গ্রাহকের অপরাধকে পুঁজি করে তার কাছ থেকে অনৈতিক আর্থিক সুবিধা নিতে ‘ভুয়া টাস্কফোর্সে’র চিত্রনাট্যে এখন তোলপাড় ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি)। ওই ঘটনায় চাকরি হারিয়েছেন দুজন। বিষয়টি এতদিন ধামাচাপা থাকলেও, হঠাৎ করে বেরিয়ে এসেছে থলের বিড়াল।
ডিপিডিসির এক সূত্রে জানা গেছে, এই ভুয়া টাস্কফোর্স সাজানো এবং তাদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নেওয়ার পরিকল্পনাকারী ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান প্রকৌশলী (সেন্ট্রাল) মো. জাহাঙ্গীর আলম। এর সঙ্গে ছিলেন ডিপিডিসির আরও দুজন। ঘটনার সময় তিনি বংশাল ও বাংলাবাজার সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ছিলেন। বংশাল এলাকার এক গ্রাহকের অনৈতিকভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহারের খবরে সেখানে গিয়ে ‘টাস্কফোর্স’ পরিচয় দিয়ে তাকে ভুয়া প্যানেল বিল জারি করেন। বলা হয়, তাৎক্ষণিকভাবে বিল না দিলে তার সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হবে এবং নতুন সংযোগের জন্য হয়রানি পোহাতে হবে। উপায়ন্তর না দেখে বিদ্যুৎগ্রাহক তাৎক্ষণিকভাবে পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে রফাদফা করেন।
মূলত টাস্কফোর্স শাখাটিই আলাদা। টাস্কফোর্সের অভিযান, কোম্পানি সচিবের আদেশে হয়ে থাকে। কিন্তু যেভাবে টাস্কফোর্সের কথা বলে গ্রাহককে ভুয়া বিল দিতে চাপ দেওয়া হয়েছে, তা চরম অন্যায় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানতে চাইলে ওই সময়ে ডিপিডিসির বংশাল জোনের নির্বাহী প্রকৌশলী অভিজিত সাহা (বর্তমানে বাংলাবাজার জোরে কর্মরত) রাইজিংবিডিকে জানান, ঘটনার দুদিন পর গ্রাহক তার কাছে এসেছিলেন টাস্কফোর্সের অভিযান নিয়ে। সেই টাস্কফোর্স গ্রাহকের কাছে টাকা দাবি করেছেন। বিষয়টি তিনি মূল টাস্কফোর্স টিমকে জানান। মূল টাস্কফোর্স টিম থেকে জানানো হয়, তারা এই ধরনের কোনও অভিযান পরিচালনা করেননি।
ডিপিডিসির প্রধান প্রকৌশলী (সেন্ট্রাল) মো. জাহাঙ্গীর আলম এবং ডিপিডিসির সাবেক কোম্পানি সচিব ও বর্তমানে বিদ্যুৎ বিভাগের উপসচিব মো. আসাদুজ্জামান
প্রতিষ্ঠানটির মানবসম্পদ বিভাগ (এইচআর) সূত্রে জানা যায়, এই ঘটনার পরে হঠাৎ ডিপিডিসির কোম্পানির সচিব, দপ্তরের মূল ট্রাস্কফোর্স বংশাল ডিভিশন এলাকায় ওই গ্রাহকের ভবনে অভিযান চালায়। সেসময় ট্রাস্কফোর্সের সদস্যরা ওই গ্রাহকের তোপের মুখে পড়ে। গ্রাহক তাদের জানায়, কয়েকদিন আগেই তাদের অপর এক দল টাস্কফোর্সকে তিনি পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছেন। বিষয়টি টাস্কফোর্সের সদস্যরা কোম্পানি সচিবকে জানায়। একইসঙ্গে ওই বিদ্যুৎগ্রাহকের কাছ থেকে ভুয়া প্যানেল বিল জারির কপি এবং ভুয়া ট্রাস্কফোর্স সদস্যদের মোবাইল নম্বরগুলো নিয়ে আসে। পরবর্তীতে কোম্পানি সচিব দপ্তর প্রাথমিক তদন্তে জানতে পারে, ঐ মোবাইল নম্বরগুলো তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. জাহাঙ্গীর আলম এবং বংশাল ডিভিশনের দুজন বিদ্যুৎকর্মীর।
পরবর্তীতে বিষয়টি কোম্পানিসচিব, তৎকালীন ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী বিকাশ দেওয়ানকে অবহিত করলে তাৎক্ষণিক কোম্পানি সচিবকে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি করা জন্য নির্দেশনা দেন। ওইদিন ডিপিডিসির তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী তারিকুল হকের (উন্নয়ন) নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ঘটনা তদন্ত করে প্রকৌশলী মো. জাহাঙ্গীর আলম এবং তৎকালীন বংশাল ডিভিশনের দুই বিদ্যুৎকর্মীকে দায়ী করে প্রতিবেদন জমা দেয়। পরে অভিযুক্ত বংশাল ডিভিশনের দুই বিদ্যুৎকর্মীকে চাকরিচ্যুত করে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হলে, জাহাঙ্গীর থেকে গেছেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
এ বিষয়ে ডিপিডিসির প্রধান প্রকৌশলী (সেন্ট্রাল) মো. জাহাঙ্গীর আলম রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘এই ঘটনায় আমার বিন্দুমাত্র সংশ্লিষ্টতা নেই। কোম্পানির সচিবের টাস্কফোর্সের অধীনে এসডি রিয়াজ পদোন্নতি নেওয়ার জন্য আমার বিরুদ্ধে লেগেছে।’
ঘটনা মীমাংসা করতে ডিপিডিসির সাবেক কোম্পানি সচিব মো. আসাদুজ্জামান তার কাছে দুই লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেছিলেন জানিয়ে জাহাঙ্গীর জানান, তিনি টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে আসাদুজ্জামান তাকে বিপদে ফেলে দিয়েছেন। টাকা দিতে পারলে কোনও সমস্যাই হতো না। কর্মজীবনের শেষ পর্যায় এসে এখন তার দুর্নীতির বোঝা মাথায় নিতে হচ্ছে বলেও আক্ষেপ করেন তিনি।
বিষয়টি নিয়ে ডিপিডিসির সাবেক কোম্পানি সচিব ও বর্তমানে বিদ্যুৎ বিভাগের উপসচিব মো. আসাদুজ্জামানের সঙ্গে কথা বললে রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘উনি আসলে পাগলের প্রলাপ বকেন। আমার সামনে এসে তো বলতে পারবেন না। ফেঁসে গেলেই এগুলো করে। তার পদোন্নতির ব্যাপারে আমি সুপারিশ করেছি। কী কারণে উনি এমন বলছেন, আমি জানি না। যাদের চাকরি গেছে তাদের বক্তব্য নিলেই সব বেরিয়ে আসবে। আর তার তো আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ আছে। তিনি তো সেই পথে যেতে পারেন।’
ভুয়া টাস্কফোর্সের এই ধরনের ঘটনা কোম্পানির আইনে গুরুতর অপরাধ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এটা তো ভয়াবহ ঘটনা। পরে এটা তদন্ত হয়েছে এবং অ্যাকশন হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা ডিপিডিসির ইতিহাসে কখনও ঘটেনি। যে কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য এটা অ্যালার্মিং।’
বিষয়টি নিয়ে ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী আবদুল্লাহ রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমি দেশের বাইরে আছি। ফিরে এসে সবকিছু জেনে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’