রেজিস্ট্রিকৃত দলিল গ্রহণ করেন।
‘সরকারি ক্রয় আইন’ অনুযায়ী ৩৩১ কোটি ৭০ লাখ টাকার বিনিময়ে বর্তমান মালিকের কাছ থেকে এ স্থাপনাটি কেনা হয়। ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনা করে এটিকে একটি জাদুঘরে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এ সময় প্রধানমন্ত্রী একটি চেক এবং ঐতিহাসিক ভবনের বিনিময়ে রোজ গার্ডেনের মালিককে নগরীর গুলশানে ২০ কাঠা জমিসহ একটি একতলা ভবন বিক্রির একটি রেজিস্ট্রিকৃত দলিল হস্তান্তর করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, পুরান ঢাকার ইতিহাস তুলে ধরতে ঐতিহাসিক রোজ গার্ডেনকে জাদুঘরে পরিণত করা হবে। রোজ গার্ডেনের একটি ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে। কেননা দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন এখান থেকেই যাত্রা শুরু করে।
এই ঐতিহাসিক ভবনটি যথাযথভাবে সংরক্ষণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই দলের নেতৃত্বেই বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন করে। এমন স্থাপনা নষ্ট হতে দেওয়া যায় না। সরকার এর আগে নগর ভবনে একটি জাদুঘর স্থাপন করেছে। তবে, এখন সেই জাদুঘরটি রোজ গার্ডেন ভবনে স্থানান্তর করা হবে। তিনি ভবনটির মূল কাঠামো অপরিবর্তিত রেখে এটি সংস্কার করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন।
প্রায় সাড়ে ৭ বিঘা জমির ওপর এখন অবস্থান রোজ গার্ডেনের। ভবনটির মোট আয়তন সাত হাজার বর্গফুট। উচ্চতায় ৪৫ ফুট। ছয়টি সুদৃঢ় পিলারের এই প্রাসাদটি স্থাপিত। প্রতিটি পিলারে দারুণ কারুকাজ। প্রাসাদটির স্থাপত্যে করিন্থীয়-গ্রীক শৈলী অনুসরণ করা হয়েছে। রোজ গার্ডেনের গেট দিয়ে প্রবেশ করলেই দেখা মিলবে একাধিক পাথরের মূর্তি। রয়েছে ফোয়ারা। ভবনটি সামনে রয়েছে বড় পুকুর আর ইমারত দিয়ে তৈরি ঘাট। তবে, রোজ গার্ডেনের মূল ভবনটির ভেতরে এখন আর কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না।
মূল ভবনের দ্বিতীয় তলায় পাঁচটি কামরা আর একটি বড় নাচঘর আছে। নিচতলায় আছে আটটি কামরা। রোজ গার্ডেন প্যালেসের পশ্চিম ও উত্তর দিকের দেয়ালের মধ্যবর্তী অংশে দুটি মূল ফটক আছে। প্রবেশ ও বহির্গমনের জন্য স্থাপিত পশ্চিম দিকের ফটক দিয়ে প্রবেশ করলে প্রথমেই আছে একটি বিস্তীর্ণ খোলা প্রাঙ্গণ। এখানে মঞ্চের ওপর দণ্ডায়মান নারী মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। পুকুরের পূর্বদিকে আছে পশ্চিমমুখী একটি দোতলা ইমারত যার বর্তমান নাম ‘রশিদ মঞ্জিল’। এখানে থাকতেন এর মালিক।
রোজ গার্ডেনে জন্ম নেওয়া আওয়ামী লীগ এখন দীর্ঘপথ পরিক্রমায় পেয়েছে স্থায়ী আধুনিক কার্যালয়। রোজ গার্ডেনে দলটি গঠনের পর এর কার্যালয় ১৯৫৬ সালে পুরান ঢাকার ৫৬, সিমসন রোডে স্থানান্তর হয়। এভাবে ১৯৬৪ সালে ৯১ নবাবপুর রোডে, এরপর সদরঘাটের রূপমহল সিনেমা হলের গলি, পুরানা পল্টনে কার্যালয়ের স্থান স্থানান্তরিত হয়েছে কয়েকবার। এরপর যায় সার্কিট হাউস রোডে। ১৯৮১ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের হাল ধরলে নানা বিবেচনায় ঠিকানা হয় ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ।
২০১১ সালে নতুন কার্যালয়ের পরিকল্পনা হাতে নেয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। সরকারি বিধি অনুযায়ী নানা কার্যক্রমের পর ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে ভবন নির্মাণের আনুষ্ঠানিক কাজে হাত নেওয়া হয়। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে দশতলা আধুনিক ভবন পেয়েছে দলটি। এটি এখন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়।