জাহাঙ্গীর আলম, নোয়াখালী জেলার চাটখিল উপজেলার নাহারখিল গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারের সন্তান। পিতা মৃত রহমত উল্লাহ ছিলেন খিলপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের কেরানী। দুই মেয়ে ও পাঁচ ছেলের মধ্যে জাহাঙ্গীর আলম ছিল দ্বিতীয়। টানাটানির সংসার পিতা রহমত উল্লাহর। ছেলে জাহাঙ্গীর আলম দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে কাজ করেন জাতীয় সংসদে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও গড়ে তুলেন সুসম্পর্ক। বাসা-বাড়িতে পিয়নের কাজও করতেন তিনি।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পাল্টে যায় দিনমজুর জাহাঙ্গীর আলমের জীবনযাত্রা। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠলোক পরিচয়ে হয়ে উঠেন অন্যতম প্রভাবশালী কর্মকর্তা। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী পরিচয়ে দেদারসে শুরু করেন নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় ব্যবহার করে ওই সময়ে বড় বড় প্রকল্প পাইয়ে দিতে একচেটিয়া তদবির করে অল্পসময়ে বনে যান কোটিপতি।
শুধু তাই নয়, মোটা অংকের বিনিময়ে বিভিন্ন এলাকায় প্রভাব বিস্তার করে এমপিসহ জনপ্রতিনিধি মনোনয়নে ভূমিকা রাখতেন তিনি। সেই থেকে টানা আওয়ামী লীগ সরকার আমলে প্রধানমন্ত্রীর পিএ হিসেবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে যা ইচ্ছা তাই করেছেন। হেলিকপ্টার ছাড়া তিনি গ্রামের বাড়ি যেতেন না। নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হলেও নোয়াখালীর রাজনীতির অন্যতম নিয়ন্ত্রক।
এক সময়ের দিনমজুর থেকে এখন শতকোটি টাকার মালিক সাবেক প্রধানমন্ত্রীর আলোচিত সেই পিয়ন জাহাঙ্গীর আলম। নগদ টাকা, একাধিক ফ্ল্যাট, জমিজমা, ব্যাংক ব্যালেন্স, কী নেই তার! নিজের ও স্ত্রীর নামে-বেনামে অবৈধ স্থাবর অস্থাবর সম্পদের পাহাড় গড়েছেন, জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে প্রাথমিক অনুসন্ধানে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্যই উঠে এসেছে।
গত ১৫ জুলাই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই জাহাঙ্গীর আলমকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘আমার বাসায় কাজ করেছে, পিয়ন ছিল সে, এখন ৪০০ কোটি টাকার মালিক।’ তার পরই জাহাঙ্গীর আলমের দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়টি আলোচনার ঝড় তোলে।
এমন তথ্য প্রকাশের পর তার সাবেক ব্যক্তিগত সহকারী জাহাঙ্গীর আলম, তার স্ত্রী এবং তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাংক হিসাব জব্দ করার নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
জানা গেছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী জাহাঙ্গীর আলমের অবৈধ সম্পদের খোঁজ নিতে মাঠে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন। দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক সহকারী পরিচালক (বর্তমান উপপরিচালক) মো. জাহিদ কালামের নেতৃত্বে কমিশনের একটি টিম গোপনে তথ্য সংগ্রহ করেন। প্রাথমিক অনুসন্ধানে তার বিরুদ্ধে অনিয়ম দুর্নীতি ও তদবিরের মাধ্যমে গড়ে তোলা অবৈধ সম্পদের প্রমাণ পাওয়া যায়। তার ভিত্তিতে প্রাথমিক অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করেন এবং তার ও স্ত্রীর অবৈধ সম্পদের খোঁজ নিতে আরও প্রকাশ্য অনুসন্ধানের সুপারিশ করেন। তারপর থেকেই দুদকের একটি টিম আলোচিত এই জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান কাজ শুরু করেছেন।
দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা যায়, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তিনি নোয়াখালী-০১ (চাটখিল-সোনাইমুড়ী) থেকে নির্বাচনে অংশ নিতে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে জমা দেওয়া হলফনামায় তিনি উল্লেখ করেন যে, তার নিজের নামে প্রায় ২১ কোটি টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ রয়েছে। তার স্ত্রী কামরুন নাহারের নামে রয়েছে ৭ কোটি ৩০ লাখ টাকার সম্পদ। জাহাঙ্গীর নিজের নামে সাড়ে চার একরের বেশি কৃষিজমি, ৩ কোটি ১৯ লাখ টাকার অকৃষিজমি, মোহাম্মদপুর ও নিউ মার্কেটে দুটি দোকান, মিরপুরে ৭ তলা ভবন, গ্রামের বাড়িতে ১ তলা ভবন ও মিরপুরে ২টি ফ্ল্যাট দেখিয়েছেন (দাম ধরা হয়েছে ৪৪ লাখ ৬৯ হাজার টাকা)।
তাছাড়া চাটখিলে পৈত্রিক ভিটায় করেছেন ৪ তলা বাড়ি। স্ত্রীর নামে রাজধানীর ধানমন্ডিতে ২৩৬০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাটের দাম ৭৬ হাজার ১৮ হাজার ৭৫০ টাকা। এই ফ্ল্যাটের ঠিকানা: ফ্ল্যাট নং- ৪/এ, বাসা নং-১৬, রোড নং- ১৫ (নতুন), (পুরাতন-২৮), ধানমন্ডি, ঢাকা। জাহাঙ্গীর পরিবারের একটি আটতলা বাড়ি রয়েছে নোয়াখালী জেলা শহর মাইজদীর হরিনারায়ণপুর এলাকায়। বাড়িটিতে ১৯টি ফ্ল্যাটের মধ্যে ১৮টি ভাড়া দেওয়া হয়েছে। তিনতলার একটি ফ্ল্যাট ব্যবহার করেন জাহাঙ্গীরের পরিবার। অস্থাবর সম্পদ হিসেবে নগদ টাকা ও ব্যাংকে মিলিয়ে ০২ কোটি ৫২ লাখ ২ হাজার ৪৩০ টাকা এবং স্ত্রীর নামে আছে ১ কোটি ১৭ লাখ ৪৬ হাজার ৬০৬ টাকা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ডিপিএস আছে ২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, এফডিআর রয়েছে ১ কোটি ৩০ লাখ ৫৫ হাজার ৯৬৮ টাকা। স্ত্রীর ব্যাংকে স্থিতি ২৭ লাখ ৯৭ হাজার ৪৫৫ টাকা ও ডিপিএস ১৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া স্ত্রীর নামে একটি গাড়ি আছে, যার দাম হলফনামায় দেখানো হয়েছে ২২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। অংশীদারি ফার্মে তার মূলধন আছে ৬ কোটি ২৪ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। স্ত্রীর ব্যবসায় মূলধন আছে ৭৩ লাখ ৩৮ হাজার ৫১০ টাকা। একে রিয়্যাল এস্টেট লিমিটেড নামক একটি ডেভেলপমেন্ট কোম্পানিরও মালিক জাহাঙ্গীর আলম।