বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তির পর চার বছর চার মাসের মধ্যে আট মাসের অধিক সময় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। এছাড়া, ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগার জীবনের ১১ মাস বিএসএমএমইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সব মিলিয়ে গত ৭ বছরের সাজাপ্রাপ্ত সময়ে তিনি ১৯ মাসেরও বেশি সময় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
এখনও তিনি রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অধীনে নিবিড় পর্যবেক্ষণে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
বিএনপির স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা অবনতির দিকে। প্রতিবারই তাকে জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে, এটা খুবই উদ্বেগজনক। এবার ভর্তি হবার পর থেকে তার স্বাস্থ্যের আরও অবনতি হয়েছে।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাদণ্ড ভোগ করেন বেগম খালেদা জিয়া। এরপর ২০২০ সালে খালেদা জিয়ার পরিবারের পক্ষ থেকে তার ভাই শামীম ইস্কান্দার মানবিক কারণে স্থায়ীভাবে মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। সে বছরের ২৫ মার্চ সরকার নির্বাহী আদেশে সাজা স্থগিত করে শর্ত সাপেক্ষে (বিদেশে যেতে পারবেন না ও ঢাকায় থেকে চিকিৎসা) মুক্তি দেয় খালেদা জিয়াকে। এরপর ছয় মাস পরপর পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তার সাজা স্থগিত করে মুক্তির মেয়াদ বাড়াচ্ছে সরকার।
হাসপাতাল এবং দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে মুক্তির পর গত চার বছরে খালেদা জিয়াকে বিভিন্ন সময়ে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ২৬০ দিন (আট মাস ২০ দিন) থাকতে হয়েছে। আর কারাবন্দির পর থেকে এ পর্যন্ত ছয় বছরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং এভারকেয়ার হাসপাতাল- সব মিলিয়ে বেগম খালেদা জিয়া দেড় বছরের বেশি সময় হাসপাতালে রয়েছেন।
জানা গেছে, বেগম খালেদা জিয়া ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকারের নির্বাহী আদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল থেকে বাসায় ফেরেন। দুই বছরের বেশি সময় কারাগারে ছিলেন তিনি। এর মধ্যে ১১ মাস তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। কারামুক্তির পর ৯ দফায় হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি।
২০২১ সালের ২৭ এপ্রিল বেগম খালেদা জিয়া করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রথম এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন। এক মাস ২২ দিন পর ১৯ জুন গুলশানের বাসায় ফিরেন তিনি। ২৫ অক্টোবর খালেদা জিয়ার প্রথম সার্জারি করা হয়।
এরপর ২০২২ সালের ১১ জুন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে মধ্যরাতে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১২ দিন পর ২৪ জুন হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেন। ওই বছরের ২৮ আগস্ট আবারও হাসপাতালে ভর্তি হন খালেদা জিয়া এবং দুই দিন পর ৩১ আগস্ট হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেন।
২০২৩ সালের ২৯ এপ্রিল এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হয়ে পাঁচ দিন পর ৪ মে হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেন খালেদা জিয়া। ১৩ জুন আবারও হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। চার দিন পর ১৭ জুন বাসায় ফিরেন। ৯ আগস্ট ভর্তি হয়ে পাঁচ মাস দুই দিন পর ২০২৪ সালের ১১ জানুয়ারি বাসায় ফিরেন বেগম খালেদা জিয়া। সেটাই ছিল তার সবচেয়ে বেশি সময় হাসপাতালে থাকা।
২০২৩ সালের ২৬ অক্টোবর এভারকেয়ার হাসপাতালে যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটির স্কুল অব মেডিসিনের তিন বিশেষজ্ঞ জেমস পিটার অ্যাডাম হ্যামিল্টন, হামিদ আহমেদ আবদুর রব ও ক্রিস্টোস জর্জিয়াডেস খালেদা জিয়ার যকৃতের রক্তনালীতে অস্ত্রোপচার করেন।
এরপর আড়াই মাসেরও বেশি সময় বাসায় থেকে চিকিৎসা নেন তিনি। আবারও ২০২৪ সালের ৩১ মার্চ হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ২ এপ্রিল বাসায় ফেরেন। গত ২২ জুন রাত তিনটার দিকে তার শারীরীক অবস্থার অবনতি ঘটলে আবারও হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। ২৩ জুন খালেদা জিয়ার হৃদযন্ত্রে পেসমেকার স্থাপন করা হয়। ২ জুলাই হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেন তিনি।
সর্বশেষ গত ৮ জুলাই ভোর রাতে আবারও তার শারীরীক অবস্থা খারাপ হলে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সেই থেকে হাসপাতালের সিসিইউ সুবিধা সম্বলিত কেবিনে চিকিৎসকদের সার্বক্ষণিক তত্বাবধানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন তিনি।
খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এবং দলের ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন ওই সময় বলেছিলেন, পেসমেকার বসিয়ে সাময়িক একটা সমস্যার সমাধান করা হয়েছে। বেগম জিয়ার স্বাস্থ্য নিয়ে যে ঝুঁকি, সেটা খুব একটা কমছে বলে আমরা মনে করছি না।
তিনি আরও জানান, খালেদা জিয়া মূলত হার্ট, কিডনি ও লিভারসহ বিভিন্ন রোগে ভুগছেন। যেটি তার শারীরিক পরিস্থিতিকে বেশ জটিল করে তুলেছে।
প্রসঙ্গত, প্রায় ৭৯ বছর বয়সী বেগম খালেদা জিয়া হৃদরোগ, লিভার, ফুসফুস, কিডনি, আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন জটিলতায় ভুগছেন দীর্ঘদিন ধরে। এর মধ্যে লিভার, কিডনি ও হৃদরোগ তার জন্য সবচেয়ে ঝুঁকি বলে মনে করেন তার চিকিৎসকরা।